পলাশকে কি কারাগারে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে?
৭ মে ২০১৯গত ২৬ এপ্রিল সকালে পঞ্চগড় জেলা কারাগারে পলাশ অগ্নিদগ্ধ হন৷ ৩০ এপ্রিল দুপুরের দিকে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান৷ এর আগে ২৫ মার্চ পঞ্চগড়ে একটি মানববন্ধন থেকে তাঁকে আটক করে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছিল৷ তিনি সেখানেই ছিলেন৷ অগ্নিদগ্ধ হওয়ার দিনই তাঁকে আরেকটি মামলায় হাজিরার জন্য ঢাকা পাঠানোর কথা ছিল৷
পলাশ মৃত্যুর আগে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে একটি বক্তব্য দিয়ে গেছেন৷ তাতে তিনি বলেছেন, ‘‘কারাগারের ভিতরে দু'জন লোক তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়৷'' মৃত্যুর আগে পলাশের এই বক্তব্য রেকর্ড করেছেন তাঁর ভাগ্নে প্রসেনজিৎ কুমার রায়৷
বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্ত আইনজীবী পলাশ কুমার রায় ঢাকায় কোহিনুর কেমিক্যাল কোম্পানির আইন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন৷ তাঁর গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলায়৷ বাবা প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা প্রণব কুমার রায়৷ মা সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মীরা রানি রায়৷ পলাশ নিজে এবার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যায়৷
মীরা রানি রায় ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘২০১৬ সালে কোহিনুর কেমিক্যাল কোম্পানি তাঁকে চাকরিচ্যুত করে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দেয়৷''
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাঁর বিরুদ্ধে ৩১ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলা হয়েছিল ঢাকায়৷ ওই মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গত ২৫ মার্চ দুপুরে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে পরিবারের লোকজন নিয়ে অনশন করেন পলাশ৷ পরে শহরের শের-ই-বাংলা পার্ক সংলগ্ন মহাসড়কে গিয়ে মানববন্ধন করেন৷ তিনি সেখানে হ্যান্ড মাইকে বক্তব্য দেন৷ বক্তব্যে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কিরুদ্ধে কটুক্তি করেছেন– এই অভিযোগে সেখান থেকে পুলিশ তাঁকে আটক করে এবং রাজীব রানা নামে একজন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন৷ ওই মামলায় কারাগারে পাঠানো হয় তাঁকে৷
মীরা রানি রায় জানান, ‘‘এরপর কয়েকবার জামিনের আবেদন করলেও তাঁর জামিন হয়নি৷ ২৬ এপ্রিল কারাগারে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমি জানতে পারি, সে অগ্নিদগ্ধ হয়েছে৷ কিন্তু আমাকে জানানো হয়নি৷ আমি পঞ্চগড় সদর হামপাতালে যাই৷ সেখানে আমাকে বাধা দেয়া হয়৷ এরপর তাকে রংপুর কারাগারে পাঠানো হয়৷ রংপুর কারাগার তাকে রংপুর হাসপাতালে ভর্তি করে৷ সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়৷ আমি বারবার বলার পরও তার চিকিৎসার অবহেলা করা হয়৷ তার শরীরের ৪০ ভাগ পুড়ে গিয়েছিল৷ আমি জেলারকে বলেও তার দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারিনি৷ আমার ছেলে হাত উঁচিয়ে আমাকে বারবার দু'টি আঙুল দেখিয়েছে আর মুখে দুই জন, দুই জন বলার চেষ্টা করেছে৷''
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘জেলে থাকা অবস্থায় কিছু লোক আমার ছেলের সাথে দেখা করে তাকে হুমকি দিয়েছে৷ তারা তার ছবিও তুলে নিয়ে গেছে৷ এছাড়া কোহিনুর কেমিক্যাল কোম্পানির লোকজন আমার ছেলের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে লোক পাঠিয়েছিল৷ আমার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে কারাগারের ভিতরে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে৷''
পঞ্চগড় জেলা কারাগারের জেলার মুশফিকুর রহমান পলাশের মায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাথরুমে গিয়ে পলাশ লাইটার দিয়ে নিজের শরীরে নিজেই আগুন দিয়েছে৷ পলাশ সিরোসিসে ভোগার কারণে আমরা তাঁকে কারা হাসপাতালে রেখেছিলাম৷ বাথরুমটি হাসপাতালের পাশেই, বাইরে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সে শরীরে আগুন লাগা অবস্থায় বাথরুম থেকে বের হয়৷ কারাগারের লোকজন আগুন নেভায়৷''
বাথরুমে পলাশকে লাইটার দিয়ে নিজের শরীরে আগুন দিতে কেউ দেখেছে কিনা এবং কিভাবে দেখলো তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘না, আমি শুনেছি৷ কেউ দেখেনি৷ ধারণা থেকে বলছি৷''
তিনি জানান, ‘‘ওইদিন তাঁকে ঢাকায় পাঠানোর কথা ছিল৷ ঢাকায় কোহিনুর কেমিক্যাল কোম্পানির দায়ের করা অর্থ আত্মসাতের একটি মামলায় ২৮ এপ্রিল তাঁর হাজিরার তারিখ ছিল৷''
তিনি আরো দাবি করেন, ‘‘পলাশের চিকিৎসায় কোনো দেরি আমরা করিনি৷ যেহেতু কারাগারের বিষয়, তাই সব কিছু কারাবিধি অনুযায়ী করতে হয়েছে৷ আমরা দ্রুততার সঙ্গে পরদিনই তাঁকে ঢাকা মেডিক্যালে পাঠিয়েছি৷''
এই ঘটনায় সোমবার হাইকোর্টে বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করে রিট করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার ছায়েদুল ইসলাম সুমন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘তিনি কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন৷ পরে মারা গেছেন৷ এটা কারা কর্তৃপক্ষের দায়৷ আর তিনি মারা যাওয়ার আগে যে বক্তব্য দিয়ে গেছেন, তাতে তিনি বলেছেন, দু'জন লোক তাঁর গায়ে কোরোসিন ছুড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে৷ আমরা এটাকে হত্যাকাণ্ডই বলছি৷ আমরা এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছি৷ আজ (মঙ্গলবার) রিটের আংশিক শুনানি হয়েছে৷''
ওই অডিও রেকর্ডটি ডয়চে ভেলের হাতেও এসেছে৷ অডিওতে পলাশ বলেছেন, ‘‘২০১৩ সালে তিনি কোহিনুর কেমিক্যাল কোম্পানিতে আইন কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন৷ এরপর তাঁকে সরকারি জমি দখলসহ নানা অবৈধ এবং অনৈতিক কাজ করতে বলা হয়৷ কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি৷ ২০১৬ সালে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন৷ এরপর তাঁর বিরুদ্ধে ৩১ লাখ টাকা আত্মসাতের মিথ্যা মামলা দেয়া হয়৷ গত ২৫ মার্চ পঞ্চগড়ে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কটুক্তির আরেকটি মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়৷ কারাগারে গিয়ে তাঁকে কয়েক দফা হুমকি দেয়া হয় এবং তার ছবি তোলা হয়৷ তিনি জেলারকে বিষয়টি জানালেও জেলার বিষয়টি আমলে নেননি৷ এরপর ২৫ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে টাইগার (এক ধরনের এনার্জি ড্রিংক)-এর বোতল থেকে দু'জন লোক কী যেন ছুড়ে দিয়ে আমার গায়ে আগুল লাগিয়ে দেয়৷''
৩০ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা মেডিক্যালে মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে এই বক্তব্য দেন পলাশ৷ আর তাঁর বক্তব্য মোবাইল ফোনে রেকর্ড করেন তাঁর ভাগ্নে প্রসেনজিৎ কুমার রায়৷ প্রসেনজিৎ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তখন তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল৷ আমরা ভাবিনি তিনি মারা যাবেন৷ তিনি কী মনে করে যেন আমাকে বললেন, তোমার মোবাইলে রেকর্ড হয়? আমি কিছু কথা বলতে চাই৷ এরপর তিনি বললেন এবং আমি আমার মোবাইল ফোনে তাঁর কথা রেকর্ড করি৷ তার আধা ঘণ্টা পর তিনি মারা যান৷''
এ বিষেয়ে কোহিনুর কেমিক্যাল কোম্পানির বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি৷ প্রতিষ্ঠাননটির প্রধান কার্যালয়ের রিসিপশন থেকে তুহিন নামে একজন বলেন, ‘‘এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কেউ অফিসে নেই৷ আর উনি আমাদের এখানে এখন চাকরি করেন না৷''
এদিকে পলাশের মৃত্যুর ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি৷ পঞ্চগড় সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু আক্কাস আহমেদ বলেন, ‘‘আমার থানায় তাঁর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে কটুক্তির মামলা আছে৷ মারা যাওয়ার পর কেউ মামলা করেনি৷ আর সে তো ঢাকায় মারা গেছে, মামলা হলে সেখানে হবে৷''
নিহত পলাশ কুমার রায়ের মা বলেন, ‘‘আমরা এখনো মামলা করিনি৷ কিভাবে কী করব বুঝে উঠতে পারছি না৷''