বর্ষার দেখা নেই৷ বাংলাদেশ থেকে আমদানি বন্ধ৷ ফলে এই মরশুমে বাঙালির ভাতের পাতে ইলিশের আকাল৷ তবে মমতা ব্যানার্জি বলছেন, আগামীতে সারা বিশ্বকে ইলিশ খাওয়াবে পশ্চিমবঙ্গ৷
বিজ্ঞাপন
আষাঢ় মাস শেষ হতে চলল, অথচ বর্ষার দেখা নেই৷ এমনকি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিও হচ্ছে না, যে বৃষ্টিতে মোহনা থেকে ইলিশ মাছের ঝাঁক উল্টো সাঁতার দিয়ে নদীতে আসে ডিম ছাড়তে৷ ছোট মাপের ইলিশ, অর্থাৎ খোকা ইলিশ ধরার ওপর ওদিকে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকারি মৎস্য দপ্তর৷ সে অবশ্য ইলিশ মাছ বাঁচাতেই৷ এদিকে প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকেও ইলিশের জোগান নেই৷ ফলে বাজারে এখনো ইলিশ মাছের দেখা নেই, যেটুকু আসছে, সবই আকারে ছোট, ওজনে কম৷ অথবা কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষিত পুরনো মাছ, যা খেতে বিস্বাদ৷
ইলিশ আসা বন্ধ হয়েছে তিস্তার জল বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগ করতে রাজি না হওয়া: ভরত সরদার
প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও বাংলাদেশের ইলিশ আসা বন্ধ হয়ে যাওয়া এই আকালের অন্যতম বড় কারণ৷ বলছেন কলকাতা শহরের মাছ বিক্রেতারা৷ গড়িয়াহাট অঞ্চলের বড় মাছ ব্যবসায়ী ভরত সর্দার৷ প্রতিবছর ইলিশের খোঁজে তাঁর দোকানে ভিড় জমান ক্রেতারা৷ এবার খুব কমই ইলিশ বিক্রি করেছেন৷ ডয়চে ভেলেকে জানালেন, মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দু-এক বছর পর থেকেই বাংলাদেশ থেকে ইলিশ আসা বন্ধ হয়েছে৷ কারণ, তিস্তার জল বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগ করতে রাজি না হওয়া৷ এই বিক্রেতারা রীতিমতো খোঁজখবর রাখেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বেশ কয়েকবার আলোচনা হওয়া সত্ত্বেও সমস্যার সুরাহা হয়নি৷ কারণ, প্রধানমন্ত্রী হাসিনা স্পষ্ট বলেই দিয়েছেন, তিস্তার জল না পেলে ইলিশ মাছও আসবে না৷
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও সম্প্রতি নিজের অপারগতার কথা জানিয়েছেন যে, তিস্তার জল যথেষ্ট নেই বলেই তিনি দিতে পারছেন না৷ নয়ত বাংলাদেশ বন্ধু দেশ, তাদের জলের ভাগ দিতে কোনো অসুবিধেই ছিল না৷ ইলিশ মাছ না থাকার প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাসের সুরে বলেছেন, আগামী দিনে সারা বিশ্বকে ইলিশ মাছ খাওয়াতে পারবে পশ্চিমবঙ্গ৷ ডায়মন্ড হারবারে রাজ্য মৎস্য দপ্তরের যে ইলিশ সংরক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র আছে, সেখানে কাজ চলছে৷ খুব শিগগিরই পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের ঢালাও ফলন হতে শুরু করবে৷
একটি মাছের ডিম থেকে কয়েক লক্ষ পোনা জন্ম নিতে পারে: প্রতাপ মুখোপাধ্যায়
ঠিক কী হচ্ছে ওই মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রে? কেন্দ্রীয় মৎস্য পালন দপ্তরের ভূতপূর্ব মুখ্য বিজ্ঞানী ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় বিস্তারিত জানালেন ডয়চে ভেলেকে৷ জানালেন, একটা সময় যেমন ধারণা ছিল, ইলিশ মাছ জীবন্ত অবস্থায় দেখাই যায় না, এখন কিন্তু সেই ইলিশ মাছই চাষ করা হচ্ছে মিষ্টি জলের পুকুরে৷ একেবারে ছোট অবস্থায় ইলিশের পোনা এনে পুকুরে ছাড়া হলে এবং তাদের নিয়মিত দেখভাল হলে মিষ্টি জলেই দিব্যি বড় হচ্ছে ইলিশ মাছ৷ তবে প্রাকৃতিক পরিবেশে মাছের পেটে যে ডিম হয়, এখনও সেভাবে তার লক্ষণ দেখা যায়নি৷ তবে গবেষণা চলছে৷
কিন্তু মিষ্টি জলে বেড়ে ওঠা নোনা জলের মাছ কি স্বাদে, গন্ধে আসল ইলিশ মাছের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে? এই প্রশ্নের জবাবে ড. মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ইলিশ মাছের স্বাদ নির্ভর করে তার শরীরে দুই ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিডের উপস্থিতির ওপর৷ এই দুটি ফ্যাটি অ্যাসিড মানব শরীরের নানা রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা রাখে৷ কিন্তু এখন মাছের স্বাদ, বা গন্ধ নিয়ে বিজ্ঞানীরা ভাবছেন না৷ বরং বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে মাছের প্রজনন হারের ওপর৷ সাধারণভাবে একটি মাছের ডিম থেকে কয়েক লক্ষ পোনা জন্ম নিতে পারে৷ তার মধ্যে ৩০ থেকে ৪০% পোনা বেঁচে থাকে৷ কিন্তু সেই পরিমাণটাই এত বেশি যে, যাঁরা মাছ চাষ করেন, তাঁদের পুষিয়ে যায়৷ আপাতত চেষ্টা হচ্ছে ইলিশ মাছের প্রজননের ক্ষেত্রে সেই সাফল্য পাওয়ার৷ তা যদি সম্ভব হয়, তা হলে মুখ্যমন্ত্রী যা বলছেন, বাস্তবেও সেটা সম্ভব হবে৷ কাজেই হতেই পারে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলার ইলিশ মাছ বিশ্ব বাজারে গিয়ে পৌঁছালো৷
ইলিশ রক্ষায় বিশ্বের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ
ইলিশকে বাংলাদেশে ‘মাছের রাজা’ হিসেবেই মানেন সবাই৷ দেশের বাইরেও পদ্মার ইলিশের অনেক কদর৷ সেই ইলিশ হারাতে বসেছিল বাংলাদেশ৷ তবে সুদিন আবার ফিরছে৷ উৎপাদন বাড়ছে৷ ইলিশ উৎপাদনে সারা বিশ্বের জন্যই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ৷
ঈদ, পুজো, পহেলা বৈশাখ- উৎসব ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক যে ধরণেরই হোক না কেন, ইলিশ ছাড়া কিন্তু বাঙালির ভোজন জমে না৷
ছবি: Imago/Z.H. Chowdhury
ইলিশে বসতি বাণিজ্য
সরকারি হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে ইলিশের অবদান ১ শতাংশ৷ আর দেশের মোট মাছের ১১ শতাংশই ইলিশ৷ বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ জেলে আছেন৷ এছাড়াও প্রায় ২০ লাখ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস ইলিশ৷ মাছ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬৫ শতাংশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে৷
ছবি: Imago/UIG
ইলিশ থেকে ওষুধ
ইলিশ খুব তেলতেলে মাছ৷ সম্প্রতি সেই তেলেরও বিশেষ এক গুণের কথা জানা গেছে৷ জানা গেছে, ইলিশ মাছে যে ‘ওমেগা-৩’ ধরনের তেল আছে, তা দিয়ে ওষুধ তৈরি করা যায়৷ হৃদরোগসহ বেশ কিছু রোগ সারানোয় ভূমিকা রাখতে পারে এই ওষুধ৷ ইতিমধ্যে ইলিশের তেল থেকে ওষুধ তৈরি করা শুরু করেছে বেশ কিছু দেশ৷
ছবি: Imago/Z.H. Chowdhury
দুঃসময়ের পদধ্বনি...
ইলিশের দুর্দিন মানে ভোজনরসিকদের দুর্ভাবনা৷ ইলিশ কমতে শুরু করায় বাংলাদেশও পড়েছিল দুর্ভাবনায়৷ তার প্রভাব এমন কিছু দেশে পড়েছিল যেসব দেশের মানুষ পদ্মার ইলিশের জন্য মুখিয়ে থাকে৷ বাংলাদেশ, ভারত বা শুধু এশিয়ার হাতে গোনা কয়েকটি দেশ নয়, ইউরোপ-অ্যামেরিকাতেও ইলিশ আজকাল পাতে উঠছে৷ যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড ও ইউরোপের কিছু দেশে ইলিশের স্যুপের জনপ্রিয়তা দিনদিন বাড়ছে৷
ছবি: Imago/UIG
সংকটের কারণ...
ইলিশ কমতে শুরু করেছিল মূলত দুটি কারণে৷ এক, অতিরিক্ত মাত্রায় মা ও জাটকা ইলিশ ধরা; দুই, ব্যাপক পরিবেশ দূষণ৷ শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশেই ইলিশ কমতে শুরু করেছিল৷ তবে খুশির কথা, ইলিশ রক্ষায় বাংলাদেশ বিশ্বের অন্য সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Chowdhury
ইলিশ রক্ষায় পদক্ষেপ
২০০২ সালের পর থেকে ইলিশ রক্ষায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ৷ ডিম পাড়া ও বিচরণের স্থান চিহ্নিত করা, বছরের আট মাস জাটকা ধরা এবং ডিম পাড়ার ১৫ দিন সব ধরনের ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করার সুফল এখন পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ৷ জেলেদের প্রতিও দেয়া হয়েছে বিশেষ মনযোগ৷ ইলিশ ধরেন এমন জেলেদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২ লাখ ২৪ হাজার জনকে পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাড়ছে ইলিশ, আসছে সুফল
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ইলিশের দুর্দিন অনেকটাই কেটে গেছে৷ ইলিশ ধরা বেড়েছে, পাশাপাশি ইলিশও বাড়ছে৷ মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও বঙ্গোপসাগর থেকে ২০০৯-১০ মৌসুমে দুই লাখ টন ইলিশ ধরা হয়, ২০১৪ সালে তা বেড়ে হয়ে যায় ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন, ২০১৫, অর্থাৎ চলতি বছর চার লাখ টন ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশা করছে মৎস্য অধিদপ্তর৷
ছবি: Imago/UIG
বাংলাদেশ সবার কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
ওয়ার্ল্ড ফিশ-এর পর্যবেক্ষণ বলছে, সারা বিশ্বে মূলত যে ১১টি দেশে ইলিশ হয় সেগুলোর মধ্যে ১০টিতেই ইলিশ কমছে, শুধু বাংলাদেশেই লক্ষণীয় মাত্রায় উৎপাদন বাড়ছে৷ বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির হার বছরে শতকরা ৮ থেকে ১০ শতাংশের মতো৷ ফলে ইলিশ রক্ষায় অনেক দেশের কাছেই বাংলাদেশ এখন ‘রোল মডেল’৷