পশ্চিমবঙ্গের রামপুরহাটে নৃশংসতার বলি নারী ও শিশুরা৷ তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে বলে অভিযোগ৷ পশ্চিমবঙ্গে নারী-শিশুদেরও রেহাই দিচ্ছে না রাজনৈতিক দুষ্কৃতীরা!
বিজ্ঞাপন
বীরভূমের রামপুরহাটের একটি বাড়ি থেকে মঙ্গলবার সকালে অগ্নিদগ্ধ মানুষদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়৷ উদ্ধারকারী দমকল কর্মী আজিজুল হক জানান, তারা ১০টি পোড়া দেহ উদ্ধার করেছেন৷ তবে রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালব্যর দাবি, সাতটি দেহ মিলেছে ওই বাড়ি থেকে৷ এই সংখ্যা নিয়ে ধন্দ যেমন কাটেনি, তেমনই সংশয় রয়েছে নিহতদের নাম-পরিচয়ের ক্ষেত্রেও৷ দেহ এতটাই পুড়ে গিয়েছে যে, তা শনাক্ত করতে সমস্যা হয়েছে৷ মৃতদের মধ্যে দুই শিশু ছিল, তা নিশ্চিত৷ ধন্দ থাকলেও গোড়া থেকেই অনুমান করা হচ্ছে, বাকি মৃতদের সকলেই মহিলা, কেননা এলাকার পুরুষরা আগেই প্রাণভয়ে গ্রাম ছেড়েছিলেন৷
রামপুরহাটে নৃশংসভাবে নারী ও শিশু হত্যা প্রসঙ্গে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেত্রী ঐশী ঘোষ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীকে এর দায় নিতে হবে৷ তিনি মহিলা বা শিশু কেন, কোনো মানুষকেই নিরাপত্তা দিতে পারছেন না৷ ঘটনার পর তড়িঘড়ি সিট গঠন করে দেওয়া হচ্ছে৷ তাতে সুবিচার মিলছে না৷ আনিস খান, তুহিনার ক্ষেত্রে যা হলো, রামপুরহাটেও আমরা তার পুনরাবৃত্তি দেখতে চলেছি৷’’
পুরুষরা গোষ্ঠী সংঘর্ষে যুক্ত, তারা মহিলা ও শিশুদের রেহাই দিচ্ছে না: সুদেষ্ণা রায়
পশিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াইয়ের জেরে এই ভয়াবহ ঘটনা৷ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখ খুন হওয়ার পরপরই বগটুই গ্রামেই তার বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা সঞ্জু শেখের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়৷ তবে এই ঘটনাকে শুধু রাজনীতির সঙ্গে জুড়ে দেখতে চাইছেন না অভিনেত্রী, চিত্র পরিচালক সুদেষ্ণা রায়৷ রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশনের অন্যতম সদস্য সুদেষ্ণার বক্তব্য, ‘‘এ ক্ষেত্রে রাজনীতির থেকেও যেটা বলার বিষয়, খুবই অমানবিক এই ঘটনা৷ পুরুষরা গোষ্ঠী সংঘর্ষে যুক্ত, তারা মহিলা ও শিশুদের রেহাই দিচ্ছে না৷ দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত৷ আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে রিপোর্ট চেয়েছি৷ প্রশাসনের কাছ থেকে সদুত্তর না পেলে আমরা সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখতে যাবো৷’’
পশ্চিমবঙ্গে এক দশকের বেশি সময় ধরে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তার আমলে চালু হয়েছে একাধিক সরকারি প্রকল্প যাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নারীদের৷ কন্যাশ্রী থেকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, নানা প্রকল্পের ‘ফোকাস’ মহিলারা৷ নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এই প্রকল্পগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে বলে রাজ্য সরকারের দাবি৷ সেখানে নারী ও শিশুদের পুড়িয়ে হত্যা কী বার্তা দিচ্ছে? ভারতের সবচেয়ে বড় সংবাদপত্র গোষ্ঠী টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র প্রাক্তন সম্পাদক শিখা মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দুষ্কৃতীরা প্রশাসনকে পরোয়া করছে না৷ হিংসার সময় মহিলা-শিশুদের পালিয়ে যাওয়ারও সুযোগ দিচ্ছে না৷ নারী ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রীর প্রকল্পকে আমি সমর্থন করি৷ সেই রাজ্যে আবার নারীরাই আক্রান্ত হচ্ছেন৷ এই বিপরীত ছবি কেন, তার জবাব মুখ্যমন্ত্রীকেই দিতে হবে৷’’
আমাদের দেশে নারী-শিশু-বৃদ্ধ, এই ‘অশক্ত’ মানুষরা সাব-টার্গেট হন: সুনন্দা মুখোপাধ্যায়
এক সময় পশ্চিমঙ্গ ছিল ভারতের নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র৷ আঠেরো-উনিশ শতকে স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর সহমরণের রীতি ছিল৷ হিন্দু পরিবারে সদ্যবিধবা নারীকে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় ফেলে দেওয়া হতো৷ এই বর্বর প্রথা বিলোপে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নবজাগরণের পুরোধাপুরুষ রামমোহন রায়৷ বাংলায় সতী প্রথা অতীত, আজ ঘরে-বাইরে নারী সমাজের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো৷ কিন্তু প্রান্তিক, গ্রামীণ ক্ষেত্রে নারীদের সেই জাগরণ কি আজও অধরা? নারী আন্দোলনের কর্মী, রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের দেশে নারী-শিশু-বৃদ্ধ, এই ‘অশক্ত’ মানুষরা সাব-টার্গেট হন৷ রামপুরহাটেও তাই হয়েছে৷ তারা রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হলেও আক্রমণের মুখে পড়েন৷ নারী ভোটাধিকার পেয়েছে, পদাধিকার পেয়েছে, কিন্তু সঠিক অর্থে নারীমুক্তি আসেনি৷’’
শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী মিরাতুন নাহারের বক্তব্য, ‘‘রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য মানুষের হিংসা প্রবৃত্তিকে পুঁজি করে৷ তার বলি হয় সাধারণ মানুষ৷ নারীরা যেহেতু এখনো এ দেশে অসহায়, তাই তারা যে কোনো হিংসার সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন৷’’ এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ কী? গণপ্রতিরোধই পথ, মনে করেন বাংলার নারী সমাজের অগ্রণী অংশের প্রতিনিধিরা৷ তারা মনে করেন, এই প্রতিরোধের সামনের সারিতে থাকতে হবে নারীকেই৷
রামপুরহাটে নৃশংসতা : কার কী প্রতিক্রিয়া?
সোমবার রাত থেকে অগ্নিগর্ভ বীরভূমের রামপুরহাট৷ বাতাসে এখনও পোড়া লাশের গন্ধ৷ অভিযোগ, বগটুই গ্রামে পর পর বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে৷ বিচারপতি থেকে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী, কে কী প্রতিক্রিয়া জানালেন এই ঘটনায়?
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কলকাতা হাইকোর্টের বক্তব্য
রামপুরহাটের বগটুইয়ের ঘটনাকে ‘খুব শকিং’ বলে মন্তব্য করেছেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব৷ তার কথায়, ‘‘এটি একটি মারাত্মক অপরাধ৷ দোষীদের কাউকে ছাড়া হবে না৷’’ বগটুইয়ের ঘটনার সঙ্গে গোধরা-কাণ্ডের তুলনা করলেন এক আইনজীবী। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট তলব করল কলকাতা হাইকোর্ট৷
ছবি: DW/P. Tewari
কংগ্রেসের মামলা
রামপুরহাট কাণ্ডে হাই কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছে কংগ্রেস৷ বীরভূমে মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে ৩৫৫ ধারা প্রয়োগ করার সময় এসে যাচ্ছে৷আমি এই কথাটা রাষ্ট্রপতির কাছে জানাবো৷’’
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
বাধার মুখে বামফ্রন্টের বিচার দাবি
বুধবার বাম প্রতিনিধিদলকে নিয়ে বীরভূমের রামপুরহাটে ঢুকতে গেলে বাধা দেয়া হয় পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুকে৷ প্রতিবাদে অবস্থানে বসেছিলেন প্রবীণ বাম নেতা৷ তিনি বলেন, ‘‘গণহত্যায় যুক্তদের বিচার হওয়া উচিত জনগণের দরবারে৷’’
ছবি: UNI
‘জামাই মারা গিয়েছে’
বগটুইয়ে পুলিশের বাধায় পড়ে তীব্র ক্ষোভপ্রকাশ করেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম৷ বেসরকারি সংবাদপত্রের প্রতিনিধিকে তিনি জানান, ‘‘নানুরে আমার বন্ধুর ছেলে এখানকার জামাই হয়ে এসেছে৷ দু’মাস আগে ওদের বিয়ে হয়েছে৷ আমাকে এখানে আটকানো হচ্ছে, কিন্তু এই ঘটনায় আমার জামাই মারা গিয়েছে, সেই ঘরটা দেখতে চাই৷’’
ছবি: Satyajit Shaw/DW
‘‘কাশ্মীরের মতো ঘটনা’’
রামপুরহাটের ঘটনায় পুলিশ মন্ত্রীরও দায়িত্বে থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ দাবি করে মঙ্গলবার থেকেই সরব বিজেপি৷ বুধবার বকটুইয়ে যান বিজেপি বিধায়করা৷বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ পশ্চিমবঙ্গের এক বেসরকারি চ্যানেলকে বলেন, ‘‘কাশ্মীরের মতো ঘটনা এটি৷ পুলিশ হতে দিয়েছে বলেই এমন ঘটনা ঘটলো৷ কেন জনপ্রতিনিধি খুন হওয়া সত্ত্বেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়নি?’’
ছবি: IANS
রাজ্যপালের চিঠি
রামপুরহাটের ঘটনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়৷ চিঠিতে তিনি লেখেন, রাজভবনে চুপ করে বসে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়৷ তিনি এই ঘটনার পর নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারেন না৷ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মন্তব্য উদ্ধৃত করে রাজ্যপাল লেখেন ‘‘পশ্চিমবঙ্গে শাসকের আইন আছে, আইনের শাসন নেই৷’’
ছবি: Prabakhar/DW
কবিতা উৎসবে সুবোধ
কবি ও অধ্যাপক সুবোধ সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি সংবাদমাধ্যম যোগাযোগ করেছিল৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি তো এখন কবিতা উৎসবে৷বিষয়টা আমি জানিও না৷ বলতে পারবো না৷ রামপুরহাটে কোথায়? কখন ঘটলো?আমাকে বিষয়টা দেখতে হবে৷’’
ছবি: DW/P. Samanta
নীরব কবীর সুমন
ওই বেসরকারি চ্যানেল যোগাযোগ করেছিল সংগীতশিল্পী কবীর সুমনের সঙ্গে৷ তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন,‘‘মার্জনা করবেন৷ আমি কোনো ব্যাপারে কোনো মত দেবো না৷ আপনার মঙ্গল হোক৷’’
ছবি: privat
শুভাপ্রসন্নের নিন্দা, মমতা-স্তুতি ও সন্দেহ
ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূলের দিকে আঙুল উঠেছে৷ রামপুরহাট প্রসঙ্গে চিত্রকর শুভাপ্রসন্ন বললেন, ‘‘এটা একটা ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা৷ মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়৷ তবে এটা কতটা সৌভাগ্য যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যে অনেক কিছু ভালো হচ্ছে৷ নানারকমভাবে বিরোধীরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে৷’’ (ওপরে যোগেনের সঙ্গে শুভাপ্রসন্ন)
ছবি: DW
টলিউডে ‘তাদের’ কৌশল
রামপুরহাট নিয়ে কিছু বলার নেই- টলিউড তারকা দেব এমনটাই জানিয়েছেন বেসরকারি সংবাদমাধ্যমকে৷ মেদিনীপুর বিধায়ক তথা টলিউডের অভিনেত্রী জুন মালিয়া ফোনে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘শুটিংয়ে ব্যস্ত৷ কথা বললে ফ্লোরে বকা দেবে৷’’ টলিউড অভিনেতা কাঞ্চন মল্লিক জানান, তিনি শটের মধ্যে রয়েছেন, পরে কথা বলবেন৷ ভূতের ভবিষ্যৎ সিনেমার পরিচালক অনীক দত্তর বক্তব্য, ‘‘বুদ্ধিজীবী শব্দটি খারাপ শব্দ৷ গালিগালাজের সমান এই বাংলায়৷’’
ছবি: Creative Commons
মমতার কথা
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রামপুরহাটের বগটুইয়ের ঘটনায় দোষীরা শাস্তি পাবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন৷ নিরপেক্ষভাবে তদন্ত হবে বলেও দাবি তার৷ বৃহস্পতিবার তিনি রামপুরহাট যাবেন৷
ছবি: Satyajit Shaw/DW
আবার জ্ঞানবন্ত..
আনিস হত্যাকাণ্ডের মতো রামপুরহাটকাণ্ডের তদন্তভারও দেয়া হয়েছে আইপিএস জ্ঞানবন্ত সিংকে৷ তার নেতৃত্বে ‘সিট’ গঠন করেছে রাজ্য সরকার৷ জ্ঞানবন্তের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিজেপি নেত্রী, আইনজীবী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল৷ রিজওয়ানুর রহমান হত্যার ঘটনায় জ্ঞানবন্তের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কথা উল্লেখ করে আনিস হত্যার পর রামপুরহাটকাণ্ডের তদন্তভারও জ্ঞানবন্তকে দেয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন তিনি৷