1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‌পরিযায়ী বাঙালি শ্রমিকদের দুর্দশা

রাজীব চক্রবর্তী
১৭ এপ্রিল ২০২০

চিকিৎসকদের মতে, নভেল করোনা ভাইরাস ফুসফুসে আক্রমণ করে। কিন্তু, ফুসফুস নয়, পরিযায়ী শ্রমিকরা চিন্তিত খালি পেট নিয়ে। কারণ, একমুঠো ভাতের পরিবর্তে মিলছে শুধুই আশ্বাস।

ছবি: Reuters/A. Abidi

গত ২৫ মার্চ থেকে ভারত জুড়ে তালাবন্দি চলছে। ২১ দিনের পর আরো ১৯ দিন মিলিয়ে মোট ৪০দিন প্রায় সব বন্ধ। ভিন রাজ্যে আটকে পড়েছেন বিপুল সংখ্যক শ্রমিক। তারা প্রত্যেকেই নিজের রাজ্যে কাজ না পেয়ে পেটের টানে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে দিল্লি, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, হরিয়ানা, কেরালা, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুসহ বিভিন্ন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। বাংলার একাধিক জনপ্রতিনিধি ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজেদের নির্বাচনি কেন্দ্র থেকে ভিন রাজ্যে যাওয়া অসহায় শ্রমিকদের সাহায্যের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কোথাও কোথাও সাহায্য মিলছেও। এই তালিকায় কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী, তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্ররা রয়েছেন।

কিন্তু বাকিদের নিষ্ক্রিয়তায়‌ শ্রমিকরা হতাশ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮টি রাজ্যকে চিঠি লিখে পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্যের অনুরোধ করেছেন। ব্যাস, আপাতত ওইটুকুই। সাহায্য মিলছে কই!‌ বেশিরভাগ জায়গায় শ্রমিকরা নিজেদের জমানো অর্থে অন্নের সংস্থান করছেন। কিছু এলাকায় মিলছে একবেলার খাবার। বাংলায় আরো অসহায় তাদের পরিবারের সদস্যরা। পর্যাপ্ত খাদ্য না পেয়ে ঘরে ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বহু বাঙালি শ্রমিক। মুখ্যমন্ত্রীর নিজের হিসেব অনুযায়ী, ভিন রাজ্যে আটক বাঙালি শ্রমিকের সংখ্যা দু-‌লক্ষ, যদিও বাস্তব তা বলছে না।

টেলিফোনে ভিন রাজ্যে আটক বেশ কয়েকজন বাঙালি শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে চেয়েছে ডয়েচে ভেলে। মোটামুটি সকলের এক কথা— বহু মানুষ সাহায্যের আশ্বাস দিচ্ছেন। বাস্তবে কিছুই মিলছে না। ১৪ এপ্রিল প্রথম দফার লকডাউন উঠলে বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁরা। এখন দ্বিতীয় দফায় ৩ মে পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণার পর কার্যত অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটছে ওঁদের।

শক্তিপদ দিন্ডা

This browser does not support the audio element.

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার মোর্তাজা শেখ, আইনুল শেখ, বাবলু শেখরা তিন ভাই। মাস চারেক আগে কাজের সন্ধানে কেরালায় গিয়েছেন। এক ইটভাটায় কাজ পেয়েছিলেন। রোজগার সামান্য। কিন্তু তারপর আচমকা করোনা-‌সংকট। এবং লকডাউনের ঘোষণা। স্বভাবতই বন্ধ হয়েছে রোজগার। তপ্ত রোদে পলিথিনের ছাউনির নীচে শতাধিক শ্রমিকের সঙ্গে বসবাস করছেন তারা। কেরালা সরকারের ‘‌কমিউনিটি কিচেন'‌-‌এর দৌলতে একবেলা রান্না করা খাবার জুটছে গত কয়েকদিন ধরে। কিন্তু, বাকি সময় খিদে পেট নিয়ে শুয়ে থাকছেন তারা। কোথাও কোনো সাহায্যের অবকাশ নেই। ইটভাটার মালিক গা-‌ঢাকা দিয়েছেন। মোর্তাজা জানালেন, ‘‌‘‌মাস দুয়েক আগে আব্বার চোখ অপারেশন হয়েছে। এখন কিডনির সমস্যা। চিকিৎসকেরা অপারেশন করাতে বলছেন। বৃদ্ধা মা বাতের ব্যাথায় কাবু। জমানো টাকা সব শেষ। মালিক বেপাত্তা।'‌'‌ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘লকডাউন এইভাবে চললে খাব কী?‌ বাঁচব কীভাবে?‌ চিকিৎসার খরচ পাব কোথায়?‌''‌

ভিক্টর গায়েন

This browser does not support the audio element.

একই ছবি দিল্লির শাহপুর জাট এলাকায় আটকে থাকা অন্তত বিশ হাজার এমব্রয়ডারি শিল্পের শ্রমিকের। সবার হাতে স্মার্টফোন ও আনলিমিটেড ডেটা থাকলেও পেটে খাবার নেই। রাজ্য সরকারের বিজ্ঞাপন দেখে পেট ভরাতে হচ্ছে। ভিক্টর গায়েনের বাড়ি হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়ায়। বছর পাঁচেক হলো দিল্লিতে থাকেন। জানালেন, ‘‌‘‌বাড়িতে বয়স্ক বাবা-‌মা। মাসে গড়ে ৭ হাজার টাকা আয়। তালাবন্দি ঘোষণার পর থেকে বেতন বাকি রেখে কারখানার মালিক গায়েব হয়েছেন। দশ ফুট বাই ১২ ফুটের ভাড়ার ঘরে একসঙ্গে পাঁচ জন বাস করছি। দুপুরে দিল্লি সরকারের দেওয়া ৩ জনের খাবার খাচ্ছি ৫ জনে মিলে। রাতে সকলে মিলে চাঁদা তুলে কোনওমতে রান্না চলছে। এইভাবেই গুজরান। কিন্তু, কতদিন?‌''

মুম্বইয়ে কয়েক হাজার শ্রমিকের মতোই অসহায়ভাবে আটকে রয়েছেন স্বর্ণ কারিগর পরিমল তরফদার। বছর তিরিশের যুবকের পকেটে এক টাকাও নেই। সরকারি ত্রাণই ভরসা। সকাল ছ'‌টা থেকে খিচুনির লাইনে দাঁড়ান তিনি। দুপুর ১টায় রান্না করা খাবার আসে। কোনোদিন জোটে কোনোদিন খালি পেটে দিন গুজরান। কেরালার কোন্নুর জেলায় আটকে রয়েছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা থানার বাসিন্দা শক্তিপদ দিন্ডা। মার্চ মাসে বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা ছিল তার। গত ২৬ মার্চ ট্রেনে ওঠার জন্য টিকিট কেটে রেখেছিলেন। ২৪ তারিখ রাতে লকডাউন ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই থেকে দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে রয়েছেন। খাবার নেই। পানীয় জল নেই। নেই সরকারি সাহায্যও।

ডয়চে ভেলেকে শক্তিপদ বলেছেন, ‘‌‘‌লকডাউনের জেরে কারখানা বন্ধ। টাকাকড়ি, খাবার কিছুই নেই। নানা জায়গায় যোগাযোগ করেছি। সবাই সমস্যার কথা শুনেছেন। আশ্বাস দিয়েছেন। কিছু বন্দোবস্ত হয়নি। কারখানার মালিক কোনো খোঁজ নেননি। ফোন করলেও রিসিভ করছেন না। না খেতে পেয়ে মরতে হবে মনে হচ্ছে।'‌'‌ শক্তির মতোই অবস্থা পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুরের বাসিন্দা মফিজুর রহমানের। দিল্লির সিরিফোর্ট এলাকায় জরির কাজ করেন। লকডাউনের পর কাজ নেই। রোজগার নেই। বাড়ির মালিক ভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। আপাতত দুপুরে সরকারি খিচুড়ি, রাতে মুড়ি খেয়ে দিন কাটছে। আরো খারাপ পরিস্থিতি গুজরাটের সুরাটে। সেখানে টেক্সটাইল, পাওয়ারলুম এবং নির্মাণ শিল্পের বহু শ্রমিক বাঙালি। বেতন না দিয়েই গায়েব হয়েছেন ঠিকাদাররা। একবেলা খেয়ে কোনো মতে বেঁচে আছেন কয়েক হাজার শ্রমিক।