লন্ডনের বিগ বেন, প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের মতো বার্সেলোনা শহরের প্রতীক এক অভিনব গির্জা ও তাকে ঘিরে চত্বর৷ কিন্তু পর্যটকদের ভিড়ে সংলগ্ন এলাকার চরিত্র বদলে যাচ্ছে, স্থানীয় বাসিন্দারা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে৷
বিজ্ঞাপন
পর্যটকদের কাছে বার্সেলোনা শহরের মূল আকর্ষণ ‘সাগরাদা ফামিলিয়া' চত্বর, যেখানে স্থপতি গাউডি-র অসমাপ্ত গির্জাটি দেখে দর্শকদের চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে ওঠে৷ কেউ বলেন, ‘‘অসাধারণ! বর্ণনার ভাষা পাচ্ছি না৷ এটা আমার স্বপ্ন ছিল৷'' আরেক জনের মন্তব্য, ‘‘এই শহরে মাত্র ৮ ঘণ্টা সময় পেয়েছি৷ মনে হলো, এটা দেখতেই হবে৷'' আর এক পর্যটক বললেন, ‘‘গির্জার চারিদিকে এমন খোলা জায়গা রাখা দারুণ আইডিয়া৷ ভিতরে যাবার আগেই শান্তির পরিবেশ৷''
৩০ লাখ মানুষ প্রতি বছর ‘সাগরাদা ফামিলিয়া' চত্বরে আসেন৷ সেখানে বার্সেলোনার বাসিন্দারা প্রায়ই কোণঠাসা হয়ে পড়েন৷ এই এলাকার মানুষের কাছে ‘সাগরাদা ফামিলিয়া' চত্বর জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে উঠেছে৷ ফ্যার্নান্দো লাস্ত্রা ও ফ্রানসিস্কো বোয়েরা সপরিবারে প্রায় ৪ দশক ধরে এখানে বসবাস করছেন৷ এটাই তাঁদের বাড়ি৷ পরিবারের শিশুরা এখানেই বড় হয়েছে৷ কিন্তু জায়গাটিকে ঘিরে এত মাতামাতি আর সহ্য হচ্ছে না৷ স্থানীয় বাসিন্দা ফ্রানসিস্কো বোয়েরা বলেন, ‘‘আগে এই আবাসিক এলাকায় দিব্যি আরামে হাঁটাচলা করা যেত৷ এখন শুধু অস্থির পরিবেশ৷'' তাঁরই প্রতিবেশী ফ্যার্নান্দো লাস্ত্রা মনে করেন, ‘‘এখন জায়গাটা অ্যামিউজমেন্ট পার্ক হয়ে উঠেছে৷ পর্যটকদের ভিড়, বাস, প্রতারক, পকেটমার এই সব৷''
এলাকার বাসিন্দাদের এক সংগঠন কয়েক বছর ধরে ‘সাগরাদা ফামিলিয়া'-র মূল চরিত্র ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ পর্যটকদের জন্য দোকানের চাপে বেকারি ও মাছের দোকানও উধাও হয়ে গেছে৷ সাগরাদা ফামিলিয়া নাগরিক আন্দোলনের প্রতিনিধি জোয়ান ইচাসো বলেন, ‘‘এখানে পর্যটকদের সুভেনির শপ ও ফাস্ট ফুট রেস্তোরাঁর এক একপেশে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে৷ তাদের হাতে অনেক টাকা, তাই দোকানের ভাড়া অনেক বেড়ে গেছে৷ ফলে এলাকার বৈচিত্র্যের থেকে টাকার জোরই বড় হয়ে উঠেছে৷''
বসফরাসের সুন্দর স্থাপত্য হাজিয়া সোফিয়া
আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ১৯৩৪ সালে হাজিয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে পরিবর্তিত করেন৷১৯৮৫ সালে হাজিয়া সোফিয়া ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনার তালিকায় স্থান পায়৷
ছবি: picture-alliance/Marius Becker
স্থাপত্যশিল্পে ‘মাইলফলক’
৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ান কনস্ট্যান্টিনোপলের অধিবাসীদের জন্য এমন একটি গির্জা নির্মাণের নির্দেশ দেন, যেটি আগে কখনো নির্মাণ হয়নি, এমনকি ভবিষ্যতেও হবে না৷ গির্জাটি নির্মাণে কাজ করেছিল ১০ হাজার কর্মী৷ অন্তত এক হাজার বছর ধরে বসফরাস ব্যাসিলিকাই ছিল খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় চার্চ৷
ছবি: imago/blickwinkel
বাইজেন্টাইনদের অভিষেক স্থল
হাজিয়া সোফিয়ার নিমার্ণে জাস্টিনিয়ান প্রায় ১৫০ টন স্বর্ণ বিনিয়োগ করেছিলেন৷ এরপরও ভবনটির কিছু সংস্কার প্রয়োজন ছিল৷ কেননা গম্বুজটা ছিল একেবারে সমতল এবং ভূমিকম্পের কারণে যা কিছুটা বেঁকে গিয়েছিল৷ নির্মাণের পর থেকে হাজিয়া সোফিয়া রোমান সাম্রাজ্যের প্রধান গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হত৷ সপ্তম শতক থেকে সব বাইজেন্টাইন সম্রাটদের অভিষেক হত এখানে৷
ছবি: Getty Images
গির্জা থেকে মসজিদে রূপান্তর
১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে কনস্ট্যান্টিনোপলে বাইজেন্টাইনদের রাজত্ব শেষ হয়৷ এর দখল নেন অটোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সুলতান মোহাম্মদ এবং তখন হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করেন৷ প্রথমে একটি মিনার নির্মাণের মাধ্যমে রূপান্তরের কাজ শুরু হয়৷ এরপর ক্রস, ঘণ্টা এবং চিত্রকর্মের পরিবর্তন করা হয়৷
ছবি: public domain
মসজিদ থেকে জাদুঘর
আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ১৯৩৪ সালে হাজিয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে পরিবর্তিত করেন৷ সংস্কারের সময় পুরোনো বাইজেন্টাইন স্থাপত্য মোজাইক খুঁড়ে বের করা হয়৷ তবে খুব সতর্কতার সাথে এটা করা হয়েছে, যাতে পরবর্তীতে ইসলামিক যে নিদর্শনগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলো যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়৷
ছবি: AP
ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধর্মের সহাবস্থান
হাজিয়া সোফিয়ার ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো যেন এর মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হয়েছে৷ একপাশে মোহাম্মদ, অন্যদিকে আল্লাহ লেখা আবার মাদার মেরীর কোলে যীশু খ্রিষ্ট সবই আছে এখানে৷ সেই সাথে গম্বুজে ৪০টি জানালা দিয়ে আলো এসে এটিকে যেন অতিপ্রাকৃত করে তোলে৷
ছবি: Bulent Kilic/AFP/Getty Images
বাইজেন্টাইন আইকন
হাজিয়া সোফিয়ার সবচেয়ে সুন্দর শিল্পকর্মের একটি এটি৷ হাজিয়া সোফিয়া খুঁড়ে ১৪ শতকের এই নিদর্শন পাওয়া গেছে, যা গ্যালারিতে রাখা আছে৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
প্রার্থনার জায়গা নেই
হাজিয়া সোফিয়াতে বর্তমানে প্রার্থনা করা নিষিদ্ধ৷ ২০০৬ সালে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট যখন হাজিয়া সোফিয়াতে গিয়েছিলেন, তখন এই ব্যবস্থাপনাকে সম্মান জানিয়েছিলেন৷ তবে তুরস্কের মানুষ এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল৷
ছবি: Mustafa Ozer/AFP/Getty Images
প্রতীকি মূল্য
হাজিয়া সোফিয়ার পাশেই অবস্থিত সুলতান আহমেদ মসজিদ যা ব্লু মস্ক বা নীল মসজিদ হিসেবে বেশি পরিচিত৷ তুরস্কবাসী চান যাতে হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করা হয় এবং সেখানে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/Arco
খ্রিষ্টানদের দাবি
কনস্ট্যান্টিনোপলে সনাতন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের প্রধান যাজক প্রথম বার্থোলোমায়সও হাজিয়া সোফিয়া তাঁদের বলে দাবি করেছেন৷ বহু বছর ধরে তিনি এর পক্ষে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন৷ এটাকে গির্জা হিসেবে ব্যবহারের আবেদন জানিয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সিন্ধান্ত হয়নি
হাজিয়া সোফিয়ার ভবিষ্যত এখনো অনিশ্চিত৷ বিরোধী দল এমএইচটি এটিকে মসজিদে রূপান্তরের জন্য এখনও দাবি জানাচ্ছে৷ এখন পর্যন্ত পার্লামেন্টে দুটি আবেদন করেছে তারা, যা নাকচ হয়েছে৷ ১৯৮৫ সালে হাজিয়া সোফিয়া ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনার তালিকায় স্থান পায়৷
ছবি: picture-alliance/Marius Becker
10 ছবি1 | 10
‘সাগরাদা ফামিলিয়া' চত্বর থেকে ছোট ছোট দোকান উধাও হওয়া বন্ধ করতে শহর কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট নিয়ম স্থির করার চেষ্টা করছে৷ শহর কর্তৃপক্ষকে ধোঁকা দেওয়ার কারণে কয়েকটি সুভেনির শপ বন্ধ হয়ে গেছে৷ বার্সেলোনা শহর কর্তৃপক্ষের আলভ্যার্ট সিভিট বলেন, ‘‘ভুল তথ্য দিয়ে দোকান খোলা হয়৷ যা বলে, তা বিক্রি করে না৷ ধীরে ধীরে সুভেনির শপে পরিণত হয়৷ তাই আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে, যাতে এমনটা না হয়৷''
শহর কর্তৃপক্ষের উপর ফ্যারনান্দো লাস্ত্রা, ফ্রানসিস্কো বোয়েরা সহ প্রতিবেশীদের তেমন আস্থা নেই৷ তাঁরা জানেন, ‘সাগরাদা ফামিলিয়া' চত্বরের আশেপাশে অনেক বাড়ি ভেঙে ফেলার কথা৷ গির্জা ও দর্শকদের আপ্যায়ন কেন্দ্র আরও বাড়ানো হবে৷ আদি বাসিন্দাদের সরে যেতে হবে৷ ফ্রানসিস্কো বোয়েরা বলেন, ‘‘জীবনের একটা বড় অংশ আমরা এখানেই কাটিয়েছি৷ এই এলাকায় অনেক স্মৃতি রয়েছে৷ কাছেই এখনকার মতো কোনো বিকল্প বাসা পাবো কিনা জানি না৷ না পাবারই কথা৷ ৪০, ৬০, ৭০ বছর ধরে আমরা যা কিছু গড়ে তুলেছি, সে সব হারাবো৷''
শহর কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা স্থানীয় বাসিন্দাদের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে৷ অতিথিরা সম্ভবত তার কিছুই টের পাবেন না৷ হয়ত বুঝবেন, যে ‘সাগরাদা ফামিলিয়া' চত্বরে স্পেনের নিজস্ব জীবনধারার ছাপ কমে যাচ্ছে৷ সেই জাদু সম্ভবত হারিয়ে যাবে৷