মাংস খেতে পছন্দ করলেও তার জন্য প্রাণিহত্যা মানতে মন চায় না৷ কিন্তু জীবিত প্রাণীর মাংস খেতে কেমন লাগবে? নেদারল্যান্ডসের গবেষকরা সেই দিশায় অগ্রসর হচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
গরুর মাংস দিয়ে তৈরি বার্গার, কিন্তু সেই গরু দিব্যি জীবিত রয়েছে৷ এদিকে বার্গারের মাংসের টুকরো ভাজার শব্দ হচ্ছে৷ সেটা কী করে সম্ভব?
নেদারল্যান্ডসের মাসত্রিখট বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্ক পস্ট সেই অসাধ্য সাধন করেছেন৷ অনেক বছর ধরে তিনি প্রাণীহীন মাংস নিয়ে কাজ করছেন৷ গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকেই নেদারল্যান্ডসে গবেষকরা স্টেম সেল থেকে মাংস তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ সেল কালচার আধারেই পেশির মাংস সৃষ্টি তাঁদের লক্ষ্য৷ মার্ক পস্ট এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন৷
২০১৩ সালে তিনি প্রথম ‘নিষ্পাপ' হ্যামবার্গার পরিবেশন করেন৷ কোনো কৃত্রিম পদার্থ নয়, আসল মাংস দিয়ে তৈরি৷ গরুর স্টেম সেল থেকে ল্যাবে সেই মাংস সৃষ্টি করা হয়েছে৷ মূল্য তিন লক্ষ ডলার৷ হাতে গোনা যে কয়েকজন তা চেখে দেখার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁদের মতে স্বাদ একেবারে আসল হ্যামবার্গারের মতো৷
জার্মানির খাদ্য কেলেঙ্কারি
ডিম থেকে ঘোড়ার মাংস, স্ট্রবেরি থেকে সবজি, জার্মানির বিভিন্ন দোকানে ছড়িয়ে থাকা খাদ্য সামগ্রীর কোনোটিই খুব নিরাপদ নয়৷ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা এসব খাদ্যের পিছনে রয়েছে নানারকম চক্র৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Huisman Media
বিষাক্ত ডিম
জার্মানির বাজারে এসেছিল অসংখ্য ডিম, গবেষকেরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, সেই ডিমে ব্যবহার করা হয়েছে বিষাক্ত কীটনাশক, যা লিভার এবং থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের ক্ষতি করতে পারে৷ নেদারল্যান্ডস থেকে এসেছিল সেই ডিম৷ জার্মানিতে ওই পরীক্ষার পর নেদারল্যান্ডসের প্রায় ১৫০টি পোলট্রি রাতারাতি বন্ধ করে দেওয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Huisman Media
ব্রাজিলের গরুর মাংস
২০১৭ সালের শেষের দিকে ইউরোপের বহু দেশ ব্রাজিল থেকে গরুর মাংস রপ্তানি বন্ধ করে দেয়৷ তবে ততদিনে অবশ্য জার্মানির বাজার ভরে গিয়েছে ওই মাংসে৷ অভিযোগ, ওই মাংস ঠিকভাবে প্যাকেজ না করায় পচে গিয়েছে৷কিন্তু গন্ধ আটকানোর জন্য এক ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছিল সেই মাংসে৷ জার্মানির বহু মানুষ সেই মাংস খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন৷
ছবি: Picture alliance/NurPhoto/C. Faga
রুটিতে ইঁদুর
জার্মান পুলিশ তদন্ত করে দেখে যে, বাভারিয়ার বিভিন্ন বেকারিতে প্রচুর ইঁদুর৷ অথচ ওই সমস্ত বেকারি থেকে সারা বছর বিপুল সংখ্যক রুটি পাঠানো হয় দেশের অন্যান্য অঞ্চলে৷ বহু রুটিতে ইঁদুরের কামড়েরও চিহ্নও পাওয়া যায়৷ বহু বেকারির তেলে পাওয়া যায় ছত্রাক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Knecht
ক্ষতিকর ঘোড়ার মাংস
জার্মানির বহু দোকানে দেখা যায়, ‘রেডি টু ইট’ প্যাকেটের বার্গারে গরুর মাংস বলে চালানো হচ্ছে ঘোড়ার মাংস৷ এবং সেই মাংসের গুণাগুণ নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন ওঠে৷ অনেকেই বলেন, যে ঘোড়ার মাংস গরুর মাংস বলে চালানো হচ্ছে, তা আসলে স্বাস্থ্যকর নয়৷ জার্মানি এবং আয়ারল্যান্ডে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ তদন্ত শুরু হয়৷
ছবি: Reuters
স্ট্রবেরিতেও ভরসা নেই
২০১২ সালে জার্মানির প্রায় ১১ হাজার স্কুল ছাত্র অসুস্থ হয়ে পড়ে৷ জানা যায়, তাদের সকলেই একইরকম প্যাকেটের ফ্রোজেন স্ট্রবেরি খেয়েছিল৷ তদন্ত করে দেখা যায়, সেই স্ট্রবেরিগুলি ঠিকভাবে প্যাকেজ না করায় বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল৷ শেষ পর্যন্ত স্কুল ছাত্ররা দ্রুত সুস্থ হয়ে গেলেও ফ্রোজেন ফল খাওয়ার বিষয়ে আতঙ্ক এখনো রয়ে গিয়েছে৷
ছবি: Mehr
খাবারে ডাইঅক্সিন
কিছুদিন আগে জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনি অঞ্চলে বেশ কিছু ফার্ম বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ অভিযোগ, ওইসব ফার্মে তৈরি করা হতো মুরগি এবং শুয়োরের খাবার, যার মধ্যে বিপুল পরিমাণ ডাইঅক্সিন জাতীয় রাসায়নিক ব্যবহার করা হতো৷ সেই খাবার খাওয়া মুরগির ডিম বা মাংসও ডাইঅক্সিনে ভরে থাকতো৷
ছবি: picture alliance / ZB
সবজিতে সংক্রমণ
সবজির মধ্যেও এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গিয়েছে, যার কারণে উত্তর জার্মানির বহু মানুষঅসুস্থ হয়ে পড়েন৷ রক্ত আমাশা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় ৪ হাজারেরও বেশি মানুষকে৷ কিডনির অসুখও দেখা দেয়৷ কিছু কিছু সবজির বিক্রি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়৷
টিস্যু থেকে স্টেম সেল নিষ্কাশন করা হয়৷ তারপর তা পুষ্টিকর দ্রব্যের মধ্যে বেড়ে উঠে বংশবৃদ্ধি করে৷ গরুর শরীরের মধ্যে ঠিক যেমনটা ঘটে৷ পেশির আসল তন্তুও সৃষ্টি হয়৷ আসল মাংসের মতো বৈশিষ্ট্য আনতে সেই তন্তুকে যান্ত্রিক ও ইলেকট্রিক স্পন্দন দিয়ে মূল পেশির মতো পরিশ্রম করানো হয়৷ মার্ক পস্ট বলেন, ‘‘গরু আল্পস পর্বত বা অন্য কোথাও মাঠে চড়ে বেড়ায়৷ তাই তার পেশি সজাগ রাখতে হয়৷ স্নায়ুর কোষের মাধ্যমে ইলেকট্রিক উত্তেজনাই আসলে পেশিকে সজাগ রাখে৷ আমরা এখানে সেই স্টিমুলেশন নকল করছি৷''
ল্যাবে তৈরি মাংসে মসলাপাতি ও রং যোগ করা হয়৷ মাংসের মৌলিক স্বাদ আনতে চর্বির কোষও যোগ করা হয়৷ সেই কোষও ল্যাবেই তৈরি৷ ল্যাবে তৈরি সেই মাংসের অবশ্য কোনো কাঠামো নেই৷ তবে এখনো পর্যন্ত সেটি দিয়ে শুধু কিমা বানানো যায়৷
মার্ক পস্ট এর মধ্যে স্টেম সেলের বংশবৃদ্ধির জন্য জীবন্ত প্রাণীর শরীর থেকে পেশির তন্তু সংগ্রহ করছেন৷ ল্যাবে সেই মাংস তৈরির প্রক্রিয়ায় প্রাণীদের কষ্ট পুরোপুরি দূর করা এখনো সম্ভব হয়নি৷
যে পুষ্টিকর দ্রব্যের মধ্যে কোষ গড়ে ওঠে, তার উপকরণ হলো বাছুরের সিরাম, যা গরুর ভ্রুণের হ্রদযন্ত্রের রক্ত থেকে পাওয়া যায়৷ সেই প্রক্রিয়ায় জন্মের আগেই বাছুরের মৃত্যু হয়, গর্ভবতী গরুকেও জবাই করতে হয়৷
এমন কষ্ট এড়াতে মার্ক পস্ট তাই বাছুরের সিরামের বিকল্প খুঁজছেন৷ অ্যালজি বা সামুদ্রিক উদ্ভিদের মধ্যে কিছু পদার্থ এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় হতে পারে৷
উৎপাদনের ব্যয়ও এর মধ্যে অনেকটা কমে গেছে৷ আজ ল্যাবে তৈরি বার্গারের মূল্য ১০ ইউরোর মতো৷ তবে একমাত্র বিশাল মাত্রায় উৎপাদন করলেই সেটা সম্ভব৷ কিমার ক্ষেত্রে বর্তমানে সেটাই ঘটছে৷ কিন্তু গবেষকরা এখনো সেই লক্ষ্য পূরণ থেকে অনেক দূরে রয়েছেন৷
মাংস উৎপাদন খারাপ, নাকি ভালো?
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বর্তমানে ‘ভেগানিজম’ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷ ভেগানরা পরিবেশের কথা মাথায় রেখেই মাংস বা পশু থেকে উৎপাদিত কোনো খাবার খান না৷ কিন্তু আসলে মাংস উৎপাদন এবং ভক্ষণ পৃথিবীর জন্য কতটা খারাপ?
ছবি: picture-alliance/dpa/I. Wagner
শিল্পোন্নত দেশের মানুষ বেশি মাংস খায়
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানিয়েছে, ২০১৫ সালে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ (মাথাপিছু) গড়ে মাংস খেয়েছে ৪১.৩ কেজি৷ অথচ ৫০ বছর আগে এর অর্ধেক মাংস খাওয়া হতো৷ গত বছর উন্নয়নশীল দেশে যেখানে মাথাপিছু ৩১.৬ কেজি মাংস খাওয়া হয়েছে, শিল্পোন্নত দেশে খাওয়া হয়েছে ৯৫.৭ কিলোগ্রাম৷
ছবি: China Photos/Getty Images
উৎপাদনে পানি খরচ
মাংস উৎপাদন একটি ব্যয়বহুল ব্যবসা৷ এতে অর্থ, সময় ও সম্পদ খরচ হয়৷ এক কেজি গরুর মাংস উৎপাদনে ১৫,৪১৫ লিটার পানি লাগে৷ এক কেজি শুকরের মাংস উৎপাদনে লাগে ৬ হাজার লিটার পানি৷ অন্যদিকে সবজি, যেমন আলু উৎপাদনে ১ কেজিতে খরচ হয় ৩০০ লিটার পানি৷ অন্যদিকে ধান উৎপাদনে প্রতি কেজিতে খরচ হয় ২,৫০০ লিটার পানি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P.Pleul
গরু ও মুরগির খাদ্য
ওয়ার্ল্ড ওয়াচ ইনস্টিটিউটের মতে, বিশ্বের উৎপাদিত প্রতি ৫ টন শস্যের মধ্যে ২ টন পোলট্রি বা মাছের খামারে যায়৷ অন্যদিকে, গুরুর মাংস উৎপাদনের জন্য এত খাদ্য ব্যয় হয় না৷ ঘাস খেয়েই এদের অনেকটা চাহিদা পূরণ হয়৷
ছবি: Norberto Duarte/AFP/Getty Images
উজাড় হচ্ছে বন
প্রাণী খাদ্যের জন্য বন উজাড় হচ্ছে সবচেয়ে বেশি৷ গাছ কেটে গরু চারণ ক্ষেত্র বা কৃষিক্ষেত্র বাড়ানো হচ্ছে৷ ফলে জীববৈচিত্র হারিয়ে যাচ্ছে৷ সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা৷
ছবি: Kate Evans / Center for International Forestry Research (CIFOR)
বিষাক্ত মিথেন
কার্বন নিঃসরণে কৃষির ভূমিকা রয়েছে ১১ থেকে ১৫ ভাগ৷ অন্যদিকে, গরুর ঢেঁকুর বা ‘গ্যাস’ থেকে যে মিথেন উৎপন্ন হয়, তা কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে ২০ গুণ বিষাক্ত ও ক্ষতিকর৷
ছবি: DW/C.Lomas
5 ছবি1 | 5
তাছাড়া শুধু পস্ট ও তাঁর টিম নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরাও ল্যাবে মাংস তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছেন৷ ‘মেম্ফিস মিটস' নামের এক স্টার্টআপ কোম্পানির এরিক শুলৎসে পস্টের আইডিয়া বড় আকারে কার্যকর করতে চান৷ তিনি বিশাল আকারের সুপারট্যাংক তৈরি করে সেখানে সেল কালচার করতে চান৷ বিয়ার তৈরির প্রক্রিয়ার মতোই মাংস উৎপাদন করতে চান শুলৎসে৷ এরিক বলেন, ‘‘শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও এটা পুরোপুরি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া৷ তাতে শুধু গরুর প্রয়োজন পড়ে না৷''
একটি ট্যাংকে উৎপাদিত মাংস খেয়ে প্রায় ৪০,০০০ মানুষের পেট ভরবে বলে দাবি করা হচ্ছে৷ তবে এখনো পর্যন্ত সেই মাংসের মান মোটেই সন্তোষজনক নয়৷ তাছাড়া কিমার ছোট গোলকগুলির মূল্য এখনো ৬,০০০ ডলার৷
শিল্পক্ষেত্রে এখনো ল্যাবে তৈরি মাংসের বিষয়ে যথেষ্ট উৎসাহ রয়েছে৷ জার্মানিতে মুরগির মাংস কোম্পানি ভিসেনহোফ চলতি বছর থেকে ল্যাবে মুরগির মাংস উৎপাদন সংক্রান্ত গবেষণায় বিনিয়োগ করছে৷
আমরা কি অদূর ভবিষ্যতে ল্যাবে তৈরি চিকেন নাগেটস খেতে চলেছি? গবেষকদের ধারণা, ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে এ ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে৷ কিন্তু এই মুরগিছানাগুলি সে দিন দেখে যেতে পারবে না৷