বাংলার রাজ্য রাজনীতিতে বামপন্থিরা ক্রমশ গুরুত্বহীন হয়ে যাবেন, এমন ভবিষ্যদ্বাণী গত বিধানসভা ভোটের আগে কেউ কেউ করেছিলেন৷ কার্যত কি সেটাই হলো? কোথায় গেলেন বাঙালি বামপন্থিরা? জানাচ্ছেন শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়...
বিজ্ঞাপন
গত বিধানসভা ভোটের আগে বাংলায় ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস সদর্পে বলেছিল, রাজ্য থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বামপন্থিরা৷ পড়ে থাকবে শুধু পার্টির সাইনবোর্ড৷ ভোটের ফলে কার্যত তাইই হয়েছিল৷ মমতা ব্যানার্জি এবং তাঁর তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে ভোটারদের ব্যাপক সমর্থন প্রায় ধুয়েমুছে দিয়েছিল বাম বিরোধীদের৷ এবং বাম সমর্থনে ধস তার পরেও অব্যাহত৷ অনেক জায়গায় নির্বাচিত বাম পঞ্চায়েত সদস্য, কাউন্সিলররা শিবির ছেড়ে শাসক দলের দিকে গিয়ে ভিড়ছেন৷ রাজ্যে যা ঘটনা ঘটছে, তাতে কোনো রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া নেই বামদের৷
দুর্গাপুজোর সময় জনসংযোগ বাড়াতে বিভিন্ন পুজামণ্ডপের সামনে মার্ক্সবাদী সাহিত্য, পত্র–পত্রিকার স্টল করেন বামপন্থিরা৷ বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্টলের সঙ্গেই থাকত সেসব স্টল৷ বামফ্রন্ট শাসনের জমানায় বেশ চোখে পড়ার মতো জায়গাতেই থাকত সেই স্টল৷ এবার সেসব স্টলও অনেক জায়গায় দেখা যায়নি৷ তার কারণ হিসেবে যেটা শোনা গেল, বোঝা গেল, প্রায় সব বড় পুজোর সঙ্গেই এখন যুক্ত আছেন শাসকদলের নেতা–মন্ত্রীরা। তাঁরা চাননি, বা পছন্দ করেননি, তাই ওই স্টল এবার অনেক এলাকাতেই হয়নি৷ তাই প্রশ্ন উঠছে, কোথায় উধাও হলেন বামপন্থিরা?
পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত ‘জয়নগরের মোয়া’
শীত আসছে৷ তাই আবার উচ্চারিত হচ্ছে ‘জয়নগরের মোয়া’র নাম৷ ছবিঘরে ঢুকে জেনে নিন মজাদার এই মোয়া তৈরির বৃত্তান্ত৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
কণকচূড় ধানের খই
জয়নগরের মোয়ার অন্যতম প্রধান উপাদান কণকচূড় ধানের খই, যা এখনও প্রথাগত পদ্ধতিতেই ঝাড়াই-বাছাই করা হয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
খেজুরের রসে মোয়া
মোয়ার দ্বিতীয় উপাদান হলো ‘নলেন গুড়’, যা অত্যন্ত যত্ন নিয়ে খেজুরের রস জাল দিয়ে তৈরি করতে হয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
‘শিউলি’
খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করেন যাঁরা, তাঁদের চলতি কথায় বলা হয় ‘শিউলি’ - এঁরা গাছ বাইতে ওস্তাদ৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
‘নলেন গুড়’
খেজুর গাছের মাথার দিকে, গুঁড়ির গায়ে চিরে দিয়ে, তার তলায় বাঁধা হয় মাটির হাঁড়ি - সরু নল দিয়ে রস এসে জমা হয় হাঁড়িতে৷ এই নলের কারণেই নাম ‘নলেন গুড়’৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
গাছের গায়ের দাগ
খেজুর গাছের গায়ে কাটার দাগ পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায় - যে গাছের গায়ে যত বেশি দাগ, ধরে নিতে হবে, সেই গাছের রস তত বেশি মিষ্টি৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
জ্বালানি কাঠের ঢিমে আঁচের মোয়া
গুড় জাল দেওয়ার জন্য দরকার হয় কাঠের ঢিমে আঁচ - সেই জ্বালানি কাঠ শীতকাল শুরু হওয়ার আগেই মজুত রাখতে হয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
মোয়ার মণ্ড
নলেন গুড়ের সঙ্গে কণকচূড় ধানের খই মিশিয়ে, ঘন করে পাক দিয়ে তৈরি হয় জয়নগরের মোয়ার মণ্ড৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
ঘি মেখে তৈরি মোয়া
গাওয়া ঘি দু হাতে মেখে, গোল গোল করে পাকিয়ে তৈরি করা হয় মোয়া৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
ক্ষীরের মোয়া
স্বাদ বাড়ানোর জন্য তার সঙ্গে যুক্ত হয় খোয়া ক্ষীর, কাজুবাদাম, কিশমিশ৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
সর্বত্র পাওয়া যায় এই মোয়া
কখনও হাঁড়িতে, কখনও রঙচঙে প্যাকেটে ভরে জয়নগরের মোয়া চলে যায় রাজ্যের সর্বত্র৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
10 ছবি1 | 10
যা জানা যাচ্ছে, বিধানসভা ভোটের বিপর্যয়ের পর থেকেই বাংলার বাম শিবিরে এক ব্যাপক শুদ্ধিকরণ শুরু হয়েছে৷ এবং সেটা ঢাক–ঢোল পিটিয়ে, লোক জানিয়ে হচ্ছে না৷ হচ্ছে নীরবে, কিন্তু নিষ্ঠার সঙ্গে৷ সম্ভবত দ্বিতীয়বারের ভোটেও মমতা ব্যানার্জির বিপুল জয় এবং তারপর থেকেই বাম নেতা–কর্মীদের এক বড় অংশের দলবদল চোখ খুলে দিয়েছে বাম নেতাদের৷ তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, এখনও রাজ্যে প্রায় ৪০% ভোটের অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও বাজার গরম করা ভাষণ আর রাজনৈতিক শক্তি এবং জনসমর্থন ফিরে পাওয়ার উদ্ভট দাবিতে আর কাজ হচ্ছে না৷ নিজেদের মান খুইয়ে চিরবিরোধী কংগ্রেসের সঙ্গে এ রাজ্যে নির্বাচনী জোট গড়েছিল বামফ্রন্ট৷ সেই জোটের নেতা এবং জিতে ক্ষমতায় এলে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছিল যাকে, সেই সূর্যকান্ত মিশ্র নিজেই ভোটে জিততে পারলেন না৷ উল্টে ভোটের পর থেকে সংগঠনে ধস নামার অচেনা ছবি৷ হঠাৎ সবারই বোধোদয় হয়েছে এবং সবাই নাকি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উন্নয়নযজ্ঞে সামিল হতে ব্যাকুল!
বামপন্থিরা, বা বলা ভালো ফ্রন্টের প্রধান শরিক দল সিপিআইএম এখন সেই উন্নয়নমুখী দলীয় কর্মীদের চলে যেতে দেওয়ারই নীতি নিয়েছেন৷ কাউকে ধরে রাখার চেষ্টা নয়, কোনো হা–হুতাশ নয়, যারা আসলে ক্ষমতার লোভে, আর্থিক সুবিধার লোভে বাম শিবিরে ছিল এবং এখন উন্নয়নের ভাগ নিতে না পেরে হাঁফিয়ে মরছে, বাম নেতৃত্ব চাইছে তারা চলে যাক৷ সংগঠনের শরীর থেকে বদরক্ত বেরিয়ে যাক৷
কলকাতার হাতে টানা রিকশার একাল
কলকাতার কোনো কোনো জায়গায় এখনো হাতে টানা রিকশার চল রয়েছে৷ যদিও সংখ্যাটা দিনদিন কমছে৷ আর কতদিন থাকবে? চলুন জানার চেষ্টা করি এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
যবে থেকে শুরু
হাতে টানা রিকশার উদ্ভাবন ১৬ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, জাপানে৷ ১৯ শতকে যানটি গোটা এশিয়ায় বহুল ব্যবহৃত এক গণ-বাহন হয়ে দাঁড়ায়৷ ১৮৮০ সালে ভারতে প্রথম রিকশা চালু হয় হিমাচল প্রদেশের সিমলায়৷ সেখান থেকে হাতে টানা রিকশা চলে আসে কলকাতায়৷ ১৯১৪ সাল নাগাদ কলকাতায় ভাড়াটে রিকশার চলন হয়৷ এরপর এত বছর পরেও কলকাতার কোনো কোনো অঞ্চলে টিকে আছে এই হাতে টানা রিকশা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
প্রধান সড়ক থেকে গলিতে
কলকাতার প্রধান সড়কপথগুলোতে এখন অবশ্য আর রিকশা চলাচলের অনুমতি দেয় না পুলিশ৷ তার প্রথম কারণ রিকশার মতো ধীরগতির যানের কারণে রাস্তায় যানজট তৈরি হয়৷ তবে অন্য আর একটি কারণ হলো, আজকের দিনে রিকশার সওয়ারি হওয়া নিরাপদও নয়৷ ফলে কিছুটা বাধ্য হয়েই রিকশারা আশ্রয় নিয়েছে পুরনো কলকাতার গলি-ঘুঁজিতে, যেখানে ব্যস্ত ট্রাফিকের তাড়াহুড়ো নেই৷ রিকশায় চড়ে দুলকি চালে সফর করাও উত্তর কলকাতার অনেক বাসিন্দারই এখনও পছন্দসই৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
এখনো ব্যবহারের কারণ
আধুনিক কোনো যন্ত্রচালিত যানের সঙ্গে গতি বা স্বাচ্ছন্দ্যে পাল্লা দিতে পারে না আদ্যিকালের রিকশা৷ তা-ও এটি কী করে কলকাতায় থেকে গেল, তার কিছু নির্দিষ্ট কারণ আছে৷ এখনও অনেক বয়স্ক মানুষ রিকশা চড়তে পছন্দ করেন কারণ, এই যানটি তাঁদের জন্য যাকে বলে একেবারে হ্যাসল-ফ্রি৷ ঠিক একই কারণে অনেক বাড়ির বাচ্চারাও স্কুলে যাওয়ার সময় রিকশায় চড়ে যায়৷ তবে কলকাতা শহরে রিকশার সবথেকে বড় উপযোগিতা বোঝা যায় বর্ষায়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
রিকশার ওয়ার্কশপ
যেহেতু শহরের রাস্তায় এখনও রিকশা চলে, মেরামতির জন্য রিকশার নিজস্ব হাসপাতালও নেই নেই করে এখনও দু-একটি টিকে আছে৷ এগুলো বিশেষভাবে হাতে টানা রিকশার মেরামতির জন্যই৷ অন্য কোনও কাজ এখানে হয় না৷ তবে আজকাল অসুবিধে হয়, কারণ রোজগার প্রতিদিনই কমছে৷ কাজ জানা লোকেরও অভাব৷ যদিও বা লোক পাওয়া গেল, তাদের দেওয়ার মতো যথেষ্ট কাজ পাওয়া যায় না৷ দোকানের মালিক শুয়ে বসেই দিন গুজরান করেন৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
কাঠ দিয়ে তৈরি চাকা
রিকশা তৈরি বা মেরামতিতে কিন্তু এখনও সেই পুরনো পদ্ধতিই বহাল৷ রিকশার চাকা যেমন এখনও কাঠ দিয়েই তৈরি হয়৷ মাঝখানের অংশটা যথারীতি লোহার, কিন্তু বাকি চাকার জন্য কারিগরদেরই জোগাড় করে আনতে হয় উঁচু মানের কাঠ যা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা শহরের খানা-খন্দে ভরা এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দিয়ে রিকশাকে গড়গড়িয়ে নিয়ে যাবে৷ সওয়ারিকে নিয়ে রিকশা যাতে ভেঙে না পড়ে, তার জন্য ভালো কাঠ বা লোহা যেমন দরকার, তেমনই দরকার ওস্তাদ কারিগর৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
খড় দিয়ে তৈরি বসার গদি
সওয়ারিদের যাতে কষ্ট না হয়, সেজন্যও রিকশাওয়ালারা সমান যত্নবান৷ যাত্রীদের বসার গদিটি যাতে ঠিকঠাক থাকে, এর জন্য নিয়মিত তার পরিচর্যা হয়৷ কাপড় আর রঙিন প্লাস্টিকের তৈরি এই গদির খোলে কী থাকে জানেন তো? না, তুলো বা ফোম নয়, নির্ভেজাল খড়৷ প্রকৃতি-বান্ধব উপাদান ব্যবহার করার এমন নমুনা কি আর কোনো শহুরে যানের ক্ষেত্রে দেখেছেন? রিকশা দূষণ ছড়ায় না, এটাও একটা খেয়াল রাখার মতো বিষয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
অমানবিক
তবু হাতে টানা রিকশা উঠে যাচ্ছে কলকাতা থেকে৷ কারণ, একজন মানুষ আর একজন মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, এটা অনেকের কাছেই খুব অমানবিক মনে হয়৷ সাইকেল রিকশাতে যদিও একই ঘটনা ঘটে, কিন্তু সেক্ষেত্রে চালক প্যাডেলের মাধ্যমে কিছুটা যান্ত্রিক সুবিধা পান৷ যদিও এই রিকশা নিয়ে রোমান্টিকতার কোনো শেষ নেই৷ পরিচালক বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ ছবির গোটা ক্লাইম্যাক্স সিনটিই গড়ে উঠেছে দুটি হাতে টানা রিকশার রেষারেষির মধ্য দিয়ে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
সময় কি বিদায় নেয়ার?
তাই দিনের শেষে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় যখন ছায়া দীর্ঘতর হয়, আর রাস্তার একধারে স্থবির হয়ে অপেক্ষায় থাকে সওয়ারি না পাওয়া একটি রিকশা, ব্যস্ত শহর তার পাশ দিয়ে ছুটে যেতে যেতে তার কর্কশ কলরবে যেন বারবার মনে পড়িয়ে যায়, এবার সময় হয়েছে বিদায় নেওয়ার৷ আধুনিক সময়ের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না রিকশা৷ সে কারণেই রাজপথ থেকে সরে গিয়ে তাকে মুখ লুকোতে হয়েছে গলিতে৷ খুব শিগগিরই বোধহয় সেই আড়ালটুকুও যাবে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
8 ছবি1 | 8
এমনকি যারা দীর্ঘদিন ধরে নানা সাংগঠনিক স্তরে বহাল, অথচ সংগঠনের প্রকৃত কাজে যাদের পাওয়া যায় না, সেই ছোট এবং মাঝারি নেতাদেরও গুরুত্ব না দেওয়া শুরু হয়েছে৷ অবলুপ্তি ঘটছে ‘জোনাল কমিটি'র, বরং জেলা কমিটির সঙ্গে লোকাল কমিটির সরাসরি সংযোগ গড়ার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ এবং অবশেষে একটা খুব জরুরি স্বীকৃতি দেওয়া চালু হয়েছে৷ পদাধিকারীরা নয়, সংগঠনে গুরুত্ব পাচ্ছেন সেইসব অনামী কর্মী–সমর্থকরা, যাঁরা হয়তো খাতায়–কলমে দলের সদস্যই নন, কিন্তু গত বিধানসভা ভোটের সময় যাঁরা মার খেয়েছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন, তবু দাঁতে দাঁত চেপে মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন৷
সোজা কথায়, যে সাগংঠনিক শুদ্ধিকরণ গত ২০ বছরে হওয়া জরুরি ছিল, কিন্তু হয়নি, তা এবার হচ্ছে৷ অকারণ রাজনৈতিক বিরোধিতায় শক্তিক্ষয় না করে বরং নিজেদের শক্তি সংহত করার চেষ্টায় রত বামপন্থিরা৷ সবাই চিনে নিতে চাইছেন, কে প্রকৃত বাম আদর্শে বিশ্বাসী, আর কে নয়৷ কারা দলে এসেছিল ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে সুবিধে পাওয়ার লোভে, আর কারা এই চরম দুঃসময়েও লড়াই চালিয়ে যেতে চান৷
উপনিষদে আছে— ‘আত্মানং বিদ্ধি'৷ নিজেকে জানো৷ সেই জানার প্রক্রিয়াই শুরু করেছেন বাংলার বামপন্থীরা৷