‘পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ছাড়া কিছুই করার নেই বাংলাদেশের’
সমীর কুমার দে ঢাকা
১০ জানুয়ারি ২০২০
যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় সোলেইমানির মৃত্যুর পর পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরান৷ পরিস্থিতি এখন শান্ত হলেও পরবর্তীতে এশিয়াতে, বিশেষ করে বাংলাদেশে কি প্রভাব পড়বে? বাংলাদেশের অবস্থানই বা কী হওয়া উচিৎ?
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া কিছুই করার নেই বাংলাদেশের৷
ইরান তো পাল্টা হামলা চালাল, এখন কি যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে?
না, যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে এটা বলা যাবে না৷ তবে একটা অশান্ত অবস্থার দিকে যাচ্ছে৷ এটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নতুন কিছু নয়৷ আগেও ইরাক যুদ্ধ হয়েছে৷ ফিলিস্তিন ইস্যুতেও এখানে একাধিকার যুদ্ধ হয়েছে৷ এবারের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন৷ ইরান সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে৷ এই পরিস্থিতি নানা দিকে মোড় নিতে পারে৷ ট্রাম্পের যে বক্তব্য সেখানে সরাসরি তারা মুখোমুখি অবস্থানে আছে৷ কিন্তু এ বছরের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে যে নির্বাচন সেই নির্বাচনকে ঘিরে অভ্যন্তরণীন রাজনীতিরও বিষয় আছে। ফলে পরিস্থিতিকে আরো বেশি উত্তপ্ত করার প্রয়াস এখানে আছে৷ তবে আমি সরাসরি যুদ্ধের পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনা করছি না৷
যদি যুদ্ধ হয় বা না হয়, তাহলেও এই পরিস্থিতিতে এশিয়ায় কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?
প্রভাব পড়তে পারে৷ মধ্যপ্রাচ্য হল সেন্টার৷ একদিকে ভূরাজনীতির জন্য অন্যদিকে অর্থনীতির জন্য৷ সমুদ্র পথের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ৷ তেলের দামের বিষয়টি বাংলাদেশসহ সব দেশকেই প্রভাবিত করে৷ অর্থনৈতিক প্রভাব আস্তে আস্তে পড়তে পারে৷ মধ্যপ্রাচ্যের যে শ্রম বাজার সেই বাজারের উপর এশিয়ার অনেক দেশই নির্ভরশীল৷ বাংলাদেশ ছাড়াও ফিলিপাইন, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল অনেক দেশই আছে৷ সেই শ্রমবাজারের উপর প্রভাব বিস্তার করলে সেটিও একটা চাপ পড়বে৷
বাংলাদেশের অবস্থান কি হওয়া উচিৎ?
শুধু ইরান না, সৌদিআরব, তার্কিসহ মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোন পথ দেখি না। শুধু বাংলাদেশ না, পৃথীবির অনেক দেশের পক্ষেই সেটি সম্ভব না। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য ইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিকে খুন করেছে। সেটি অবশ্যই দুই দেশের মধ্যের বিষয়। বাংলাদেশর অবস্থান হল শান্তি বজায় রাখতে এক ধরনের আবেদন করা। দুই দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক আছে। এখন বিশ্বের অনেক শক্তিশালী দেশ আছে, জাতিসংঘ আছে তাদের এখানে ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন।
দেলোয়ার হোসেন
বাংলাদেশ তো ইরানি কমান্ডার হত্যার নিন্দাই জানায়নি। এতে কি ইরান বা তাদের বন্ধু রাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হতে পারে?
এখানে ক্ষুব্ধ হওয়ার বিষয় না। এটা ভিন্ন রকমের বাস্তবতা। এটা দ্বিপাক্ষিক বিষয়। এখানে নিন্দা জানানোর বিষয়টি ইরানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। ইরান ভালো করেই জানে যে, বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কি? এ কারণে অনেক দেশই সরাসরি ইরানের পক্ষ অবলম্বন করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের এই কাজ অফিসিয়ালি অনেক দেশ নিন্দা জানায়নি। কিন্তু বহু মানুষ ব্যক্তিগতভাবে এর প্রতিবাদ করেছে।
মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কি শেষ পর্যন্ত চুপ থাকতে পারবে? যদি চুপ থাকে তাহলে কি প্রভাব পড়বে?
এটি চুপ থাকা বা না থাকার বিষয় না। এটি একেবারেই কূটনীতিক বিষয়। দুই দেশের আক্রমন ও পাল্টা আক্রমনের বিষয়টি দুই দেশের ইস্যু দ্বারা প্রভাবিত। এখানে সরাসরি নিন্দা জানানোর বিষয়টি সব ক্ষেত্রে ঘটে না। সেই বাস্তবতার নিরিক্ষেই বাংলাদেশকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে হচ্ছে। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তো সেই অর্থে ঐক্য নেই। এতবড় একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে ওআইসির ভূমিকা কি? আরব লীগ কি করছে? বাংলাদেশ তো দূরে আছে, পাশে যে দেশগুলো কাতার, আরব আমিরাত, কুয়েত, সৌদিআরব তাদের ভূমিকা কি। যদিও ওই সব দেশে মার্কিন সৈন্য আছে। তবুও তো তারা মুসলিম দেশ। এগুলো বিশ্লেষন করলে দেখা যাবে, জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই দেশগুলোকে ভূমিকা নিতে হয়। ফলে বাংলাদেশের অবস্থান আলাদাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোন সুযোগ নেই।
এই মুহুর্তে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কোন পথে যাওয়া উচিত?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির নতুন করে কোন পথ নেওয়ার কিছু নেই। এখন যে জায়গায় আছে, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা। কোন বিশেষ শক্তির পক্ষে না যাওয়া। আমাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য যে দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা দরকার সেগুলো রাখতে হবে। আমাদের ক্ষতি হয় এমন কোন ঘটনার সঙ্গে যুক্ত না হওয়া। মধ্যপ্রাচ্য সবসময়ই বাংলাদেশের জন্য একটা স্পর্শকাতর এলাকা। এখানে কতগুলো পরিস্কার জাতীয় স্বার্থের বিষয় আছে। শ্রমবাজার যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা মাথায় রাখা। তেলের দাম বাড়লে কি হবে সেদিকে খেয়াল রাখাই হবে এখন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
ইরানের শত্রু-মিত্র
১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সর্ম্পকের অবনতি ঘটে৷ প্রভাব পড়ে বাকি দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগেও৷ ছবিঘরে দেখুন ইরানের আজকের শত্রু-মিত্র কারা, কার সঙ্গে তার কেমন সম্পর্ক৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Taherkenareh
যুক্তরাষ্ট্র: বন্ধু থেকে শত্রু
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় মোসাদ্দেক সরকার উৎখাত হওয়ার পর ইরানের ক্ষমতায় আসেন রেজা শাহ পাহলভি৷ পরর্বতী ২৬ বছর ইরান-যুক্তরাষ্ট্র ছিল একে অপরের বন্ধু৷ ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই সম্পর্ক শত্রুতায় রূপ নেয়৷ ১৯৮০ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই৷ একে অপরকে তারা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবেও অ্যাখ্যায়িত করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Barria
ইসরায়েল: আন্তরিকতা থেকে অবিশ্বাস
তুরস্কের পর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া ২য় মুসলিম দেশ ইরান (১৯৫০ সাল)৷ রেজা শাহের শাসনকালে দুই দেশের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল৷ ১৯৭৯ সালে খোমেনি ক্ষমতায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইসরায়েলকেও শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন৷ তেহরান পরমানু অস্ত্র বানাচ্ছে বলে ১৯৯০ সালের পর থেকে অভিযোগ করছে ইসরায়েল৷ দেশটির বিরুদ্ধে হামাস ও হেজবোল্লাহকে মদদ দেয় ইরান৷ অন্যদিকে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রেকে সমর্থন দেয় ইসরায়েল৷
ছবি: AP
সৌদি আরব: ঘাড়ের কাছে শত্রু
মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা বিস্তারের লড়াইয়ে ইরানের চিরশত্রু সৌদি আরব৷ ১৯৭৯ সালে তেহরানের ক্ষমতায় পরিবর্তন আসার পর থেকেই তা প্রকট আকার ধারণ করেছে৷ দুই দেশ কখনও সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও চলছে তাদের ছায়াযুদ্ধ৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে বিবদমান গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দেয়৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে সৌদির দুইটি তেলক্ষেত্রে হামলার পেছনে ইরান রয়েছে বলে দাবি করেছে রিয়াদ৷
ছবি: picture-alliance/AA/E. Yorulmaz
রাশিয়া: দখলদার থেকে মিত্র
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইরানে আস্তানা গাড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও কয়েকবছর দখলদারি বজায় রাখে তারা৷ শাহের শাসনামলেও সম্পর্ক ভাল ছিল না৷ এমনকি ইরাক-ইরান যুদ্ধে সাদ্দামকে সহায়তা দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ তবে ১৯৯১ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে ইরান হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদার৷
ছবি: AP GraphicsBank
ইউরোপ: আলোচনায় সমাধান
ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের পর ইউরোপের সঙ্গেও তেহরানের সম্পর্ক শীতল হয়ে ওঠে ৷ তবে প্রেসিডেন্ট আলী আকবর রাফসানজানির সময়ে এই সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়৷ পরমাণুসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ইইউ বরাবরই ইরানের সঙ্গে আলোচনার উপর জোর দিয়ে আসছে৷ ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে পরমাণু কার্যক্রম স্থগিতকরণ চুক্তি বাতিল করলেও ইউরোপের দেশগুলো তা এখনও বজায় রেখেছে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Economou
চীন: অস্ত্র আর বাণিজ্যের সম্পর্ক
১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধে তেহরানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল চীন৷ বেইজিংয়ের শীর্ষ তিনটি অস্ত্র ক্রেতা দেশের একটি ইরান৷ অন্যদিকে ইরানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন৷ যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর সেখান থেকে তেল আমদানি ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিতে হয়েছে চীনকে৷ কাসেম সোলেইমানিকে হত্যাকাণ্ডের পর চীন জানিয়েছে তেহরানের সঙ্গে বেইজিংয়ে সম্পর্ক অটুট থাকবে৷
ছবি: AP / DW-Fotomontage
ইরাক: সর্ম্পকে নতুন মোড়
সাদ্দাম হোসেনের চালানো হামলা থেকে শুরু হওয়া ইরাক-ইরান যুদ্ধ অব্যাহত ছিল আট বছর৷ তবে বর্তমানে বাগদাদের শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে তেহরানের৷ দেশটির একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকেও সামরিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে ইরান৷ এইসব গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন বাহিনীর উপর হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে৷
কথিত আছে লেবাননের হেজবোল্লাহ গোষ্ঠীর উত্থান ইরানের মাধ্যমেই৷ তাদের মূল টার্গেট মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের শত্রু ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আস্তানাগুলো৷ ২০১৮ সালে হেজবোল্লাহ ও তাদের জোট দেশটির নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে৷ যার মধ্য দিয়ে লেবাননের সরকারে ইরানের প্রভাব আরো বেড়েছে৷ এছাড়াও ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহী আর ফিলিস্তিনের হামাস ইরানের মিত্রশক্তি৷
ছবি: Reuters/O. Sanadiki
ভেনেজুয়েলা: শত্রু যখন একই
অবরোধ, অর্থনৈতিক সঙ্কট আর দুই দেশের একই শত্রু, ইরান-ভেনেজুয়েলাকে নিয়ে এসেছে কাছাকাছি৷ ২০০১ সালে ইরানের মোহাম্মদ খাতামি আর ভেনেজুয়েলার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের মাধ্যমে সহযোগিতামূলক এই সম্পর্কের গোড়াপত্তন৷ আহমদিনেজাদ ক্ষমতায় আসার পর তা আরো নিবিড় হয়৷ একক শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে দুইদেশ বেশি কিছু চুক্তিও করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/ABACA/Iran Presidency
বাংলাদেশ: পাঁচ দশকের সম্পর্ক
১৯৭১ সালের পর থেকে ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক৷ বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি ঢাকা এসেছিলেন৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে আসেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফ৷ অক্টোবরে বাকুতে ন্যাম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসার রুহানি ‘সাইডলাইন বৈঠক’ করেন৷ গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ১.৭৭ কোটি ডলারেরর পণ্য রপ্তানি করেছে দেশটিতে৷