বাংলাদেশের উপকূলের জেলেরা সম্প্রতি অভিযোগ করছেন যে তারা নদী ও সমুদ্রে পর্যাপ্ত ইলিশ মাছ পাচ্ছেন না৷ বিশেষজ্ঞরা এর জন্য অবৈধ ও অতিরিক্ত মাছশিকারের পাশাপাশি পরিবেশগত কয়েকটি কারণকেও দুষছেন৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের উপকূল থেকে ফিরে আরো জানাচ্ছেন যুবায়ের আহমেদ৷
বাংলাদেশের মাছের যোগানের একটা বড় অংশ আসে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে৷ কিন্তু মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনার জেলেরা অভিযোগ করছেন যে তারা আগের মত মাছ পাচ্ছেন না৷
৫০ বছর বয়সি মোহাম্মদ বাবুল তাদের একজন৷ তিনি মোহনায় জাতীয় মাছ ইলিশ ধরেন৷ দেশটির মাছ উৎপাদনের বড় অংশের যোগান আসে ইলিশ থেকে৷
তিনি বলেন, ‘‘আগে ঠিকমতো মাছ পেতাম৷ কিন্তু গেল তিন মৌসুম ধরে মাছ পাচ্ছি না৷ আগে বছরে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার মাছ পেতাম৷ এখন দুই লাখ টাকার মাছ পেতেই খবর হয়ে যায়৷ কারণ গাঙে মাছ নেই৷''
এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বাবুল ডয়চে ভেলেকে নিয়ে যান বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা নতুন এক চরে৷ স্থানীয় এক জেলের নামানুসারে তারা এই চর ডাকেন ‘বশিরের চর' বলে৷ তার ধারণা, এই চরের কারণেই মাছ চলাচল করে নদীর দিকে আসতে পারছে না৷ বলেন, বঙ্গোপসাগরের মোহনায় এমন বেশ কয়েকটি চর জেগেছে৷
‘‘এই চরগুলো একেবারে বাঁধের মতো জেগে উঠেছে৷ তাই মাছ সমুদ্র থেকে আমাদের এলাকার দিকে আসতে পারছে না৷ তাই আমরা খুব কম মাছ পাই৷ গেল কয়েক বছরে এই চরগুলো একেবারে এলোমেলোভাবে জেগে উঠেছে,'' বলেন বাবুল৷
বাংলাদেশে ইলিশ কমছে?
04:09
নদীমাত্রিক দেশটি এখন বছরে ৪৫ লাখ টন মাছ উৎপাদন করে৷ এর অর্ধেকেরও বেশি আসে চাষ থেকে৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি উপকূলে মাছের যোগানে ভাটা পড়েছে, বিশেষ করে ইলিশের মত পরিযায়ী মাছের৷ ওয়ার্ল্ড ফিশের হিসেবে, ২০১৯ সাল থেকে ইলিশ উৎপাদনের হার কমছে৷ এ সময় লক্ষ্য ছিল ছয় লাখ টন ইলিশ উৎপাদনের৷ কিন্তু তা সাড়ে পাঁচ লাখ টনের বেশি হচ্ছে না৷
‘‘অনেকগুলো ছোট চর জেগে উঠেছে৷ এগুলো সাময়িক হবার কথা থাকলেও, ইদানিং আমরা দেখছি চরগুলো গড়ছেই বেশি, ভাঙছে কম৷ মাছের গতিপথ ছোট হয়ে আসছে৷ নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে আসছে,'' বলেন ওয়ার্ল্ড ফিশের বিশ্লেষক ড. আবদুল ওয়াহাব৷
তিনি বলেন, ইদানিং মাছের অভিপ্রয়ানের সময় নদীর তাপমাত্রাও বেশি হচ্ছে৷ তবে এসব ফ্যাক্টর নিয়ে আরো গবেষণার দরকার আছে বলে মনে করেন তিনি৷
এদিকে, সমুদ্রের মাঝে মাছের খোঁজে থাকা বাবুল এসব বিজ্ঞান বোঝেন না৷ যেটা বোঝেন তা হলো, হয়তো আজও তাকে অল্প শিকারেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে৷
২০১৫ সালের গ্যালারিটি দেখুন :
ইলিশ রক্ষায় বিশ্বের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ
ইলিশকে বাংলাদেশে ‘মাছের রাজা’ হিসেবেই মানেন সবাই৷ দেশের বাইরেও পদ্মার ইলিশের অনেক কদর৷ সেই ইলিশ হারাতে বসেছিল বাংলাদেশ৷ তবে সুদিন আবার ফিরছে৷ উৎপাদন বাড়ছে৷ ইলিশ উৎপাদনে সারা বিশ্বের জন্যই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ৷
ঈদ, পুজো, পহেলা বৈশাখ- উৎসব ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক যে ধরণেরই হোক না কেন, ইলিশ ছাড়া কিন্তু বাঙালির ভোজন জমে না৷
ছবি: Imago/Z.H. Chowdhury
ইলিশে বসতি বাণিজ্য
সরকারি হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে ইলিশের অবদান ১ শতাংশ৷ আর দেশের মোট মাছের ১১ শতাংশই ইলিশ৷ বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ জেলে আছেন৷ এছাড়াও প্রায় ২০ লাখ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস ইলিশ৷ মাছ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬৫ শতাংশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে৷
ছবি: Imago/UIG
ইলিশ থেকে ওষুধ
ইলিশ খুব তেলতেলে মাছ৷ সম্প্রতি সেই তেলেরও বিশেষ এক গুণের কথা জানা গেছে৷ জানা গেছে, ইলিশ মাছে যে ‘ওমেগা-৩’ ধরনের তেল আছে, তা দিয়ে ওষুধ তৈরি করা যায়৷ হৃদরোগসহ বেশ কিছু রোগ সারানোয় ভূমিকা রাখতে পারে এই ওষুধ৷ ইতিমধ্যে ইলিশের তেল থেকে ওষুধ তৈরি করা শুরু করেছে বেশ কিছু দেশ৷
ছবি: Imago/Z.H. Chowdhury
দুঃসময়ের পদধ্বনি...
ইলিশের দুর্দিন মানে ভোজনরসিকদের দুর্ভাবনা৷ ইলিশ কমতে শুরু করায় বাংলাদেশও পড়েছিল দুর্ভাবনায়৷ তার প্রভাব এমন কিছু দেশে পড়েছিল যেসব দেশের মানুষ পদ্মার ইলিশের জন্য মুখিয়ে থাকে৷ বাংলাদেশ, ভারত বা শুধু এশিয়ার হাতে গোনা কয়েকটি দেশ নয়, ইউরোপ-অ্যামেরিকাতেও ইলিশ আজকাল পাতে উঠছে৷ যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড ও ইউরোপের কিছু দেশে ইলিশের স্যুপের জনপ্রিয়তা দিনদিন বাড়ছে৷
ছবি: Imago/UIG
সংকটের কারণ...
ইলিশ কমতে শুরু করেছিল মূলত দুটি কারণে৷ এক, অতিরিক্ত মাত্রায় মা ও জাটকা ইলিশ ধরা; দুই, ব্যাপক পরিবেশ দূষণ৷ শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশেই ইলিশ কমতে শুরু করেছিল৷ তবে খুশির কথা, ইলিশ রক্ষায় বাংলাদেশ বিশ্বের অন্য সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Chowdhury
ইলিশ রক্ষায় পদক্ষেপ
২০০২ সালের পর থেকে ইলিশ রক্ষায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ৷ ডিম পাড়া ও বিচরণের স্থান চিহ্নিত করা, বছরের আট মাস জাটকা ধরা এবং ডিম পাড়ার ১৫ দিন সব ধরনের ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করার সুফল এখন পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ৷ জেলেদের প্রতিও দেয়া হয়েছে বিশেষ মনযোগ৷ ইলিশ ধরেন এমন জেলেদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২ লাখ ২৪ হাজার জনকে পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাড়ছে ইলিশ, আসছে সুফল
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ইলিশের দুর্দিন অনেকটাই কেটে গেছে৷ ইলিশ ধরা বেড়েছে, পাশাপাশি ইলিশও বাড়ছে৷ মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও বঙ্গোপসাগর থেকে ২০০৯-১০ মৌসুমে দুই লাখ টন ইলিশ ধরা হয়, ২০১৪ সালে তা বেড়ে হয়ে যায় ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন, ২০১৫, অর্থাৎ চলতি বছর চার লাখ টন ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশা করছে মৎস্য অধিদপ্তর৷
ছবি: Imago/UIG
বাংলাদেশ সবার কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
ওয়ার্ল্ড ফিশ-এর পর্যবেক্ষণ বলছে, সারা বিশ্বে মূলত যে ১১টি দেশে ইলিশ হয় সেগুলোর মধ্যে ১০টিতেই ইলিশ কমছে, শুধু বাংলাদেশেই লক্ষণীয় মাত্রায় উৎপাদন বাড়ছে৷ বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির হার বছরে শতকরা ৮ থেকে ১০ শতাংশের মতো৷ ফলে ইলিশ রক্ষায় অনেক দেশের কাছেই বাংলাদেশ এখন ‘রোল মডেল’৷