ভারত সরকার ৮৫৭টি পর্নো সাইট বন্ধ করার ঘোষণা দিতেই নানা মহলে প্রশ্ন ওঠে৷ শেষ পর্যন্ত শিশু পর্নো সাইট ছাড়া অন্য সব পর্নো সাইটের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা জানায় দিল্লি৷ বলে, ইন্টারনেট সেন্সরশিপে কোনো কাজ হবে না৷
বিজ্ঞাপন
মোদী সরকারের টেলিকম তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ভারতের সাংস্কৃতিক বিন্যাসের কথা মাথায় রেখে ৮৫৭টি পর্নো সাইট বন্ধ করতে তৎপর হয়ে উঠেছিল৷ এর জন্য গত ৩১শে জুলাই ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের (আইএসপি) ওপর একটা অস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছিল নতুন দিল্লি৷ কিন্তু বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমগুলিতে এ কথা প্রচার হতে তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মহল সরব হয়ে ওঠে ভারতে৷ তাঁদের প্রশ্ন, শ্লীল-অশ্লীলের সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সংজ্ঞা নেই৷ তাহলে কে ঠিক করবে সেই সংজ্ঞা? যদি মনে করা হয় ভিক্টোরিয়ান যুগের রক্ষণশীল মানসিকতা নিয়ে পর্নো সাইটগুলি বন্ধ করা না গেলে দেশটা গোল্লায় যাবে, ভারতীয় সংস্কৃতির সর্বনাশ হবে, তাহলে খাজুরাহোর প্রাচীন ভাস্কর্যগুলির কী হবে? এই ধরণের ইন্টারনেট সেন্সরশিপ ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কি? কারো কারো মতে, বিজেপি সরকার হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা প্রসারে শিক্ষা, ইন্টারনেট, চলচ্চিত্র, বই প্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চাইছে৷ আর তার জন্যই এ নিষেধাজ্ঞা৷
তারপর আর কী? চাপের মুখে পড়ে সরকার তড়িঘড়ি তার নির্দেশিকা সংশোধন করেছে৷ সঙ্গে সঙ্গে এ-ও জানিয়েছে যে, সব পর্নো সাইট নয়, একমাত্র শিশুদের নিয়ে পর্নোগ্রাফিক বা অশ্লীল সাইটের ক্ষেত্রেই এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে এবং এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী নির্দেশেই৷
যৌনতা: অনন্তকাল ধরে বিতর্কিত
‘সেক্স’ কথাটা উঠলেই বিতর্ক শুরু হয়ে যায়৷ সেক্স নিয়ে যেমন বহু কেলেঙ্কারি, সেভাবেই যৌনতা নারীমুক্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ বন শহরের একটি প্রদর্শনীতে জার্মান সমাজে যৌনতা নিয়ে বিভিন্ন ঝড়ঝাপটার একটা খতিয়ান দেওয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘নিষিদ্ধ’ বিষয়
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে যৌনতা সংক্রান্ত মনোবৃত্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে৷ জার্মানিতে ‘ব্রাভো’-র মতো টিনেজার ম্যাগাজিনগুলিতে খোলাখুলি সেক্স সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়৷ এর আগে ফিল্মেও যা ‘নিষিদ্ধ’ বিষয় ছিল, তাই নিয়েই তৈরি হয় ১৯৬৮ সালের হিট ছবি ‘সুয়র জাখে, শ্যাটসেন’ বা ‘পথে এসো, প্রেয়সী’৷ এখানে ছবির নায়ক-নায়িকা ভ্যার্নার এঙ্কে ও উশি গ্লাস; মাঝের মহিলাটি হলেন পরিচালিকা মাই স্পিল্স৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মা যা ছিলেন
পঞ্চাশের দশকেও দুনিয়াটা ‘ঠিকঠাক’ ছিল – অন্তত নবীন পশ্চিম জার্মানির নীতি-নৈতিকতা যাদের দায়িত্বে, তাদের চোখে৷ নারীর স্থান ছিল গৃহে, সংসারে, পতিব্রতা স্ত্রী, স্নেহময়ী জননী, নিপুণা গৃহকর্ত্রী হিসেবে৷ কাজে যেতেন শুধু পুরুষরা৷ জনসমক্ষে সেক্স নিয়ে কথা বলা কিংবা রাস্তায় চুমু খাওয়া চলত না৷ ব্যক্তিগত জীবন ও নৈতিকতা ছিল গির্জা বা সরকারের তাঁবে৷
ছবি: DW/H. Mund
আদম ও হবার কাহিনি
১৯৫১ সালের জার্মান ছবি ‘দি জ্যুন্ডারিন’ বা ‘পাপিনী’ জার্মান ফিল্ম জগতে কেলেংকারির অবতারণা ঘটায়৷ রক্ষণশীল চ্যান্সেলর কনরাড আডেনাউয়ার-এর আমলে এ ধরনের ‘নোংরামি’ সেন্সর করা উচিত, এই ছিল অধিকাংশ মানুষের অভিমত৷ ‘পাপিনী’ ছবির যৌনোদ্দীপনামূলক দৃশ্যগুলো ছিল অতি সংক্ষিপ্ত, তা সত্ত্বেও ছবিটিকে কেন্দ্র করে নৈতিকতা ও প্রকাশ্য যৌনতা নিয়ে বিপুল তর্ক শুরু হয়ে যায়৷
ছবি: ullstein - Thomas & Thomas
নারীমুক্তি
শেরিং কোম্পানি যখন ১৯৬১ সালে প্রথম গর্ভনিরোধক ‘পিল’ বাজারে ছাড়তে শুরু করে, তখন জার্মানির গির্জায় গির্জায় ‘যুবসমাজের নৈতিক অধোপতন’ সম্পর্কে ভাষণ শোনা গেছে৷ পিল নেওয়ার ফলে মহিলাদের যৌন আসক্তির খবর বেরোয় পত্রপত্রিকায়৷ সব সত্ত্বেও, গর্ভনিরোধের নতুন উপায়গুলি মহিলাদের স্বনির্ধারণে সাহায্য করে৷
ছবি: DW/H. Mund
ছাত্র বিপ্লব, যৌন বিপ্লব
ষাটের দশকের শেষে জার্মানিতে যে ছাত্র বিপ্লব দেখা দেয়, তার সঙ্গে তথাকথিত ‘কাউন্টার কালচার’ বা বিকল্প সংস্কৃতিরও যোগ ছিল৷ সেই বিকল্প সংস্কৃতি – হিপি আমলের রূপরেখা অনুযায়ী – খোলা এবং স্বাধীন যৌনতায় বিশ্বাস করত, যার একটা প্রমাণ পাওয়া যায় ‘কমিউন ওয়ান’-এর মতো কুখ্যাত কলোনিতে স্ত্রী-পুরুষের একসঙ্গে বাস ও সহবাসে৷ যে কারণে রাইন্যার লাংহান্স এবং উশি ওবারমায়ার-এর মতো চরিত্র আজও অবিস্মৃত৷
ছবি: picture-alliance/KPA TG
যৌনশিক্ষা
৬৮-র ছাত্র বিপ্লব পশ্চিমে পরিবারজীবনের সংজ্ঞাই বদলে দেয়৷ তরুণ বাবা-মায়েরা নিজেদের ‘বাবা’ কি ‘মা’ বলে অভিহিত না করে, নাম ধরেই ডাকতে শুরু করেন৷ ১৯৬৯ সালে স্কুলের জীববিজ্ঞান ক্লাশে একটি যৌনশিক্ষার ‘মানচিত্র’ চালু করা হয়৷ স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অর্থানুকুল্যে সৃষ্ট ‘হেলগা’ নামধারী একটি যৌনশিক্ষার ফিল্ম দেখতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বাসে করে নিয়ে যাওয়া হতো৷
ছবি: DW/H. Mund
মেইল-অর্ডার যৌনতা
‘বেয়াটে উজে’ বললেই জার্মানির শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষ আজও বোঝেন: মেইল-অর্ডার সেক্স-শপ৷ যদিও সে-ধরনের দোকানে বাস্তবিক ঢোকার মতো সাহস আজও সকলের নেই – লোকলজ্জা বলে একটা কথা আছে তো৷ বেয়াটে উজে-র বাণিজ্যিক সাফল্যের সূচনা ১৯৪৮ সালে, যখন তিনি মহিলাদের গর্ভনিরোধের পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন করার জন্য একটি ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেন৷ তার পরে আসে তাঁর মেইল-অর্ডার সেক্স-শপ৷
ছবি: imago
পশ্চিমের আগে পুব
সাবেক পূর্ব জার্মানির মানুষরা তাদের পশ্চিমের সতীর্থদের চেয়ে অনেক বেশি যৌন স্বাধীনতা ভোগ করেছেন৷ গোটা পূর্ব জার্মানি জুড়ে ছিল নিউডিস্ট ক্লাব৷ যৌনতার বিচারে পুবের মেয়েরা পশ্চিমের মেয়েদের চেয়ে বেশি ‘স্বাধীন’ ছিলেন, বাচ্চাদের সরকারি ডে-কেয়ারে জমা করে প্যান্ট-শার্ট পরে কাজে যেতেন৷ স্বাধীনতার অপরপীঠে ছিল রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট বাধ্যবাধকতা৷ যেমন এই সাইনটিতে পূর্ব জার্মানির মায়েদের ‘ধন্যবাদ’ জানানো হচ্ছে৷
ছবি: DW/H. Mund
‘বিকারগ্রস্ত সমাজ’
যে সব চিত্রপরিচালক সর্বপ্রথম সমকামিতা নিয়ে ছবি তৈরি করেন, রোজা ফন প্রাউনহাইম ছিলেন তাঁদের অন্যতম৷ ১৯৭১ সালে তিনি একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন, যার বক্তব্য ছিল: সমকামী নিজে বিকারগ্রস্ত নয়, বিকারগ্রস্ত হল তার সমাজ৷ এভাবেই তিনি জার্মানির ‘গে’ এবং ‘লেসবিয়ান’ সম্প্রদায়ের জন্য সম্মান ও সমানাধিকার আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে দেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুগ-যুগান্তের সংস্কার
জার্মানিতে সমকামিতা ছিল একটি বিতর্কিত বিষয়, রাজনীতিকরাও যা নিয়ে কথা বলতে ভয় পেতেন৷ আইনের যে সূত্র – ১৭৫ নং অনুচ্ছেদ – দু’টি পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ককে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করেছিল, সেই অনুচ্ছেদটি ১৯৬৯ সালে কিছুটা নরম করার পর, ১৯৯৪ সালে পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়৷ কিন্তু – বিশেষ করে খেলাধুলার জগতে – সমকামীদের প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব আজও পুরোপুরি উধাও হয়নি৷
ছবি: DW/H. Mund
নারী না পুরুষ?
ট্র্যান্সভেস্টাইট আর্টিস্ট, ২০১৪ সালের ইউরোভিশন সং কনটেস্ট বিজয়ী কনচিটা ভুয়র্স্ট ওরফে টম নয়ভির্থ আজ একজন সেলিব্রিটি৷ দাড়ি-সম্বলিত, ইভনিং গাউন পরিহিতা কনচিটা ২০১৫ সালের ইউরোভিশন গানের প্রতিযোগিতায় উপস্থাপিকা ছিলেন৷ তা-তে কারো কোনো আপত্তি দেখা যায়নি – আপাতদৃষ্টিতে৷...
ছবি: DW/H. Mund
ইতিহাস
জার্মানির ‘ড্র্যাগ কুইন’ তথা টিভি হোস্ট লিলো ভান্ডার্স এই প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করেন৷ ‘নির্লজ্জ? পরিবর্তনের মুখে যৌন নৈতিকতা’ প্রদর্শনীটি চলবে ২০১৬ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি অবধি, বন শহরের ‘হাউড ডেয়ার গেশিস্টে’ বা ইতিহাস ভবনে৷
ছবি: DW/H. Mund
12 ছবি1 | 12
কেন্দ্রীয় টেলিকম মন্ত্রী রবিশংকর প্রসাদ গত ৪ঠা আগস্ট বিষয়টি খোলসা করে বলেছেন যে, আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে পর্নোগ্রাফিক সাইট যে কার্যত বন্ধ করা সম্ভব নয়, সেটা বুঝেই এই সংশোধন৷ তবে এটা সাময়িক সিদ্ধান্ত মাত্র৷ সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায় জানার পর সরকার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে একটি দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রণয়ন করবে৷ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষগুলির মধ্যে থাকবে এনজিও, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, অভিভাবক এবং শিশুদের কাউন্সিলার৷ তবে নৈতিক পুলিশের ভূমিকা নেবার কোনো ইচ্ছা সরকারের নেই৷ কেউ কেউ এই নিষেধাজ্ঞাকে তালিবানি শাসনের সঙ্গে তুলনা করায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বলেন, এই অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন৷ এছাড়া ইন্টারনেট সেন্সরশিপেও সরকার বিশ্বাসী নয়৷ তবে শিশু পর্নো সাইট বন্ধ করতে সরকার কৃতসংকল্প৷ ‘‘শিশুদের নিয়ে যৌনাচার এক উদ্বেগজনক সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে'', বলেন কেন্দ্রীয় টেলিকম মন্ত্রী৷
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে বিশিষ্ট আইনজীবী কমলেশ ভাসওয়ানি এক জনস্বার্থ বিষয়ক মামলা দায়ের করে অভিযোগ করেন যে, শিশু বিষয়ক পর্নোগ্রাফিক সাইট ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না৷ তাই এটাকে জামিন অযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হোক৷ তিনি বলেন, ‘‘অবিলম্বে পর্নো সাইটগুলি বন্ধ না করলে ধর্ষণ ও যৌন অপরাধ সীমা ছাড়িয়ে যাবে৷''
এর প্রেক্ষিতে, গত জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এইচ. এল দাত্তু সরকারের কাছে জানতে চান, ‘‘বিষয়টি যেহেতু খুব গুরুতর৷ তাই সরকার পর্নো সাইট, বিশেষ করে শিশুদের নিয়ে অশ্লীল সাইট বন্ধ করার জন্য কী ব্যবস্থা নিয়েছে? এ বিষয়ে সরকারের অবস্থানই বা কী?'' এরপর চার সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা দিয়ে খোদ সরকারের কাছে এ সব প্রশ্নের উত্তর চায় সুপ্রিম কোর্ট৷ পাশাপাশি ভারতের সর্বোচ্চ আদালত এ কথাও বলে যে, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক যদি তাঁর চার দেওয়ালের মধ্যে পর্নো সাইট দেখতে চান, তাহলে সেটা বেআইনি নয়৷ সেটা তাঁর ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে৷ সেই স্বাধীনতায় সরকার কখনোই হস্তক্ষেপ করতে পারে না৷