পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে অনেক হিসাবই বদলে যেতে পারে। বিহারের মতো বহু আসনে খুব কম ভোটে জিততে পারেন প্রার্থীরা।
বিজ্ঞাপন
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের ধারণা ছিল, সদ্য সমাপ্ত বিহার নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী মহাজোট জয়লাভ করবে। বাস্তবে তা হয়নি। অত্যন্ত কম ব্যবধানে জয়ী হয়েছে জেডিইউ এবং বিজেপির জোট। পশ্চিমবঙ্গের ভোট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ মনে করছেন, এখানেও একই ঘটনা ঘটবে। বহু আসনে অত্যন্ত কম ব্যবধানে প্রার্থীদের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। উল্টে জেতে পারে যাবতীয় ভোট পূর্বের হিসাবনিকাশ।
২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় বহু আসনে হাজারেরও কম ভোটে প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও সেই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। ভোট বিশেষজ্ঞ বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর মতে, ''প্রথম তিন দফার নির্বাচনে যা দেখা গেছে, তাতে স্পষ্ট অনেক হিসেব এদিক ওদিক হবে। যুযুধান প্রার্থীদের মধ্যে যে ভাবে লড়াই হচ্ছে, তাতে শেষ পর্যন্ত জল কোন দিকে গড়াবে, তা অনেক জায়গাতেই বোঝা যাচ্ছে না। খুব কম মার্জিনে এবার অনেক আসন বের হবে।'' বিশ্বনাথবাবু মনে করছেন, বিহারের মতোই পশ্চিমবঙ্গেও ফলাফল ঘোষণার দিন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
উত্তরবঙ্গে ভোটের মুখ
আগামী ১০ তারিখ থেকে উত্তরবঙ্গে ভোট শুরু হবে। লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের ৫৪টি বিধানসভা আসনে বিজেপি বেশ ভালো ফল করেছিল। এবারও কি তারা তা পারবে? কী হতে পারে তৃণমূলের ফলাফল?
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
দার্জিলিং মানেই গুরুং
পাহাড়ের ভোটে এবার সকলের নজর বিমল গুরুংয়ের দিকে। সাড়ে তিন বছর পালিয়ে থাকার পরে আবার তিনি পাহাড়ে ফিরেছেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রয়েছে। তা সত্ত্বেও পাহাড়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রতিষ্ঠাতাকে সমর্থন করছে তৃণমূল। এর আগে গুরুংয়ের সাহায্যে পাহাড়ে জয় পেয়েছিল বিজেপি।
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
বিনয় কড়া প্রতিপক্ষ
গুরুংকে কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার সমানে ফেলেছেন বিনয় তামাং। গুরুং পালিয়ে যাওয়ার পরে বিনয়ের ক্ষমতা বাড়ে পাহাড়ে। এক সময় গুরুংয়ের সতীর্থ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা(বিনয়) তৈরি করেছেন দার্জিলিংয়ে। বিনয়কেও সমর্থন করছে তৃণমূল।
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
অশোক দূর্গ
গোটা পশ্চিমবঙ্গে যখন বামেদের ভোট তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, তখন শিলিগুড়িতে বাম দূর্গ ধরে রেখেছেন প্রবীণ সিপিএম নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। তিনি শিলিগুড়ির মেয়রও ছিলেন। এবারেও কি নিজের জমি বাঁচাতে পারবেন তিনি?
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
গৌতম ম্যাজিক
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী গৌতম দেব। উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা। কিন্তু গত কয়েক বছরে উত্তরবঙ্গে বিজেপির দ্রুত উত্থানে তিনিও এখন আর খুব নিশ্চিন্তে নেই। গৌতম দেব কি জিততে পারবেন এবারের নির্বাচনে?
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
নিশীথ ঝড়
এক সময় তৃণমূলে ছিলেন কোচবিহারের নেতা নিশীথ প্রামাণিক। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। বছরকয়েক আগে তৃণমূল তাকে বহিষ্কার করে। নিশীথ পালিয়ে যান। বলিউডের সিনেমার মতো সঙ্গে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তা নিয়ে তিনি ফিরে আসেন লোকসভা ভোটের মুখে। বিজেপি তাকে কোচবিহারে প্রার্থী ঘোষণা করে। সেই নিশীথ এখন সাংসদ। বিধানসভা ভোটে তিনি দলকে জেতাতে পারবেন?
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
কৃষ্ণেন্দুর লড়াই
এক সময় কংগ্রেসের ডাকসাইটে নেতা কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী এখন তৃণমূলে। মালদহের এই নেতার বিরুদ্ধে বেনিয়মের অভিযোগ যেমন আছে, তেমন মানুষের ভালোবাসাও আছে। অসাধ্য সাধন আগেও করেছেন কৃষ্ণেন্দু। কঠিন সময়ে মালদহের ইংরেজবাজারের মতো কঠিন আসনে জিততে পারলে কৃষ্ণেন্দুর ক্ষমতা দলের ভিতর অনেকটা বেড়ে যাবে।
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
অধীর চৌধুরীর শক্তি
টেকনিক্যালি অধীর চৌধুরী উত্তরবঙ্গের নেতা নন। উত্তরবঙ্গে এবং দক্ষিণবঙ্গের সীমানায় মুর্শিদাবাদ। অধীর সেখানকার বাদশাহ। কিন্তু লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা এখন গোটা পশ্চিমবঙ্গেই কংগ্রেসের হাল ধরেছেন। উত্তরবঙ্গে কংগ্রেসের ফলাফলও খানিকটা নির্ভর করছে তার উপর।
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
আব্বাস সিদ্দিকি
উত্তরবঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকি খুব বেশি আসন দিতে পারেননি। কিন্তু উত্তরবঙ্গের মুসলিম ভোট কোন দিকে যাবে, তা খানিকটা হলেও নির্ভর করছে আব্বাস সিদ্দিকি এবং তার দলের কর্মীদের উপর। উত্তরবঙ্গের কোনো কোনো এলাকায় তার যথেষ্ট প্রভাব আছে।
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
8 ছবি1 | 8
প্রবীণ সাংবাদিক মিলন দত্তের বক্তব্য, এবার হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মূল কারণ বাম-কংগ্রেস-আইএসএফজোট। বিভিন্ন জায়গায় জোট প্রার্থীরা এমন ভাবে ভোট কাটবে যে, সমীকরণ বদলে যাবে। মিলনের কথায়, ''সহজ আসন বলে কিছু নেই বললেই চলে। জোট এমন ভাবে ভোট কাটবে যে, যার জেতার কথা তিনি হারবেন, আবার যার হারার কথা তিনি জিতে যাবেন।'' মিলনের ধারণা, জোটের ফলাফলও এবার অপ্রত্যাশিত হবে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান ভুল প্রমাণ করে, জোট এবার অনেক বেশি আসন পাবে।
পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম ভোটের লড়াই
পশ্চিমবঙ্গে ভোটদাতাদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম। একাধিক জেলায় অনেক আসনে ভোটের ফল প্রভাবিত করেন তারা।
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
সব চেয়ে বেশি মুর্শিদাবাদে
পশ্চিমবঙ্গের সব জেলাতেই কমবেশি মুসলিম ভোটদাতা আছেন। তবে সব চেয়ে বেশি মুর্শিদাবাদে। সেখানে প্রায় ৬৭ শতাংশ ভোটদাতা মুসলিম। তারপরেই রয়েছে মালদহ। ৫১ শতাংশ। উত্তর দিনাজপুরে ৪৯ শতাংশ। কলকাতায় ২০ শতাংশ, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৩৫ শতাংশ, উত্তর ২৪ পরগনায় ২৬ শতাংশের মতো মুসলিম ভোটদাতা আছেন।
ছবি: Reuters/R. De Chowdhuri
মুসলিম ভোটের দাবিদার
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে মুসলিম ভোটের প্রধান দাবিদার হলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস এবং বামেদের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত মোর্চা। গত নির্বাচনে মুসলিম ভোটের সিংহভাগ পেয়েছিলেন মমতাই। এবার বাম জোটও মুসলিম ভোট ফিরে পেতে চায়। ছবিতে জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন বাম জোটের শরিক দলের নেতা আব্বাস সিদ্দিকি।
ছবি: Naushad Bhai
আব্বাস সিদ্দিকি ভরসা
বামেদের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত মোর্চায় আছে কংগ্রেস এবং আব্বাস সিদ্দিকির নবগঠিত ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফ। ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি সম্প্রতি তার দল গঠন করেছেন। বাম ও কংগ্রেসের আশা, সিদ্দিকি মুসলিম ভোটের একটা অংশ জোটের দিকে টানতে পারবেন।
ছবি: Naushad Bhai
ওয়েইসি এখনো প্রার্থী দেননি
এমআইএম(মিম) নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসি বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে ভালো ফল করেছিলেন। তিনি অনেক আসনে আরজেডি-কংগ্রেসের মুসলিম ভোটে ভাগ বসাতে পেরেছিলেন। তাতে অবশ্য নীতীশ কুমার ও বিজেপি-র জয়ের পথ প্রশস্থ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে অনেকদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েও প্রথম দফার নির্বাচনে প্রার্থী দেননি তিনি।
ছবি: Imago/Hindustan Times/S. Mehta
ওয়েইসির দলে ক্ষোভ
পশ্চিমবঙ্গে মিমের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা জাহিরুল হাসান পদত্যাগ করেছেন। ওয়েইসি প্রার্থী না দেয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ইস্তফা দিয়েছেন। মুর্শিদাবাদের ১৩টি আসনে প্রার্থী দেয়ার কথা ছিল। সেটাও ঘোষণা করা হয়নি। ওয়েইসির সভাও বাতিল হয়েছে। ফলে ওয়েইসি কী করবেন তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
ছবি: Ians
তৃণমূলের আশা
তৃণমূল নেতাদের আশা, গতবারের মতো তারা এবারেও মুসলিম ভোটের সিংহভাগ পাবেন। তবে গতবারের তুলনায় মমতা এবার ১০ জন মুসলিম প্রার্থী কম দিয়েছেন। বিজেপি-র মোকাবিলায় তিনি হিন্দুত্বের তাসও খেলছেন। কিন্তু তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, গত দশ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিমদের জন্য অনেক কাজ করেছেন এবং করার চেষ্টা করেছেন।
ছবি: Indranil Aditya/NurPhoto/picture alliance
মুসলিম ভোট কোনদিকে
পশ্চিমবঙ্গে একসময় মুসলিম ভোট ভাগ হতো বাম ও কংগ্রেসের মধ্যে। মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় তৃণমূল করার পর পরিস্থিতির বদলায়। বিজেপি-র দিকে মুসলিম ভোট বিশেষ যায় না। সে কথা মাথায় রাখলে মুসলিম ভোটদাতার কাছে বিকল্প তৃণমূল ও বাম জোট। দুই মুসলিম প্রধান জেলা মুর্শিদাবাদ ও মালদহ হলো কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। তাদের জয় নির্ভর করছে, মুসলিমরা কতটা পাশে থাকবেন তার উপর। বাকি জেলাতে মুসলিম ভোট পাওয়ার ব্যাপারে তৃণমূল আশাবাদী।
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
7 ছবি1 | 7
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য মিলন বা বিশ্বনাথের সঙ্গে সহমত নন। তাঁর মতে, খুব বেশি হলে ৫০টি আসনে কম ব্যবধানের লড়াই হবে। বাকি আসনে পাঁচ হাজারের বেশি ভোটে প্রার্থীদের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। জোটকে খুব বড় ফ্যাক্টর বলে মনে করছেন না ত্রিদিবেশ। বিশ্বনাথ জোটকে গুরুত্ব দিলেও তারা খুব বেশি আসন পাবে বলে মনে করছেন না।
পশ্চিমবঙ্গে আট দফায় নির্বাচন শুরু হয়েছে। এখনো পর্যন্ত চার দফা ভোট হয়েছে। মোট ২৯৪ টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। প্রায় সকলেই মনে করছেন, এবারের ভোট গত বেশ কয়েক দশকের ভোটের চেয়ে চারিত্রিক ভাবে আলাদা। ফলে ফলাফলেও তার প্রভাব পড়তে পারে।