অ্যামেরিকাবাসী এক বাঙালি কবির সঙ্গে কথা হচ্ছিল৷ বাংলাভাষায় উৎসাহ এবং পাণ্ডিত্য দুই-ই তার আছে৷ বলছিল, লেখাপত্তর ছেড়ে এবার অভিধান তৈরির কাজ হাতে নিয়েছে৷ ডিজিটাল অভিধান৷
বিজ্ঞাপন
সুদূর অ্যামেরিকায় বসে এই জিনিসটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনবোধ করেছেন তিনি৷
শিকাগো কোন ছাড়৷ কলকাতা থেকে দুই ঘণ্টার হাওয়াই দূরত্ব দিল্লিতে বসেও সময় সময় ডিজিটাল অভিধানের প্রয়োজন অনুভূত হয়৷ এমন নয় যে, বাড়িতে অভিধান নেই৷ কিন্তু বাংলাভাষার নিত্যনতুন পরিবর্তনে নানা এডিশন, নানা কিসিমের অভিধান হাতে রাখতে ইচ্ছে করে৷
গুগল খুললেই যদি ক্যামব্রিজ পেতে পারি, সংসদ নয় কেন?
আনন্দবাজার সংস্থায় যখন শিক্ষানবীশ হয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম, মনে পড়ে হাতে একটা মোটা খাম ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ যার ভিতর ‘‘কী লিখবেন, কেন লিখবেন’’ নামের একটি বই৷ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখা৷ এক অগ্রজ সাংবাদিক ঘাড়ে হাত রেখে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘‘এটা কেবল একটি বই নয়, এই সংস্থার বেদ-উপনিষদ ধরে নিতে পারো৷ বানান যেন এর মধ্যেই ধরা থাকে৷’’ পরবর্তীকালে দেখেছি, নীরেনবাবুর বেশ কিছু বানানবিধি থেকে সরে এসেছে আনন্দবাজার৷ এ নিয়ে সে সময়ের সম্পাদকের সঙ্গে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল৷ অনলাইন অভিধান তৈরির কথা হয়েছিল৷ অফিসের ভিতর অন্তত একটি শুরু করা যায় কি? জানি না, কী অবস্থায় এখন আছে সে প্রকল্প৷
কলকাতার আরো দু-একজন বন্ধু অনলাইন অভিধান তৈরির কথা ভাবছে৷ তবে সে সবই এখনো মাতৃজঠরে৷
এই লেখা লিখতে বসে এক স্কুলশিক্ষার কর্মকর্তা আর এক সম্পাদনা সংস্থার কর্তার সঙ্গে কথা হলো৷ দুইজনই অনলাইন অভিধানের প্রবল প্রয়োজনের কথা স্বীকার করলেন৷ কিন্তু প্রকাশনার কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করলেন না৷
আসলে সকলের মনেই ভয়, অনলাইন অভিধান নেট জগতে ছেড়ে দিলে পাইরেসি শুরু হয়ে যাবে না তো?
অনলাইন অভিধান দেখার একটি সুযোগ অবশ্য এখনো আছে৷ অনেকেই বিভিন্ন অভিধানের পিডিএফ নেটে ছেড়ে রেখেছেন৷ তবে তা কেবলই পিডিএফ৷ ক্যামব্রিজের মতো নয়৷
বাংলা একাডেমি কতটা ডিজিটাল
সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পে বিভিন্ন খাতকে পর্যায়ক্রমে ডিজিটাল করছে। মুজিব জন্মশতবর্ষকে সামনে রেখে বাংলা একাডেমিকেও ডিজিটালাইজ করার প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি। এ দাবি কতটা বাস্তবসম্মত? দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অনলাইনে স্টলের লটারি
বাংলা একাডেমির বিক্রয়, বিপণন ও পুনর্মুদ্রন বিভাগের পরিচালক ডঃ জালাল আহমেদ জানান, অমর একুশে বইমেলার স্টল বন্টনের ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইনে লটারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে অনিয়মের যে অভিযোগ ছিল, সেটি সম্পূর্ণ দূর হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
তথ্যকেন্দ্রের ডিজিটাল সহায়তা
বইমেলায় আগত দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি এবং সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে দুইটি তথ্যকেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে দর্শনার্থীরা এসে স্টলের অবস্থান, বইয়ের প্রকাশক, লেখক এবং দাম সম্পর্কে অনলাইনে সহজেই তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন বলে জানিয়েছেন তথ্যকেন্দ্রের কর্মকর্তা রাজীব কুমার সাহা।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অনলাইন বইয়ের তালিকা হাল-নাগাদ নয়
ওয়েবসাইটে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইয়ের তালিকায় দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধ, ফোকলোর, প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য, প্রাণিবিদ্যা, আইন শিক্ষা, সাংবাদিকতা ইত্যাদি বিষয়ে আলাদা শাখায় বইয়ের তালিকা থাকলেও ২৬ মে, ২০২১-এর পর থেকে সেটি আর হাল-নাগাদ করা হয়নি।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বইমেলার পৃথক ওয়েবসাইট
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে অমর একুশে বইমেলাকে সামনে রেখে বাংলা একাডেমি একটি ওয়েবসাইট (ba21bookfair.com) চালু করেছে। এখানে বইমেলা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য প্রকাশ ও আর্কাইভ করা হচ্ছে। এই ওয়েবসাইটে ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের তালিকা, মেলার অনুষ্ঠানসূচি, ঘোষণা ইত্যাদি সন্নিবেশিত হয়েছে।
ছবি: www.ba21bookfair.com/Bangla Academy
‘আমাদের আধুনিকীকরণের কাজ এগিয়ে চলেছে’
বাংলা একাডেমির বিক্রয়, বিপণন ও পুনর্মুদ্রণ বিভাগের পরিচালক ডঃ জালাল আহমেদ বলেন, “বাংলা একাডেমি ডিজিটালাইজেশনের কাজ আমরা অনেকদিন ধরেই করছি। তবে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। অনলাইনে আমরা বই বিক্রির উদ্যোগ গ্রহণ করেছি, আমাদের লাইব্রেরি ডিজিটালকরণের কাজ এগিয়ে চলেছে। সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যে এর সুফল ভোগ করছে। আশা করা যায়, খুব শীঘ্রই বাকি কাজগুলোও আমরা শেষ করতে পারবো।“
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অনলাইন অভিধান নেই
১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলা একাডেমির বেশ কয়েকটি অভিধান বই আকারে থাকলেও এর কোনো অনলাইন সংস্করণ নেই। বাংলা একাডেমির সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, বাংলা উচ্চারণ অভিধান, বাংলা-ইংরেজি, ইংরেজি-বাংলা অভিধানগুলোর ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এর অনলাইন সংস্করণ এখনো ছাড়া হয়নি৷ তবে বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনাধীন আছে বলে জানান বাংলা একাডেমির একাধিক কর্মকর্তা।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বাংলা একাডেমির নিজস্ব ওয়েবসাইট
বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত বাংলা একাডেমির রয়েছে একটি নিজস্ব ওয়েবসাইট (banglaacademy.gov.bd)৷ ওয়েবসাইটটিতে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ফেলোশিপ, অফিস আদেশ ও বিজ্ঞপ্তি, কর্মকর্তাদের তালিকা ও ফোন নম্বর, প্রকাশনা, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বইয়ের পিডিএফ সংস্করণ ইত্যাদি সন্নিবেশিত আছে। এছাড়া অমর একুশে বইমেলার হালনাগাদ তথ্যও এখানে পাওয়া যাবে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘অনলাইনে তথ্য থাকলে এতবার আসতে হতো না’
উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শোয়াইব আহমেদ জানান, তিনি বইমেলায় ৪ বছর ধরে আসছেন। বইমেলা কতটুকু ডিজিটাল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিবারই তিনি ৮-১০টি বই কিনেন, কিন্তু তথ্যের অভাবে একদিনে সব বই কিনতে পারেন না। এখন মানুষের হাতে হাতে ইন্টারনেট সুবিধা রয়েছে। সেক্ষেত্রে অনলাইনে যদি বইয়ের হাল-নাগাদ তথ্য দেওয়া থাকতো, তাহলে জ্যাম ঠেলে দূর থেকে বারবার এসে বই কিনতে হতো না।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বইমেলায় ডিজিটাল কেনাকাটার সুবিধা
বইমেলা ২০২২-এ অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা সংস্থা বাংলা প্রকাশ-এর বিক্রয় প্রতিনিধি সাদাত সিফাত বলেন, ‘‘গত ৩-৪ বছর যাবত আমাদের ক্রেতারা ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে বই কিনতে পারছেন। এখন যেহেতু মেলায় দর্শনার্থীদের প্রায় সবারই স্মার্ট ফোন আছে, তাই দেখা যায় বই কিনতে এসে টাকার সংকটে কাউকে পড়তে হয় না। এটি আমাদের ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক।’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘অনলাইন-অফলাইন দুটোরই দরকার আছে’
অমর একুশে বইমেলা ২০২২ এর মেলায় অংশ নেওয়া সজিব বুক কর্ণারের স্বত্বাধিকারী আহমেদ সোবহান বলেন, “বইমেলার বইসহ সব তথ্য ইন্টারনেটে পাওয়া গেলে অবশ্যই ভালো৷ তবে বইয়ের সাথে যেহেতু মানুষের সম্পর্কটা আত্মার, তাই সশরীরে এসে বই ঘেঁটে দেখার মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ আছে বলে আমি মনে করি। বইমেলার স্টলে আসা, ঘোরাঘুরি, দোকানে ভিড়, আড্ডা এই বিষয়গুলো যথেষ্ট উপভোগ করার মতো বলেই বইমেলা প্রাণের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অনলাইন টিকার সনদ
পাঞ্জেরি পাবলিকেশনের বিক্রয় প্রতিনিধি তানজিল আল-দ্বীন বলেন, ‘‘আমরা যারা স্টলে আছি, তাদের সবার কোভিড টিকা সনদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আমরা সবাই আমাদের সনদের একটি কপি অফিস কর্তৃপক্ষকে জমা দিয়েছি, পাশাপাশি অনলাইন একটি কপিও আমরা সাথে রেখেছি যেন প্রশাসন চাইলে সাথে সাথে দেখাতে পারি।’’