পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর আতঙ্ক কমছে না কেন?
১৩ নভেম্বর ২০২৫
নভেম্বরের গোড়া থেকে রাজ্যে শুরু হয়েছে ভোটার তালিকার স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (এসআইআর)। ৪ নভেম্বর থেকে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন বুথ লেভেল অফিসাররা (বিএলও)। এরই মধ্যে প্রায় রোজ অস্বাভাবিক মৃত্যু খবর সামনে আসছে।
একের পর এক মৃত্যু
সমীক্ষার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সাড়ে ছয় কোটি এনুমারেশন ফর্ম বিলি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন। ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে এই ফর্ম পূরণ করে জমা দিতে হবে। তার পরে প্রকাশিত হবে খসড়া ভোটার তালিকা।
ফর্ম নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন বিএলওরা। এই পরিস্থিতিতে এসআইআর আতঙ্কে একের পর এক মানুষ আত্মঘাতী হচ্ছেন বলে মৃতের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। একই সুর শোনা যাচ্ছে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের গলায়।
বুধবার সকালে একটি মৃত্যুর ঘটনা সামনে আসে। উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরের বাসিন্দা সুমন মজুমদার আত্মঘাতী হয়েছেন। তার মায়ের বক্তব্য, মঙ্গলবার তাদের বাড়িতে ফর্ম দেয়া হয়েছে। ২০০২ এর ভোটার তালিকায় তাদের নাম নেই। কী ভাবে কাগজপত্র জোগাড় করবেন, তা নিয়ে চিন্তায় ছিলেন সুমন।
এত মানুষের মৃত্যুর আগেই অবশ্য তৃণমূল এই সমীক্ষা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। একের পর এক আত্মহত্যায় প্রতিবাদের ঝাঁজ বেড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সমীক্ষার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন।
উত্তরকন্যার সাংবাদিক বৈঠকে মমতা বলেছেন, "সবার ভোটে নাম থাকার অধিকার আছে। কারণ তারা এ রাজ্যের বৈধ ভোটার। ১৪ জন মারা গিয়েছেন, কিন্তু নির্বাচন কমিশন থেকে কোনো শোকবার্তা দেয়া হয়েছে? কেন অসমে হচ্ছে না এসআইআর? হলেই তো হারবে। তিনটে বিরোধী রাজ্যে হচ্ছে। কিন্তু ডাবল ইঞ্জিন সরকারের রাজ্যে হচ্ছে না। এর জন্য নাকি আলাদা আইন? কেন হবে?"
দীর্ঘ হচ্ছে তালিকা
উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গে প্রায় রোজ এসআইআর আতঙ্কে মৃত্যুর দাবি শোনা যাচ্ছে। জলপাইগুড়ির প্রবীণ নরেন্দ্রনাথ রায় থেকে হাওড়ার উলুবেড়িয়ার ঠিকা শ্রমিক ২৮ বছরের জাহির আলি, উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত কাকলি ঘোষ থেকে হুগলির শেওড়াফুলিতে যৌনকর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যুতে এসআইআর আতঙ্কের কথা উঠে এসেছে।
দক্ষিণ দিনাজপুরের কুমারগঞ্জের বৃদ্ধ ওসমান মোল্লা থেকে বীরভূমের বিমান প্রামাণিক, মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের তারক সাহা কিংবা কান্দির মেহুল শেখ, সবাই গত দিন দশকের মধ্যে মারা গিয়েছেন।
এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে আত্মহত্যা চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন। যেমন উত্তর ২৪ পরগনার খড়দার আকবর আলি। এক্ষেত্রেও পরিবার দাবি করেছে, তিনি সমীক্ষা শুরু হওয়ার আগে থেকে মানসিক চাপে ছিলেন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৃতেরা প্রবীণ। এদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কথা জানা যাচ্ছে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের দাবি, সমীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকে তারা ভয়ে ছিলেন। সেই কারণে এ পথ বেছে নিয়েছেন। যদিও বিভিন্ন বয়সের ও পেশার মানুষরা এই তালিকায় রয়েছেন, যাদের ক্ষেত্রে একই ধরনের দাবি শোনা যাচ্ছে।
রাজ্যে রাজ্যে সমীক্ষা
পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি অনেকগুলি রাজ্যে ভোটার তালিকার সমীক্ষার কাজ চলছে। নির্বাচন কমিশন একসঙ্গে ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এসআইআরের কথা ঘোষণা করেছিল।
কিছুদিন আগে বিহারে সমীক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এ নিয়ে সে রাজ্যের শাসক ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে তুমুল তরজা এখনো থামেনি। সেখানে বহু লক্ষ ভোটারের নাম বাদ পড়েছে। যদিও আত্মহত্যার ঘটনা বা এমন দাবি সামনে আসেনি।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিজেপি নেতা সুকান্ত মজুমদার সংবাদ মাধ্যমে বলেন, "১২টি রাজ্যে এসআইআর হচ্ছে। তাহলে সব রাজ্যেই তো মৃত্যু হত। আসলে ওখানে কোথাও তৃণমূল নামে কালসর্প দোষ নেই। এটা পশ্চিমবঙ্গে আছে বলে এখানে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। ভোটার তালিকায় নাম না থাকলে সর্বোচ্চ কী হতে পারে? ভোট দিতে পারবেন না। এটা মানুষকে বোঝাচ্ছি।"
আইনি লড়াই
এসআইআর সংক্রান্ত বিরোধ পৌঁছে গিয়েছে আদালতে। পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ু থেকে পৃথকভাবে ছয়টি আবেদন জমা পড়েছে সুপ্রিম কোর্টে। এই রাজ্যের তৃণমূলের মতো তামিলনাড়ুর শাসকদল ডিএমকে মামলা করেছে। মামলাকারীদের মধ্যে রয়েছে সিপিএম, পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসও।
মঙ্গলবার এসব মামলার শুনানি হয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সূর্যকান্ত ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চে। তারা মামলাকারীদের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, ভোটার তালিকার নিবিড় সমীক্ষা দেশে কি প্রথমবার হচ্ছে? আপনারা এত চিন্তা করছেন কেন?
মামলাকারীদের পক্ষ থেকে নানা যুক্তি উঠে আসে। অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে সমীক্ষা শেষ করার চেষ্টা, সমীক্ষার জন্য বেছে নেওয়া সময়কাল, বৈধ ভোটারের নাম বাদ পড়ার আশঙ্কা, নাগরিকত্ব যাচাইয়ে কমিশনের এক্তিয়ার-সহ নানা বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবীরা।
এই শুনানি চলাকালীন আদালতের বক্তব্য, "আপনারা কেন এত আশঙ্কা করছেন? আদালত আপনাদের যুক্তিতে সন্তুষ্ট হলে এই প্রক্রিয়া বাতিল করে দেবে।" এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে তাদের বক্তব্য পেশ করতে বলেছে শীর্ষ আদালত। ২৬ নভেম্বর বিশদে শুনানি হবে।
নেতৃত্বের দায়
পশ্চিমবঙ্গে একটা আতঙ্কের আবহ তৈরি হওয়ার পিছনে শাসক ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায় আছে বলে রাজনৈতিক মনে করছেন।
বিজেপি নেতা ও পর্যবেক্ষক বিমলশংকর নন্দ ডিডাব্লিউকে বলেন, "পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় বিস্তর গরমিল রয়েছে, এটা বাস্তব। এই তালিকার ভিত্তিতে এর আগে সিপিএম, এখন তৃণমূল কংগ্রেস ভোটে জিতে আসছে। এই তালিকায় যে ভুয়ো নাম রয়েছে বা যারা বাইরে থেকে এসে এখানে বেআইনিভাবে বসবাস করছেন, তাদের নাম বাদ পড়লে শাসকের অসুবিধা হবে। এজন্য তৃণমূল এটাকে আটকানোর চেষ্টা করছে। এসআইআর নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্যই সব মৃত্যুই আতঙ্কের জন্য বলে দাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। নোট বাতিলের সময়ও এমন মৃত্যুর ঘটনা সামনে রেখে রাজনীতি হয়েছিল। কুযুক্তি দেয়া হয়েছিল। সেটাই আবার দেখা যাচ্ছে। সাধারণ মৃত্যুকে এসআইআরের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হচ্ছে।"
সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি যে তৈরি হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই বিভ্রান্তিকে বাড়িয়েছে রাজ্য বিজেপির অনেক নেতার প্রচার বা তাদের বিভিন্ন বক্তব্য। তার জেরেই মানুষ আত্মঘাতী হয়েছেন। যারা এখনো পর্যন্ত আত্মঘাতী হয়েছেন, তাদের বাড়ির লোকের অভিযোগ, ভোটার লিস্টে নিজেদের নাম না পেয়ে তারা আত্মঘাতী হয়েছেন। ফলে অভিযোগের তিরটা রাজ্য বিজেপি নেতাদের দিকেই বেশি উঠছে। আমি মনে করি এতে বিজেপির রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষতি হচ্ছে। বিজেপির নিজের ভোট ব্যাংকে সমস্যা হবে।"
অন্য রাজ্যে মৃত্যু হচ্ছে না কেন? সুমন বলেন, "পশ্চিমবঙ্গের মতো অন্য রাজ্যের বিজেপি নেতারা এমন প্রচার করছেন না যে, দুই কোটি মানুষের নাম বাদ যাবে। পুশব্যাক করা হবে, জেলে পোরা হবে, এ ধরনের প্ররোচনামূলক বক্তব্য রাখছেন না।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল রিপোর্ট চেয়ে পাঠানো যে, কারা আত্মহত্যা করেছেন, তাদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কী বলছে। তাহলে জানা যেত প্রকৃত তথ্যটা কী। যদি দেখা যেত যে, তারা অন্য কারণে আত্মহত্যা করেছেন, কিন্তু বলা হচ্ছে এসআইআরের কারণে আত্মহত্যা, সেক্ষেত্রে কমিশনের একটা ভূমিকা থাকত। এমনকী রাজ্যের রিপোর্টে অসঙ্গতি থাকলে তা ধরা পড়ত।"
তিনি বলেন, "জনসংখ্যার থেকে ভোটার তো বাড়তে পারে না। তাই এসআইআর করা খুবই দরকার। সেই জায়গায় বিরোধী এবং শাসক দল, উভয়কেই অনেক দায়িত্বশীল হতে হত।"
মনো সমাজকর্মী মোহিত রণদীপ ডিডাব্লিউকে বলেন, "ভোটাধিকারের সঙ্গে নাগরিকত্বের সম্পর্ক আছে, এটা অনেকে মনে করছেন। আগামী দিনে যখন এনআরসি হবে, আসামে যেভাবে ডিটেনশন ক্যাম্পে লক্ষাধিক মানুষকে রাখা হয়েছে, এখানেও সেরকম হবে? এই অনিশ্চয়তা মানুষকে আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে। নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলি এই আতঙ্ক দূর করার কোনো চেষ্টা করেনি। কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসক দল উভয়ই আতঙ্কটাকে জিইয়ে রাখতে চাইছে। অন্য কারণে মৃত্যু হলেও এখন এসআইআরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "আমাদের দেশে মানুষ সঠিকভাবে ডকুমেন্টেশন করতে পারেন না। প্রয়োজনে সব নথি খুঁজে নাও পেতে পারেন। পুরো বিষয়টার মধ্যে বিবেচনাবোধের অভাব আছে। নির্বাচন কমিশনের এই পদক্ষেপ অনেকটা রাজনৈতিক। ভোটার তালিকা সংশোধন ও এসআইআরের মধ্যে কোথাও একটা তফাৎ আছে। এসআইআরের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হচ্ছে ২০০২-এর ভোটার তালিকা। এর পিছনে রাজনৈতিক স্বার্থ কাজ করছে, যার উদ্দেশ্য একটা অস্থিরতা তৈরি করা। এতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হবে, ভোটের মেরুকরণ হবে। এসবের দায়িত্ব রাজনীতির মানুষজনেরই।"