পশ্চিমবঙ্গের রামপুরহাটে বাড়িতে আগুন, মৃত অন্তত আট
২২ মার্চ ২০২২
পশ্চিমবঙ্গের রামপুরহাট অগ্নিগর্ভ৷ এক তৃণমূল নেতা খুন হওয়ার পর একাধিক বাড়িতে আগুন লাগানো হয়। পুড়ে মৃত অনেকে।
বিজ্ঞাপন
সোমবার রাত থেকে অগ্নিগর্ভ বীরভূমের রামপুরহাট৷ জ্বলছে একের পর এক বাড়ি৷ রাতেই অগ্নিদগ্ধ কয়েকজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের দাবি, রাতেই মৃত্যু হয়েছে একজনের। স্থানীয় মানুষের বক্তব্য, রাতে তিনটি মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে আরো সাতজনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়৷
ঘটনার সূত্রপাত সোমবার৷ এলাকার তৃণমূল নেতা তথা রামপুরহাট এক নম্বর ব্লকের বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখ খুন হন৷ স্থানীয় একটি চায়ের দোকানে তিনি বসেছিলেন৷ সে সময় একদল দুষ্কৃতী ওই চায়ের দোকানে এসে বোমা ছোঁড়ে বলে অভিযোগ৷ রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়৷ এরপরেই এলাকায় চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে৷
পুলিশের বক্তব্য
অভিযোগ, বগটুই গ্রামে পর পর বাড়িতে আগুন লাগানো হয়৷ পুলিশ সুপার নগেন্দ্র ত্রিপাঠী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সকালে একটি বাড়ি থেকে সাতজনের অগ্নিদগ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে৷ স্থানীয় মানুষ জানিয়েছেন, সোমবার রাতে অন্য একটি বাড়ি থেকে তিনজনের অগ্নিদগ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। রাজ্য পুলিশের ডিজি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রাতে একজনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। বাকিরা হাসপাতালে ভর্তি। এখনো পর্যন্ত ১১জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দমকল সকালে জানিয়েছিল, সব মিলিয়ে এখনো পর্যন্ত ১০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। স্থানীয় আরেকটি সূত্র ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছে, মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। প্রশাসন এখনো সম্পূর্ণ তথ্য দিচ্ছে না। স্থানীয় সূত্র ডিডাব্লিউকে জানিয়েছে, রামপুরহাট হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় চারজনকে ভর্তি করা হয়েছে৷ তার মধ্যে এক যুবক, দুই নারী এবং একটি বাচ্চা আছে৷
সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার কম হয়নি৷ এমনকি ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় থেকেও যদি দেখা যায়, সংখ্যালঘুদের ওপর বারবার আঘাত এসেছে৷ কখনো রাজনৈতিক কারণে, কখনো স্থানীয় স্বার্থে৷
ছবি: bdnews24.com
ভারতভাগের পরপরই
ভারত ভাগ হয় ১৯৪৭ সালে৷ এর পরপর পূর্ব বাংলার অনেক জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের বিভিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে৷ অনেকে বলে থাকেন যে, রাষ্ট্রীয় মদদে স্থানীয় মুসলিম জনগোষ্ঠী হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করে৷ ১৯৪৯ সালে কালশিরা ও নাচোলে চলে বর্বরতা৷ এরপর ১৯৫০ সালে বরিশাল, ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর একাংশ, পাকিস্তানি পুলিশ, আনসার বাহিনী হত্যা, লুণ্ঠন, অপহরণ, ধর্ষণ চালায়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
গুজব ছড়িয়ে হামলা
প্রায়ই গুজব ছড়িয়ে বাঙালি হিন্দুদের ওপর হামলা করা হয়েছে, যা এখনো দেখা যায়৷ তেমনই এক ঘটনা ঘটে ১৯৬৪ সালে৷ ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে অবস্থিত হজরতবাল নামক তীর্থক্ষেত্রে হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর সংরক্ষিত মাথার চুল চুরি করা হয়েছে – এই সংবাদ ছড়িয়ে পূর্ব-বাংলায় আবারো সংগঠিত হয় বাঙালি হিন্দু হত্যা৷ আবারো হাজারো হিন্দু ধর্মাবলম্বী পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Mustafa
স্বাধীনতা আন্দোলনে
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল হিন্দু সম্প্রদায়৷ তারা হিন্দু অধ্যুষিত অসংখ্য গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন চালিয়েছে৷ একটি হিসেব বলছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪০ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যা নেমে হয়েছে ২১ শতাংশ৷
ছবি: AP
বাবরি মসজিদের গুজব
ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে এই গুজব ছড়িয়ে দাঙ্গা শুরু হয় ভারতীয় উপমহাদেশে৷ তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও৷ ১৯৯০ সালে হিন্দুদের উপর ৩০ অক্টোবর থেকে নির্মম নৃশংসতা শুরু হয় এবং বিরতিহীন ভাবে ২ নভেম্বর পর্যন্ত চলে৷ এই ঘটনার সূত্র ধরে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত থেকে থেকে পুরো বংলাদেশেই হিন্দুদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
রাজনৈতিক হামলার শিকার
শুধু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বা অন্য স্থানীয় স্বার্থে নয়, রাজনৈতিক কারণেও সহিংসতার শিকার হয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ৷ যেমন, ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক কারণে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নির্দিষ্টভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নৃশংস হামলা হয়৷ এমনকি ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শুরুতেও ব্যাপক হামলা হয়৷ এসব হামলার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় নয় লাখ মানুষ দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান৷
ছবি: bdnews24.com
নিস্তার পাননি অন্যান্য সংখ্যালঘুরাও
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে চট্টগ্রামের রামুতে বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা করে দুর্বৃত্তরা৷ এই ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক নিন্দিত হয়৷ ২০১৬ সালে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় সাঁওতালদের৷ এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন সাঁওতাল মারা যান ও উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হয়৷ এছাড়া পাহাড়ে প্রায়ই নিপীড়নের খবর পাওয়া যায়৷
ছবি: AFP/Getty Images
এখনো থেমে নেই
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মামলার রায়ের পর হামলা করা হয় নোয়াখালীর অনেকগুলো হিন্দু বাড়িতে হামলা হয়৷ অনেক মন্দির পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ এছাড়া রংপুর বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফেসবুকে মিথ্যা পোস্ট দিয়ে পরিকল্পনা করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করা হয়েছে৷ এসব ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন সারা দেশের মানুষ৷
ছবি: Khukon Singha
কত শতাংশ অবশিষ্ট?
কিছু হিসেবে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৪০ ভাগ ছিল সংখ্যালঘু৷ ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে তা ২২ শতাংশ৷ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে তা নেমে হয় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ৷ তবে সবশেষ ২০১৫ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো যে হিসেব দেখিয়েছে, তাতে হিন্দু ধর্মের মানুষের সংখ্যা ২০১১ থেকে বেড়েছে৷ ২০১৫ সালে দেখা গেছে, জনসংখ্যার ১০.৭ শতাংশ সংখ্যালঘু রয়েছে বাংলাদেশে৷
ছবি: DW
শত্রু সম্পত্তি আইন
২০০৮ সালে অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতসহ আরো কয়েকজনের লেখা নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়৷ বইটির নাম, ‘Deprivation of Hindu Minority in Bangladesh: Living with Vested Property’৷ সেখানে লেখকরা বলেন, শত্রু সম্পত্তি আইনের ফলে ১৯৬৫-২০০৬ সময়কালে ১২ লাখ পরিবারের ৬০ লাখ হিন্দু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন৷ এ সময় তাঁরা ২৬ লাখ একর ভূমি হারিয়েছেন৷
ছবি: bdnews24.com
হামলার বিচার হয় না
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ইতিহাস দীর্ঘ৷ কিন্তু হামলার বিচার এবং দোষীদের শাস্তির নজির নেই বাংলাদেশে৷
ছবি: bdnews24.com
10 ছবি1 | 10
তৃণমূলের দাবি
ঘটনার পরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক আবহে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে৷ বীরভূমে তৃণমূলের নেতা অনুব্রত মন্ডল বলেন, ‘‘টিভি ফেটে আগুন লেগে গেছিল বলে শুনেছি৷ আমি ঘটনাস্থলে যাইনি৷ ফলে বাকিটা বলতে পারব না৷’’ এরপরেই অবশ্য অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ভাদু শেখ খুনের সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকতে পারে৷ পুলিশ সুপার অবশ্য খুনের ঘটনার সঙ্গে আগুন লাগার কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি৷ তিনি বলেছেন, তদন্ত শুরু হয়েছে৷ কীভাবে আগুন লাগলো তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷
মঙ্গলবার দুপুরে কলকাতা থেকে ঘটনাস্থলে রওনা হন বীরভূমের দায়িত্বপ্রাপ্ত তৃণমূলের নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম৷ হেলিকপ্টারে বীরভূমে পৌঁছান তিনি৷ বেলার দিকে রামপুরহাট রওনা হন অনুব্রত মন্ডলও৷ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে স্থানীয় থানার ওসি-কে ক্লোস করা হয়েছে৷ বদলি করা হয়েছে স্থানীয় এসডিপিও-কে৷
সিপিএম এবং বিজেপির বক্তব্য
এদিন সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন রাজ্য সিপিএম-এর নতুন সম্পাদক মহম্মদ সেলিম৷ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চাওয়া হয়েছে৷ সিপিএমের প্রতিনিধিদল এলাকায় যাবে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷ তৃণমূল নেতা অনুব্রত মন্ডলকে আক্রমণ করে সেলিমের বক্তব্য, ''যার মাথায় অক্সিজেন কম আছে বলে তৃণমূল প্রচার করে, তিনি বললেন টিভি ফেটে এই ঘটনা ঘটেছে। মমতা বলেছিলেন, রাজ্য বিরোধীশূন্য করতে হবে। সেই খেলাই আমরা দেখছি।'' সেলিমের অভিযোগ, রাজ্যের সর্বত্র খুন হচ্ছে। বোমা পড়ছে। ভাদু শেখ খুন হয়েছেন তৃণমূলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের জেরে। সিপিএম রাজ্য সম্পাদকের বক্তব্য, তৃণমূল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট শুরু করে দিয়েছে। পুলিশ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে ঘটনা। কিন্তু এভাবে সত্য চেপে রাখা যাবে না।
অন্যদিকে ঘটনা ঘিরে উত্তাল হয়ে ওঠে বিধানসভা৷ মুখ্যমন্ত্রীর জবাব চেয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন বিরোধী বিধায়কেরা৷ বিজেপি নেতা এবং বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী টুইট করে পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমালোচনা করেছেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে দেখা করবে বিজেপির প্রতিনিধি দল। সব মিলিয়ে রামপুরহাটের ঘটনা কার্যত গোটা রাজ্য জুড়েই উত্তাপ ছড়িয়েছে৷
এসজি/জিএইচ (পিটিআই, সিপিএমের সাংবাদিক বৈঠক, পুলিশ সুপারের বিবৃতি)