বাঘ বেড়েছে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংরক্ষণের সুফল মিলতে শুরু করেছে।
বিজ্ঞাপন
বাঘের সংখ্যা প্রায় একশ ছুঁই ছুঁই। প্রাথমিক লক্ষ্যপূরণের দিকে যাচ্ছে ভারতের দিকে থাকা সুন্দরবন। এক সময় যেখানে বাঘের সংখ্যা কমছিলো, সেখানেই এক বছরে আটটি বাঘ বেড়েছে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো ৯৬। সাম্প্রতিক সময়ে এত বাঘ বাড়েনি। রাজ্যের বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বাঘ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটা রেকর্ড।
রাজকীয় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের এই সংখ্যা বৃদ্ধি ধরা পড়েছে ২০১৯-এর ডিসেম্বরে শুরু হওয়া বাঘসুমারি থেকে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড বা ডাব্লিউ ডাব্লিউ এফ এর সাহায্যে প্রচুর ক্যামেরা দিয়ে চলে বাঘসুমারি। তারপর ক্যামেরায় ধরা পড়া ছবি বিশ্লেষণ করা হয়। একই বাঘকে যাতে দুই বার গোনা না হয়, সেটা নিশ্চিত করা হয়। বারবার যাচাই করার পর ফলাফল জানানো হয়। তবে বনমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাঘের গায়ের ডোরাকাটা দাগ দেখে তাদের চিহ্নিত করা হয়। তাই এক বাঘকে দুই বার গোনার সম্ভাবনা নেই।
সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী
বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল সুন্দরবন৷ এই বনের জলে-স্থলে বাস করে নানা রকম বন্যপ্রাণী৷ সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য কিছু বন্যপ্রাণীর তথ্য থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
নানা রকম বন্যপ্রাণী
সুন্দরবনে আছে প্রায় ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, ৩২০ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি আর প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ৷ এছাড়া অগণিত কীটপতঙ্গও আছে এ বনে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বিশেষ বৈশিষ্ট্য
সুন্দরবনের প্রাণিদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এদের প্রত্যেকেই সাঁতার কিংবা উড়তে সক্ষম৷ দুটির কোনো একটি বৈশিষ্ট্য না থাকলে সে প্রাণী সুন্দরবনে বেঁচে থাকতে পারেনা৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বাংলা বাঘ
সুন্দরবেনের প্রধান পশু বেঙ্গল টাইগার বা বাংলার বাঘ৷ বাংলাদেশের জাতীয় পশুও এটি৷ সুন্দরবনের অতন্দ্র প্রহরী এ প্রাণীটিই এর জীববৈচিত্র্য, খাদ্য শৃঙ্খল ও পরিবেশ চক্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক৷ অত্যন্ত বিপন্ন একটি প্রাণী হিসেবে বাঘ বেঁচে আছে আমাদের সুন্দরবনে৷ ২০১৫ সালে বন বিভাগ ক্যামেরা পদ্ধতিতে গণনা করে সুন্দরবনে ১০৬টি বাঘের সন্ধান পায়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
চিত্রা হরিণ
সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি যে প্রাণীটি দেখা যায় তা হলো চিত্রা হরিণ৷ সুন্দরবনের সব জায়গাতেই দলে দলে চিত্রা হরিণ দেখা যায়৷ স্ত্রী চিত্রা হরিণের কোনো শিং নেই তবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ চিত্রা হরিণের তিন শাখা বিশিষ্ট শিং থাকে৷ চিত্রা হরিণ বাঘের সবচেয়ে প্রিয় খাবার৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মায়া হরিণ
সুন্দরবনে খুবই কম পরিমাণে আছে মায়া হরিণ৷ দেখতে অনেকটা ছাগলের মতো বলে অনেকে একে বন ছাগলও বলে থাকে৷ গাঢ় বাদামি রংয়ের এ হরিণ বনের ভেতরে একা চলতে ভালোবাসে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বানর
সুন্দরবনে প্রাণীদের তালিকায় হরিণের পরই বানরের স্থান৷ সুন্দরবনে এরা হরিণের সঙ্গে সহাবস্থান করে থাকে৷ এজন্য হরিণকে বানরের সুহৃদও বলা হয়৷ বাঘের আগমনের খবরও হরিণকে দেয় বানর৷ সুন্দরবনের গাছে ডালেই তাদের বসবাস৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বন্য শুকর
সুন্দরবনের শুকর আকারে বেশ বড়৷ কালো ও লাল মিশ্রিত গায়ের রং৷ এসব বন্য শুকর দেখতে অনেকটা ভল্লুকের মতো৷ অনেকটা শান্ত স্বভাবের প্রাণি হলেও দাঁতাল পুরুষ বন্য শুকর খুবই হিংস্র স্বভাবের হয়৷ হরিণের পরেই শুকর বাঘের প্রিয় খাবার৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
উদ্বিড়াল
উদ্বিড়াল বা ভোঁদড় দেখতে অনেকটা বেজির মতো৷ এদের গায়ের রং কালচে সাদা৷ সুন্দরবনের খালের পাড়ে এদের বিচরণ দেখা যায়৷ পানির মধ্যে ডুব দিয়ে এরা সহজেই মাছ শিকার করতে পারে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
লোনা পানির কুমির
সুন্দরবনে সরীসৃপ প্রজাতির সবচেয়ে বৃহৎ সদস্য কুমির৷ সাধারণত এরা ৫-৭ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে৷ সারা বছর গভীর পানিতে থাকলেও বেশি শীতের রৌদ্রময় দিনে খালের চরে এদের রোদ পোহাতে দেখা যায়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
গুই সাপ
গুই সাপ দেখতে অনেকটা কুমিরের মতো৷ একটি পূর্ণবয়স্ক গুইসাপের ওজন পাঁচ থেকে ছয় কেজি পর্যন্ত হয়৷ এরা গড়ে লম্বায় এক মিটার পর্যন্ত হয়৷ এদের জিহ্বা সাপের জিহ্বার মতো লম্বা৷ চোখ উজ্জ্বল ও মাঝারি৷ এরা খুব দ্রুত গাছে উঠতে, পানিতে সাঁতরাতে ও ডাঙায় চলতে পারে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
সাপ
নানা রকম সাপ রয়েছে সুন্দরবনে৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অজগর, সঙ্খচুড়, গোখরা, বেড়া, ফনিমনসা, গেছো সাপ ইত্যাদি৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
ডলফিন
সুন্দরবনের নদীতে দেখা যায় দুই প্রজাতির ডলফিন৷ এর একটি শুশুক এবং অন্যটি ইরাবতি৷ সুন্দরবনের নদী ও খালের মোহনায় এদের দেখা যায়৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনের নদীগুলো দিয়ে মালবাহী জাহাজ চলাচল করায় বিপন্ন এ প্রাণীটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
নানান পাখি
সুন্দরবনকে পাখির স্বর্গরাজ্য বলা যায়৷ খাদ্যের প্রাচুর্য, অফুরন্ত গাছ আর জনমানবহীন পরিবেশের কারণে পাখিদের কাছে সুন্দরবন খুবই নিরাপদ আশ্রয়স্থল৷ এ বনের অধিবাসী ৪০০ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৩২০ প্রজাতির স্থানীয় বা আবাসিক, আর ৫০ প্রজাতিরও বেশি অনাবাসিক বা পরিযায়ী৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
প্রজাপতি
সুন্দরবনে দেখা যায় নানান রংবেরংয়ের প্রজাপতি৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
14 ছবি1 | 14
ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, সজনেখালি রেঞ্জে বাঘ আছে ১০টি, বসিরহাট রেঞ্জে ১৯টি, জাতীয় উদ্যানের পূব দিকে ২৪টি ও পশ্চিমে ২০টি। দক্ষিণ ২৪ পরগনা রেঞ্জে আছে ২৩টি বাঘ। ঘটনা হলো, সব চেয়ে বেশি বাঘ বেড়েছে পূব দিকে, তারপর বসিরহাট রেঞ্জে এবং পশ্চিমদিকে। আর ৯৬ এর মধ্যে ২৩টি বাঘ, ৪৩টি বাঘিনী এবং বাকি শাবক।
রাজ্যে এতগুলি বাঘ বাড়ার ঘটনায় বিশেষজ্ঞরা রীতিমতো খুশি। তাঁদের মতে, বাঘ বাড়ার মূল কারণ, জঙ্গলের সংরক্ষণ আরও ভালোভাবে হচ্ছে। আর ভবিষ্যতে বাঘের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। করোনার ফলে লকডাউন হওয়ায় মানুষের প্রচুর ক্ষতি হলেও সব জায়গায় জঙ্গলের স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। কারণ, মানুষ সেখানে যাচ্ছে না। অবসরপ্রাপ্ত ফরেস্ট রেঞ্জার কাঞ্চন বন্দ্যোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''এটা পুরোপুরি সংরক্ষণের ফল। যেখানেই সংরক্ষণ ভালো হয়েছে, উন্নতি হয়েছে, সেখানেই বন্যপ্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে। সুন্দরবনে যে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে, তা রীতিমতো আশার কথা। সংরক্ষণ যদি এই ভাবে চালানো যায়, তা হলে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা আরও বাড়বে।''
সাতক্ষীরার ‘বাঘ বিধবা’দের কথা
সুন্দরবনের বাঘের হামলায় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের স্ত্রীকে ডাইনি অপবাদ দেয়া হয়৷ এমন অনেক ‘বাঘ বিধবা’র সঙ্গে মিশতে চান না গ্রামবাসীরা৷
ছবি: AFP/M. Uz Zaman
ডাইনি অপবাদ
স্বামীর ছবির সঙ্গে মোসাম্মৎ রশিদা৷ সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন তাঁর স্বামী৷ এই মৃত্যুর জন্য রশিদাকে দায়ী করেন গ্রামবাসীরা৷ এছাড়া তাঁকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না অনেকে৷ এমনকি তাঁর দুই ছেলেও তাঁকে ছেড়ে গেছেন৷
ছবি: AFP/M. Uz Zaman
রশিদা আশ্চর্য নন
‘‘আমার ছেলেরা আমাকে বলেছে, আমি এক হতভাগী ডাইনি,’’ এএফপিকে বলছিলেন রশিদা৷ অবশ্য এতে তিনি আশ্চর্য হননি৷ কারণ, ‘‘তারাতো এই সমাজেরই অংশ,’’ চোখের পানি মুছতে মুছতে বলছিলেন তিনি৷ রশিদা থাকেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা গ্রামে৷ সুন্দরবন লাগোয়া এই গ্রামে অনেক মধু সংগ্রাহকের বাস৷
ছবি: AFP/M. Uz Zaman
মাথায় ছাদও নেই
এটি রশিদার বাড়ি৷ বাড়ির ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে যাওয়া ছাদ এখনও ঠিক করা সম্ভব হয়নি৷ রশিদার অভিযোগ, কোনো প্রতিবেশী, কিংবা সরকারের কেউ তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেননি৷ অথচ অন্যদের ঠিকই সাহায্য করা হয়েছে বলে দাবি তাঁর৷ তবে সরকারি কর্মকর্তারা রশিদার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন৷
ছবি: AFP/M. Uz Zaman
কথা বলা বারণ
এএফপি যখন রশিদার বাড়িতে যায় তখন তার পাশেই নিজের বাড়ির ছাদ ঠিক করছিলেন মোহাম্মদ হোসেন৷ পরিবারের কল্যাণের কথা চিন্তা করে তাঁর স্ত্রী তাঁকে রশিদার সঙ্গে কথা বলতে মানা করেছেন বলে এএফপির কাছে স্বীকার করেন হোসেন৷
ছবি: AFP/M. Uz Zaman
নিহতের সংখ্যা
রশিদার মতো ‘বাঘ বিধবা’দের কল্যাণে কাজ করে লেডার্স বাংলাদেশ৷ তাদের এক হিসেব বলছে, ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৫০টি গ্রামে বাঘের হামলায় অন্তত ৫১৯ জন পুরুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷
ছবি: AFP/M. Uz Zaman
দক্ষিণপশ্চিমে বেশি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঘ বিশেষজ্ঞ মনিরুল খান জানান, মধু সংগ্রাহকরা সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মধু সংগ্রহ করতে বেশি পছন্দ করেন৷ অথচ সেখানেই বাঘের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি৷
ছবি: AFP/M. Uz Zaman
পরিবর্তন আসছে, তবে...
লেডার্স বাংলাদেশের প্রধান মোহন কুমার মন্ডল জানান, তাঁরা রশিদার মতো বাঘ বিধবাদের কল্যাণে কাজ করছেন৷ তিনি বলেন, এই বিধবাদের প্রতি মানুষের মনোভাবে পরিবর্তন আসছে, তবে খুব ধীরে৷ তরুণ আর শিক্ষিত গ্রামবাসীরা বিধবাদের নিয়ে কম আশঙ্কিত বলেও জানান তিনি৷
ছবি: AFP/M. Uz Zaman
আরেক বিধবা
তাঁর নাম রিজিয়া খাতুন৷ ১৫ বছর আগে তাঁর স্বামীও মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের হামলায় প্রাণ হারান৷ গ্রামবাসীদের সহায়তা না পেলেও তাঁর এক আত্মীয় তাঁকে গোপনে সাহায্য-সহযোগিতা করে বলে জানান তিনি৷
ছবি: AFP/M. Uz Zaman
8 ছবি1 | 8
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নেচার এনভায়রনমেন্ট ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটির আধিকারিক বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবন নিয়ে কাজ করছেন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ আরও ভালো হয়েছে। সামাজিক অবস্থান নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা গিয়েছে। তাই বাঘের সংখ্যা বাড়ছে। এটা হঠাৎ কোনও ঘটনা নয়। ক্যামেরায় বেশ কিছু শাবককে দেখতে পাওয়া গিয়েছে, তা খুবই আশার কথা। তবে এই তথ্য আমরা আগেই জানতে পেরেছিলাম।''