গুজরাট, দিল্লি এবং মহারাষ্ট্রের পর এবার ওড়িশাতেও আক্রান্ত বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা। গত সপ্তাহে ওড়িশার সম্বলপুর থেকে মালদহে ফেরেন প্রায় ৪০ জন শ্রমিক। তাদের অভিযোগ, ধর্ম নয়, রাজ্যের নাম জানতে চেয়ে হুমকি ও হেনস্থার মুখে পরতে হয়েছে তাদের।
চাঁচোল থানায় পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগেও একথা জানিয়েছেন ফিরে আসা শ্রমিকরা। এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লেখেন বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল সাংসদ ইউসুফ পাঠান।
রাজ্যেরনামেআক্রমণ?
টেলিগ্রাফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এক পরিযায়ী শ্রমিক জানান, একটি সেতু নির্মানের কাজে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে তিনি সম্বলপুর যান। তিনি বলেন, "কাজ শুরুর পর স্থানীয় বেশ কিছু মানুষ এসে জানতে চান তারা কোন রাজ্য থেকে এসেছেন। বাংলা শুনেই তারা আক্রমণাত্মক ও মারমুখি হয়ে ওঠেন। ভয়ে আমরা বাড়ি ফিরে আসি। তারা আমাদের বাসস্থানেও হামলা করে।"
এই আক্রমণের পর সময় নষ্ট না করে শ্রমিকরা রাজ্যে ফিরে আসেন। তারা জানিয়েছেন, ভয় পালিয়ে আসার সময় তাদের জিনিসপত্র আনতে পারেননি। যে কদিন কাজ করেছেন তার পারিশ্রমিক পর্যন্ত আনতে পারেননি তারা।
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকদের ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রে মারধর করা হচ্ছে। ওড়িশা, মহারাষ্ট্র ও উত্তরপ্রদেশের ডিজিকে চিঠি পাঠাবে রাজ্য সরকার।
রাজনৈতিক তরজা
তৃণমূল নেতা এবং কলকাতার কাউন্সিলর অরূপ চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "বিজেপি দলটা হচ্ছে বাঙালি বিরোধী। নবীন পট্টনায়েকের সরকার যখন ছিল তখন ওদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক ছিল। বিজেপি সরকারে আসার পর সম্পর্ক খারাপ করা হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে মতান্তর হলেও মনান্তর হয়নি। এখন বিজেপি ক্ষমতায় এসে তাদের বাঙালি বিদ্বেষ প্রকাশ্য করছে।"
দুর্দশা, যন্ত্রণার আরেক নাম চা শ্রমিক
ধীরে ধীরে খুলছে বহু বন্ধ বাগান। কিন্তু শ্রমিকের দুর্দশা কমছে না। ন্যূনতম পারিশ্রমিকটুকুও পান না পশ্চিমবঙ্গের চা শ্রমিকেরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
একনজরে বাগান
পাহাড়, ডুয়ার্স এবং তরাই মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কমবেশি ২৮৩টি চা বাগান আছে। তার মধ্যে হিমালয়ের পাদদেশে তরাই এবং ডুয়ার্সে বাগানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রায চার লাখ কর্মী চা বাগানের সঙ্গে যুক্ত। তারা বিভিন্ন চা বাগানের বস্তিতে থাকেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বন্ধ বাগান
গত এক দশকে প্রায় একশটি চা বাগান বিভিন্ন সময়ে বন্ধ হয়েছে। দার্জিলিং পাহাড়, ডুয়ার্স, তরাই সর্বত্র চা বাগান বন্ধ হয়েছে। কাজ হারিযেছেন হাজার হাজার শ্রমিক। অভাবে মৃত্যু হযেছে বহু শ্রমিকের। তারই মধ্যে এসেছে করোনাকাল। কাজ বন্ধ থেকেছে খোলা বাগানেরও। তবে ২০২২ সাল থেকে ফের খুলতে শুরু করেছে বহু বন্ধ বাগান। আগামী কয়েকমাসের মধ্যে প্রায় সব বাগানই খুলে যাবে বলে মনে করছেন চা বাগান আন্দোলনের কর্মীরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
যন্ত্রণার শেষ নেই
বাগান খুললেও যন্ত্রণা কমেনি শ্রমিকদের। বহু বাগানে কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রতিটি বাড়ি থেকে কেবল একজন বাগানে কাজ করতে পারবেন। কর্মীদের অভিযোগ, তাদের নিয়মিত সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে না বাগান মালিকেরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কী কী পাওয়ার কথা
মজুরি ছাড়া বাগান শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, রান্নার কাঠ, স্বাস্থ্য পরিষেবা, কর্মীর সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা-সহ একাধিক পরিষেবা দেয়ার কথা বাগান মালিকদের। এর জন্য কর্মীদের মজুরি থেকে টাকাও কাটা হয়। কিন্তু বাস্তবে সব পরিষেবা পাওয়া যাচ্ছে না বলে কর্মীদের অভিযোগ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
১৫ শতাংশ বৃদ্ধি
কয়েকমাস আগেও চা কর্মীরা ২০২ টাকা দৈনিক মজুরি পেতেন। অতি সম্প্রতি ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে তা ২৩২ টাকা করা হযেছে। এই টাকাও তারা সবসময় পান না বলে অভিযোগ। ভারতে এখন অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিকদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ৩৬৯ টাকা। কিন্তু চা শ্রমিকদের এই তালিকায় ফেলা হয় না। তাদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি এর চেয়ে অনেক কম। চা কর্মীরা এখন দৈনিক ২৩২ টাকা পান।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অক্লান্ত পরিশ্রম
সকাল সাড়ে সাতটায় বাগানে পৌঁছাতে হয় চা শ্রমিকদের। দুপুরে আধঘণ্টার বিরতি পান তারা। তারপর ফের কাজে নেমে পড়তে হয়। ছুটি হয় চারটের সময়। পাতা তোলার কাজ করেন মূলত মেয়েরা। বাড়ি থেকে জল নিয়ে বাগানে যান কর্মীরা। অভিযোগ, সেই জল শেষ হয়ে গেলে সামান্য খাওয়ার জলটুকুও তাদের দেয়া হয় না। বাগানে জলের ট্যাঙ্ক যাওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ সময় তা পাওয়া যায় না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
এভাবেই থাকে শিশুরা
বাগানের ধারে এভাবেই শিশুদের রেখে কাজে চলে যান মায়েরা। সারাদিন শিশুদের খোঁজও নিতে পারেন না তারা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মায়ের অপেক্ষায়
মায়ের জন্য অন্তহীন অপেক্ষায় কোলের শিশু। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে তারা। তাদের কান্নাটুকু শোনার জন্যেও কেউ নেই।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বন্ধ বাগানের কর্মীরা
বন্ধ চা বাগানের কর্মীরা এভাবেই অন্য বাগানে চলে যান ভাগ খাটতে। প্রয়োজন মতো বিভিন্ন বাগান তাদের দিয়ে কনট্রাক্টে কাজ করায়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ওজন এবং পরোটা
প্রতিদিন দুইবার পাতার ওজন হয়। দিনে গড়ে ২৪ কেজি পাতা তুলতে হয় শ্রমিকদের। বেশি তুললে কেজি প্রতি সাড়ে তিন টাকা করে অতিরিক্ত টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু কম তুললেই পরোটা। প্রো রেটা বেসিসে মজুরি কমানো হয়। চা বাগানে সেই প্রো রেটা মুখে মুখে হয়ে গেছে 'পরোটা'।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রেশনের লাইন
আগে চা বাগান থেকে কর্মীদের রেশন দেওয়া হতো। এখন সরকার দেয়। তাই বাগান আর দেয় না। সপ্তাহের চাল-ডাল নেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে কর্মীরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মাসের রোজগার
প্রতিদিন কাজ করতে পারলে মাসে হাজার চারেক টাকা রোজগার হয় একজন কর্মীর। সেই টাকা থেকেই বিদ্যুতের বিল, ছেলেমেয়ের স্কুলে খরচ, রান্নার গ্যাস, ওষুধপত্রের টাকা দিতে হয় কর্মীদের।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সরকার কোথায়
চা বাগান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বক্তব্য, বহু আন্দোলনের পর সরকারের হস্তক্ষেপে ১৫ শতাংশ মজুরি বেড়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় যা নেহাতই কম। চা শ্রমিকদের বক্তব্য, কোনো রাজনৈতিক দলই তাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না।রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারও তাদের কথা ভাবছে না বলে অভিযোগ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
হতাশ কর্মীদের কথা
হতাশ কর্মীরা পরের প্রজন্মকে আর চা বাগানে রাখতে চান না। চা কর্মীদের নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের বক্তব্য, গত কয়েকদশকে বাগান থেকে পালাতে গিয়ে নারীপাচার চক্রের হাতে পড়তে হয়েছে বহু মেয়েকে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
14 ছবি1 | 14
বিজেপি অবশ্য এই ঘটনার জন্য তৃণমূলকেই দায়ি করেছে। মালদা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ খগেন মুর্মু বলেছেন, "তৃণমূল নেতাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্যের জন্য বাংলার সম্মানহানি হচ্ছে। তার খেসারত দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ।"
তবে পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে যা ঘটেছে তাকে তিনি অনভিপ্রেত বলেন। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি ওড়িশার সাংসদ এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলবেন।"
সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য শতরূপ ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেন, "বাংলায় কর্মসংস্থান নেই। লক্ষাধিক মানুষ ভিন রাজ্যে কাজে যান। বাংলার বিরোধিতা করা বিজেপির 'হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান' কেন্দ্রিক অবস্থানের সঙ্গে মিলে যায়। দরিদ্র বাঙালিরা অন্নসংস্থান করতে ভিন রাজ্যে যেতে বাধ্য হন এবং হেনস্থার শিকার হন।"
বাংলা পক্ষের সাধারণ সম্পাদক গর্গ চট্টোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেছেন, "বিজেপি শাসিত অনেক রাজ্যে কেবলমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য চরম হেনস্থার শিকার হচ্ছেন মানুষ। কখনো বলা হচ্ছে এরা বাংলাদেশের নাগরিক। অথচ এদের কাছে একজন ভারতীয়র যা পরিচয়পত্র থাকা উচিত তা আছে। অবৈধ বাংলাদেশি হলে এই মানুষদের গ্রেপ্তার করে আদালতে তোলা হত। অথচ এদেরকে আসলে অন্য রাজ্য থেকে তাড়িয়ে বাংলায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।"
ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গবিরোধ
এরই মধ্যে দিঘায় নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দিরের জল গড়িয়েছে রাজনৈতিক তরজায়। বিজেপি-শাসিত ওড়িশার আইনমন্ত্রী পুরীর জগন্নাথও ধামে অভ্যন্তরীণ তদন্তের নির্দেশ দিলে বিতর্ক বাড়ে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকেও সুর চড়তে থাকে। শতরূপের মতে, 'গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য ইস্যু থেকে চোখ সরিয়ে ধর্ম নিয়ে অপ্রয়োজনীয় তরজা চালাচ্ছে রাজ্য সরকার এবং প্রধান বিরোধী দল'।
জগন্নাথ মন্দির ঘিরে বাংলা-উড়িশার বিতর্ক নতুন হলেও এই দুই রাজ্যের মধ্যে সাংস্কৃতিক পরিসরে অতীতেও নানা মতানৈক্য ঘটেছে। ব্রিটিশ আমলে ওড়িশা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রতিবেশী রাজ্য হিসেবে সামাজিক পরিসরে, জীবনযাপন এবং খাদ্যাভাসেও দুই রাজ্যের অনেক মিল। এর আগে ২০১৭-এ রসগোল্লার জিআই ট্যাগের দাবিতে রীতিমত আইনি লড়াই হয় দুই রাজ্যের। পরে দুই রাজ্যের ভিন্নধর্মী রসগোল্লাকে আলাদা করে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।