পশ্চিমবঙ্গে এক-তৃতীয়াংশ ভোটার কি আতশকাচের নিচে?
১০ অক্টোবর ২০২৫
বিহারের পরে পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকার নিবিড় সমীক্ষা বা স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (এসআইআর) হতে চলেছে। এই লক্ষ্যে বুথ লেভেল অফিসারদের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ের কাজ সেরে ফেলেছে নির্বাচন কমিশন। তাদের ম্যাপিংয়ের ভিত্তিতে সমীক্ষার কাজ চালানো হবে।
ভোটার তালিকার ম্যাপিং
২০০২ সালে শেষ বার নিবিড় সমীক্ষা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। তার সঙ্গে এ বছরে প্রকাশিত সর্বশেষ ভোটার তালিকা মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াকেই বলা হচ্ছে ম্যাপিং।
কী দেখা হচ্ছে এই ম্যাপিংয়ে? নির্বাচন কমিশন সূত্রের খবর, এখন যে ভোটাররা তালিকায় রয়েছেন, তাদের অভিভাবকের নাম সর্বশেষ এসআইআরের সময়ে তালিকায় ছিল কিনা, সেটা দেখা হচ্ছে। অর্থাৎ একজন ভোটারের অতীতের পারিবারিক যোগসূত্র দুটি তালিকায় পাওয়া গেলে তিনি কার্যত চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছেন বৈধ ভোটার হিসেবে। তার ক্ষেত্রে নথিপত্র দাখিলের ঝক্কি বিশেষ পোহাতে হবে না। শুধু কমিশনের ফর্ম পূরণ করলেই তারা অনেকটা নিশ্চিত।
যাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো পারিবারিক যোগসূত্র দুটি তালিকায় পাওয়া যাবে না, মূলত সেই ভোটাররা কমিশনের আধিকারিকদের আতশকাচের তলায় চলে আসবেন। কমিশন নির্ধারিত নথি তাদের জমা দিতে হবে। অর্থাৎ সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকায় থাকা কোনো ভোটারের বাবা-মায়ের নাম যদি শেষ নিবিড় সমীক্ষার তালিকায় না থাকে, তাকে নথিপত্র পেশ করতে হবে।
এই ম্যাপিংয়ের কাজ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বুথ স্তরের অফিসাররা সেরে ফেলেছেন। কমিশন সূত্রের খবর, এ রাজ্যের ক্ষেত্রে ৬৫ শতাংশ মিল পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ ভোটারের তালিকায় থেকে যাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ সংশয় থাকছে না। বাকি ৩৫ শতাংশ ভোটারকে নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
চলতি বছরে প্রকাশিত ভোটার তালিকা অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গের ভোটার সংখ্যা সাত কোটি ৬৩ লক্ষ ৯৬ হাজার ১৬৫। কমিশন সূত্রের খবর, প্রায় পাঁচ কোটি ভোটারের ক্ষেত্রে ম্যাপিং মিলে যাচ্ছে। কিন্তু আড়াই কোটির বেশি ভোটারের ক্ষেত্রে পারিবারিক যোগসূত্র বা নামের মিল না থাকায় তাদের কমিশন নির্দিষ্ট শংসাপত্র দেখাতে হবে।
বিহারের পরে বাংলা
বিহারে সদ্য নিবিড় সমীক্ষার কাজ শেষ হওয়ার পরে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেশী রাজ্যে ম্যাপিংয়ের সময়ে ৮০ শতাংশ মিল পাওয়া গিয়েছিল। বাকি ২০ শতাংশ ভোটার, যাদের পারিবারিক যোগসূত্র পাওয়া যায়নি, তাদের একাংশের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই হার আরো বেশি হয় অপেক্ষাকৃত অধিক সংখ্যায় ভোটারের বাদ পড়ার আশঙ্কা কি ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেল?
পশ্চিমবঙ্গের সব জেলার ম্যপিংয়ে কিন্তু দুই-তৃতীয়াংশ ভোটারের নামের সামঞ্জস্য পাওয়া যায়নি। এটা গোটা রাজ্যের গড় হিসেব। কোনো কোনো জেলায় এই হার আরো কম। যেমন উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় যথাক্রমে ৩৫ ও ৪৫ শতাংশ মানুষের পারিবারিক যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছে। বর্তমান ও অতীতের তালিকা বিবেচনা করলে, উত্তর ২৪ পরগনার মতো বড় একটি জেলার দুই-তৃতীয়াংশ ভোটারকে তালিকায় থাকতে হলে প্রয়োজনীয় নথিপত্র পেশ করতে হবে।
বিজেপি বারবার অভিযোগ করেছে, সীমান্তবর্তী এলাকায় অনুপ্রবেশের ফলে জনবিন্যাসের তারতম্য ঘটেছে। একথা বলেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। অন্য দেশ থেকে আসা মানুষদের আধার, রেশন কার্ড তৈরি হয়ে গিয়েছে অসাধু উপায়ে। ম্যাপিংয়ের তথ্য অনুসারে, সীমান্তের লাগোয়া জেলাগুলিতে অর্ধেকের বেশি মানুষের তথ্যে সামঞ্জস্য থাকছে না। এদের নথি দেখতে চাইবে কমিশন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মইদুল ইসলাম ডিডাব্লিউকে বলেন, "উত্তর ২৪ পরগনায় অন্য দেশ থেকে আসা মানুষরা শুধু আছেন, এমনটা নয়। বিহার, উত্তরপ্রদেশের অনেক মানুষ এই জেলায় থাকেন। এদের বড় অংশ অসংগঠিত শ্রমিক। এই জনতাকে নথি দেখাতে হবে।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ডিডাব্লিউকে ভট্টাচার্য বলেন, "এত গরমিল হলে তাহলে তো বলতেই হয় কিছু একটা ঘটনা ঘটেছে। সেটা অনুপ্রবেশই হোক, বা ভুয়া ভোটার হোক, অথবা নতুন ভোটার বাইরের রাজ্য থেকে এসে সংযোজিত হয়েছে। সীমান্তবর্তী জেলায় ৬৫ শতাংশ গরমিল হয়ে যাচ্ছে, এটা ভাবা যায় না। যদি এরকম হয়ে থাকে, তাহলে তাদের প্রোফাইল দেখতে হবে। অন্য দেশের নাগরিকদের যে ডেমোগ্রাফিক ক্যারেক্টরগুলো যদি এখানে মেলে, তাহলে মনে করতেই হবে যে, একটা অনুপ্রবেশ বড় সংখ্যায় ঘটেছে।"
তিনি বলেন, "২০০২ সালে যখন নিবিড় সমীক্ষা হয়েছিল, তখন ২৮ লক্ষ মানুষ বাদ গিয়েছিল। শুভেন্দু অধিকারী বলছেন দেড় কোটি মানুষ বাদ যাবে। কিন্তু আদতে বিরোধী দলনেতা বা মুখ্যমন্ত্রী কারোরই বলার ক্ষমতা নেই, কত মানুষ বাদ যাবেন। কিন্তু এটা ঘটনা যে বহু মৃত মানুষের নাম আছে। জায়গা ছেড়ে চলে গিয়েছেন, এরকম অনেক মানুষের নাম আছে। তার সঙ্গে ভুয়া ভোটার, অনুপ্রবেশকারী তো আছেই। সুতরাং বিরাট সংখ্যক মানুষের নাম বাদ যাবে, এটা স্বাভাবিক।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "২০০২ সালের শেষ নিবিড় সমীক্ষা হয়েছিল। তখন থেকে এই ২৩ বছরে ভোটার ৬৬ শতাংশ বেড়েছে। তার মানে প্রতি বছর তিন শতাংশ হারে বৃদ্ধি। জনসংখ্যা বেড়েছে ১.৪ শতাংশ হারে। জনসংখ্যার তুলনায় ভোটার কখনোই দ্বিগুণ হারে বাড়তে পারে না। পাইলট সমীক্ষাতেই বোঝা যাচ্ছে, অনেকটা গরমিল আছে। এরপর যখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমীক্ষা হবে, তাতে আরো অনেক নাম বাদ পড়ার সম্ভাবনা থাকছে।"
তিনি বলেন, "বিহারে যদি ৪৭ লাখ বাদ পড়ে থাকে এত অল্প সময়ের মধ্যে, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে তো অনুপ্রবেশের বড় সমস্যা রয়েছে, সেখানে বাদ পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। অনুপ্রবেশকারী নিয়ে বরাবরই কেন্দ্র সরকার কড়া বক্তব্য পেশ করে আসছে। তাই এদের চিহ্নিত করা প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু এই প্রক্রিয়া শেষ করতে অনেকটা সময় লেগে যেতে পারে।"
আধারে কি রক্ষা?
কমিশন নির্দিষ্ট নথির মধ্যে আধার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। কিন্তু আধার আসল কিনা, সেটা পরীক্ষা করে দেখার অধিকার আছে কমিশনের।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, "অনুপ্রবেশ যদি ঘটে থাকে এবং আধার যদি জাল হয়, সেক্ষেত্রে একটা বিরাট অংশের ভোটার বাদ যাওয়া সম্ভাবনা থাকছে। যেহেতু নির্বাচন কমিশনের হাতে আধার যাচাই করার ক্ষমতা আছে। কমিশন যদি যথাযথ সাহায্য পায় বা ঠিকঠাকভাবে এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে পারে, তাহলে এটা নিশ্চিত যে, বহু সংখ্যক মানুষ বাদ যাবে। "
রাজাগোপালের বক্তব্য, "জনবিন্যাস বদলাচ্ছে, সে তথ্য সরকারের কাছে আছে। অনুপ্রবেশের জন্য এই জনবিন্যাস পাল্টাছে। এতে ভারত সরকার চিন্তিত। ভারতের নিজস্ব জনসমষ্টি দ্বারা যদি জনবিন্যাস পাল্টে থাকে, সেটা মানতে হবে নয়াদিল্লিকে। কিন্তু যদি অনুপ্রবেশের জন্য জনবিন্যাস পাল্টায়, তাহলে কেন্দ্রকে বাধা দিতেই হবে। সেই বাধাটাই বোধহয় নির্বাচন কমিশনের মধ্য দিয়ে আসছে।"
শীর্ষ আদালতে এই মামলার অন্যতম আবেদনকারী ছিল অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্ম বা এডিআর। সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ শাখার সঞ্চালক উজ্জয়নী হালিম ডিডব্লিউকে বলেন,
"এই ভোটার তালিকা মিলিয়ে দেখার ব্যাপারটি স্পষ্ট নয়। আমি মৌখিকভাবে একজন বুথ লেভেল অফিসারের সঙ্গে কথা বলছিলাম, যারা এ রাজ্যে নিবিড় সমীক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, তেমন একজন স্কুল শিক্ষিকা। তার নিজের ধারণাই স্পষ্ট নয় যে কাজটা কী ভাবে করতে হবে? ২০০২ এর তালিকার সঙ্গে ২০২৫ মেলালে অমিল তো থাকবেই। মৃত্যু, বিয়ের পরে নারীদের ঠিকানা বদল, কর্মসূত্রে স্থানান্তর ইত্যাদি কারণে ২৩ বছরে অনেক কিছু বদলে থাকবে। আমারই তো ২০০২-এর তালিকায় নাম এক বুথে ছিল, ২০২৫-এ আর এক বুথে।"
ম্যাপিং সম্পর্কে তিনি বলেন, "নিবিড় সমীক্ষার বিষয়টি বিহারের ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়েছে। যাদের নাম সে রাজ্যে বাদ গিয়েছে ও যেভাবে বাদ গিয়েছে, সেটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, পশ্চিমবঙ্গে কী হতে চলেছে। তবে এসআইআরের নামে ম্যাপিং প্রক্রিয়া গোলমেলে। এ বিষয়ে জনগণকেও কোনো তথ্য বা পরামর্শ নির্বাচন কমিশন দিচ্ছে না। জনসচেতনতা খুব দরকার।"
ভোটার তালিকায় সংস্কারের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করার পক্ষপাতী নয় বিরোধীরা। মইদুল বলেন, "ভুলভ্রান্তি হতে পারে যদি দ্রুততার সঙ্গে সমীক্ষার কাজ করা হয়। সাতদিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে, এমন নির্দেশ জারি করলে তালিকা নির্ভুল করা যাবে না। খসড়া তালিকা যদি জানুয়ারিতে বের করা যায়, অসুবিধা কী আছে। সেক্ষেত্রে তিনমাস সময় পাওয়া যাবে। ভোট তো এপ্রিলের আগে হচ্ছে না।"