পশ্চিমবঙ্গের ২১তম জেলা হিসেবে ঘোষিত হলো কালিম্পং৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজেই এই ঘোষণা করলেন এক জনসমাবেশে৷
বিজ্ঞাপন
প্রায় পাঁচ মাস আগেই ঘোষণা ছিল যে দার্জিলিং জেলায় এক সাব-ডিভিশন হিসেবে থাকা কালিম্পংকে আলাদা জেলার মর্যাদা দেওয়া হবে৷ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে, দার্জিলিংয়ের লেপচা জনজাতির মানুষদের জন্য আলাদা পর্ষদ গঠনের ঘোষণার সময়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এই আশ্বাস দিয়ে এসেছিলেন৷ জানিয়েছিলেন, কালিম্পং অঞ্চলের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য রাজ্য সরকার আলাদা অর্থ বরাদ্দ করবে৷ রাস্তাঘাট এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে এখানে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নয়নের পরিকল্পনা আছে সরকারের৷
মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে আবার পাহাড়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ কালিম্পংকে আলাদা জেলার স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি ঘোষণা করলেন ২২০ কোটি টাকার এক সড়ক প্রকল্পের কথা, যা প্রাচীন সিল্ক রুট ধরে কালিম্পংকে সিকিমের সঙ্গে সংযুক্ত করবে৷ কালিম্পংয়ের জলকষ্ট মেটাতে ৫০ কোটি টাকার এক জল সরবরাহ প্রকল্পের কথাও ঘোষণা করলেন৷ জানালেন, কালিম্পংয়ে পর্যটনসহ বিভিন্ন বিষয়ে ১৫টি উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করেছে সরকার৷ উদ্দেশ্য, কালিম্পংয়ের উন্নয়ন, স্থানীয় যুবকদের কর্মসংস্থান৷ আপাতত লাভা এবং গরুবাথান, এই দুটি জায়গায় দুটি নতুন থানা চালু হচ্ছে৷ ভবিষ্যতে আরও ৮টি নতুন থানা হবে৷ কালিম্পংয়ের নতুন জেলাশাসক হলেন ডঃ বিশ্বনাথ, পুলিশ সুপার অজিত সিং যাদব৷ এঁরা দু'জনেই কালিম্পংয়ের মেলা গ্রাউন্ডের মঞ্চে বুধবার উপস্থিত ছিলেন৷ তাঁদের সঙ্গে মানুষের পরিচয় করিয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্য আর কালিম্পংয়ের মানুষকে দূরে কোথাও যেতে হবে না৷
'৮০–র দশকে দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের ধাত্রীভূমি ছিল যে কালিম্পং, সেখানকার মানুষদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর আবেদন— উন্নয়নে পাশে থাকুন৷ আন্দোলন আর অশান্তির আগুন নয়, উন্নয়নের প্রদীপ জ্বালান৷ এই প্রসঙ্গে পাহাড়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা এবং বিজেপিকে একহাত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷জিএনএলএফ, অর্থাৎ গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ও তার নেতা সুবাস ঘিসিং একসময় আলাদা গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে পাহাড়ে যে আন্দোলন ছড়িয়েছিলেন, তাকেই এখন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নতুন নেতা বিমল গুরুংয়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা৷
শৈলরানি দার্জিলিং
কলকাতার গরম থেকে বাঁচতে ব্রিটিশরা খুঁজে বের করেছিলেন শৈলশহর দার্জিলিংকে৷ ‘কুইন অফ হিলস্’ নামটা তাদেরই দেওয়া৷ এখনও দলে দলে দেশি-বিদেশি পর্যটক বছরভর বেড়াতে যান উত্তরবঙ্গের এই হিল স্টেশনে, যার পথেঘাটে এখনও থমকে আছে সময়৷
ছবি: DW
তাকালেই কাঞ্চনজঙ্ঘা
দার্জিলিংয়ের অভিভাবকের মতো দাঁড়িয়ে আছে মহাকায় কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গ৷ যে কোনো জায়গা থেকে নজর কেড়ে নেয় তার অপরূপ সৌন্দর্য৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
দুরপিন হিল
দার্জিলিং শহরের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র এই ভিউ পয়েন্ট, স্থানীয় ভাষায় দুরপিন, বা দুরবিন হিল৷ এখান থেকে সরাসরি দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
ছায়াময় রাস্তা
দার্জিলিং মানেই পাইন, পপলারের ছায়ামাখা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা৷ দিনভর যে রাস্তায় হেঁটে বেড়ালেও ক্লান্তি আসে না৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
রঙিন প্রার্থনা
দার্জিলিংয়ের আরও একটা চেনা বৈশিষ্ট্য, শ্যাওলায় ঢাকা পাথুরে দেওয়ালের গায়ে সার দিয়ে টাঙানো, প্রার্থনা লেখা বর্ণময় কাপড়ের পতাকা৷ মূলত বৌদ্ধধর্মের এই প্রেয়ার ফ্ল্যাগ পাহাড়ি এলাকার অন্যান্য ধর্মস্থানেও দেখা যায়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
ধর্মীয় শিলালিপি
প্রার্থনার মন্ত্র লেখা রাস্তার ধারের পাথরের গায়ে৷ বিজ্ঞাপনে মুখ ঢাকা শহরের দেওয়াল দেখতে দেখতে ক্লান্ত চোখ আরাম পায় এই সহজ, সরল, অনাড়ম্বর ধর্মাচরণের সৌন্দর্যে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
সাবেকি ডাকবাক্স
ব্রিটিশ আমলের ডাকবাক্স৷ রাজকীয় চেহারা৷ এই ই-মেল, মোবাইল মেসেজের যুগেও এখনও সচল৷ চিঠি ফেললে পৌঁছে যায় ঠিক ঠিকানায়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
কলোনিয়াল
ব্রিটিশরাই খুব যত্নে গড়ে তুলেছিল দার্জিলিংকে৷ এখনও পুরনো বাতিস্তম্ভে পাওয়া যায় সেই কদরের চিহ্ন৷ এখন যদিও বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাদের ঘাঁটি ছিল দার্জিলিংয়েও৷ সেই সময়ের কিছু অতিকায় ল্যান্ডরোভার গাড়ি এখনও দেখা যায় শহরের রাস্তায়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
দার্জিলিং মল
দার্জিলিংয়ের চৌরাস্তা বা বিখ্যাত মল৷ সময় থমকে আছে যেখানে৷ পুরনো সব দোকান ঘেরা চত্বরে এই ঘোড়াওয়ালারাও আছে সেই প্রথম থেকেই৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
কিউরিওসিটি শপ
কিউরিওর দোকান ছাড়া দার্জিলিং অসম্পূর্ণ৷ এই সব দোকান একেকটি রত্নভাণ্ডার৷ প্রাচীন তিব্বতি পুঁথি, মুখোশ থেকে শুরু করে রত্নখচিত অলংকার, সব পাওয়া যায় এখানে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
10 ছবি1 | 10
বিজেপি বরাবরই এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে৷ পাহাড়ে একটিমাত্র যে সাংসদ পদ, সেটি সেই বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই বিজেপির দখলে৷ পাহাড়ে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও সাংসদ, বিধায়ক নেই৷ সব ক্ষমতা ছাড়া আছে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, বা জিটিএ-র হাতে৷ মমতা ব্যানার্জি এদিন প্রশ্ন তোলেন, তাও কেন কোনও উন্নয়ন হয় না পাহাড়ে?
তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বস্তুত যেটা করলেন, তা উন্নয়নের স্বার্থে, বা প্রশাসনিক সুবিধার জন্য নয়৷ কালিম্পংকে আলাদা জেলা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আদ্যন্ত রাজনৈতিক, বলছেন পর্যবেক্ষকরা৷ গোর্খাল্যান্ড, বা অন্য কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবি না মানতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মমতা চেয়েছিলেন বিমল গুরুংকে বাগে আনার৷ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার লক্ষ্যে জিটিএ তৈরি করে দেওয়া, বা পুরনো অপরাধের মামলার ভয় দেখিয়ে পাহাড়ে অশান্তি আটকে রাখা, এ সবই ছিল সেই চেষ্টার অন্তর্গত৷ কিন্তু যখন দেখা গেল বিমল গুরুং বা তাঁর মোর্চা গোর্খাল্যান্ডের পুরনো দাবি, বা পাহাড়ে লোক খেপানোর রাজনীতি ছেড়ে নড়ছে না, মমতা কালিম্পং এবং দার্জিলিংয়ের অন্যত্র বসবাসকারী লেপচা জনগোষ্ঠীর লোকজনের আলাদা করে দিলেন৷ কালিম্পংকে আলাদা জেলা করে দিয়ে কার্যত দু'ভাগে ভাগ করে দিলেন গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনকে৷ এর আগেই জনমুক্তি মোর্চা ছেড়ে বেরিয়ে এসে নতুন দল গড়েছেন কালিম্পংয়ের নেতা হরকা বাহাদুর ছেত্রী৷ তিনিই প্রথম কালিম্পংকে আলাদা জেলা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন৷ হরকাও এদিন কালিম্পংয়ের মেলা ময়দানের মাঠে বসে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর পাশে৷ বোঝা গেল, পাহাড়ে আসন্ন পুর নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে নতুন জোট হবে হরকা বাহাদুরের জন আন্দোলন পার্টির৷
এবার থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি পশ্চিমবঙ্গে ‘কালিম্পং দিবস' হিসেবে পালিত হবে বলে ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী৷ পাহাড় জুড়ে তখন আতসবাজি ফাটছে!
দার্জিলিংয়ের ঐতিহ্যবাহী ‘টয় ট্রেন’
দার্জিলিংয়ের টয় ট্রেন ইউনেসকো ঘোষিত একটি ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত৷ টয় ট্রেনের ওয়ার্কশপটাকে এখন দেখলে মনে হয় যেন একটা মিউজিয়াম, যে ঐতিহ্য দার্জিলিং তো বটেই, এক সময় যা সারা বাংলার গর্ব ছিল৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে
আদত নামটা এমন হলেও, পর্যটক এবং স্থানীয় মানুষজন আদর করে ডাকেন ‘টয় ট্রেন’৷ এই ট্রেন ইউনেসকো ঘোষিত একটি ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে হিসেবে আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত৷ আগে এই টয় ট্রেন চলত নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত৷ এখন অবশ্য তার যাত্রা সীমাবদ্ধ দার্জিলিং আর ভারতের সর্বোচ্চ রেলস্টেশন ঘুম-এর মধ্যে, দিনে চারবারের জয় রাইডে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
বাষ্পচালিত ইঞ্জিন
কাজেই টয় ট্রেনের বাষ্পচালিত ইঞ্জিনগুলো এখন কার্যত অবসর জীবন কাটায় দার্জিলিংস্টেশনের লাগোয়া লম্বা এক শেডের তলায়৷ যদিও মাঝেমধ্যে জয় রাইডে যাওয়ার জন্য এদেরও ডাক পড়ে৷
ছবি: DW/Zeljka Telisman
সচল ওয়ার্কশপ
দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের নিজস্ব কারিগরি বিভাগের কর্মীরা তাই রোজই এই ওয়ার্কশপে আসেন, ব্যস্ত থাকেন মেরামতিতে, যাতে ইঞ্জিনগুলো সচল থাকে৷টয় ট্রেনের বিরাট ওয়ার্কশপটাকে এখন দেখে মনে হয় যেন এক মিউজিয়াম, যেখানে সংরক্ষিত আছে ইতিহাস আর ঐতিহ্য, যে ঐতিহ্য দার্জিলিং তো বটেই, সারা বাংলার গর্ব ছিল এক সময়৷
ছবি: S. Bandopadhyay
প্রবীণ কারিগর
এই প্রযুক্তি-কর্মীদের অনেকেই ডিএইচআর-এ বহু বছর ধরে কাজ করছেন৷ যেমন এই প্রবীণ মুসলিম কারিগর, যিনি তাঁর অধস্তন এক ছোকরা মেকানিককে বকাবকি করছিলেন যে তারা কোনো কাজ ঠিকঠাক করতে পারে না৷ তাতে সবারই নাম খারাপ হয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
যেন জুল ভার্নের কল্পকাহিনি
কিন্তু আসল সমস্যা আদ্যিকালের এইসব ইঞ্জিনের পুরনো যন্ত্রাংশ৷ টয় ট্রেনের চালকের ঘরটা দেখলে মনে হয়, যেন সোজা জুল ভার্নের কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি থেকে উঠে এসেছে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
মান্ধাতা আমলের যন্ত্রাংশ
যন্ত্রপাতিগুলো দেখতে নেহাতই সহজ-সরল হলেও সবই অতি পুরনো, মান্ধাতার আমলের৷ ফলে এগুলোকে সারানো বা এর যন্ত্রাংশ জোগাড় করাটাই কারিগরদের জন্যে আজকাল মস্ত বড় সমস্যা৷ কাজেই একাধিক বাষ্পচালিত ইঞ্জিন আজকে স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওয়ার্কশপে৷ যদি কোনোভাবে তাদের সারিয়ে তোলা যায়, সেই অপেক্ষায়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
রোজকার দৌড়
তবে কিছু ইঞ্জিন এখনও রোজ নিয়ম করে রেল লাইনের উপর দিয়ে ছুটতে বের হয়৷ পাহাড়ি রাস্তায় পাতা ন্যারো গেজ রেললাইন ধরে তারা এঁকে-বেঁকে দৌড়ায়, নিজেদের ফিট রাখে৷ কে জানে, কখন কী কাজের ডাক আসে!দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গা ঘামানোর মতো ইঞ্জিনগুলোর থেকে ধোঁয়া বেরোয়, কলকব্জার ধাতব আওয়াজ হয় সারা শরীর জুড়ে৷ যেন পাহাড়ি রাস্তায় ছুটতে যাবে বলে সবাই খুব উত্তেজিত৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
নামেই যায় চেনা
টয় ট্রেনের সব ইঞ্জিনেরই একটা করে নাম আছে৷ আর সেই নামগুলো কোনো না কোনো শক্তিধর প্রাণীর নামে৷ খাড়াই রাস্তায় আস্ত একটা ট্রেন টেনে নিয়ে যাওয়ায় এদের যে বিক্রম, সম্ভবত তা-ই বোঝাতে৷কখনও ইঞ্জিনের নাম দাঁতাল হাতির নামে, ‘টাস্কার’৷ কখনও হিমালয়ের পরাক্রমশালী ঈগল পাখির নামে তার নাম৷ এখনও খুব যত্ন নিয়ে পিতলের নাম-ফলকগুলো ঘষে-মেজে চকচকে রাখা হয়৷