টেট পাস করেও চাকরি না পেয়ে কলকাতায় বিক্ষোভ চলছে। তার মধ্যেই টেট পরীক্ষা হলো। সেখানে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ।
শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে প্রতিবাদ কলকাতায়। ছবি: Subrata Goswami/DW
বিজ্ঞাপন
রোববার পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতামান পেরোনোর পরীক্ষা ছিল। সেই পরীক্ষা শুরুর একঘণ্টার মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার অভিয়োগ উঠলো। পরীক্ষা দিয়ে বেরোবার পর পরীক্ষার্থীরা জানালেন, তারা যে প্রশ্নপত্র পেয়েছেন, তার সঙ্গে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন হুবহু এক।
রাজ্যের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানিয়েছেন, তিনি পর্ষদের কাছে রিপোর্ট চেয়েছেন। তবে সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যম সূত্রে তিনি জেনেছেন, পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর কয়েকজন পরীক্ষার্থী প্রশ্নপত্র সামাজিক মাধ্যমে দেন। তাতে কারো কোনো অসুবিধা হয়নি। পরীক্ষা নির্বিঘ্নে হয়েছে।
পর্ষদের উপসচিব পার্থ কর্মকার বলেছেন, ''পরীক্ষা শুরু হয় বেলা বারোটার সময়। একটার একটু পরে সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠে বলে শুনেছি। এতে কোনো পরীক্ষার্থীর কোনো অসুবিধা হয়নি।'' তিনি বলেছেন, ''পর্যদের গায়ে কালি লাগাতে কিছু অসাধু মানুষ এই কাজ করতে পারে।''
কলকাতায় চাকরির জন্য বিক্ষোভ
কলকাতা হলো বিক্ষোভের শহর। হাজারো দাবি নিয়ে অসংখ্য বিক্ষোভ হয়েছে ও হচ্ছে এখানে। চাকরির দাবিতে সাম্প্রতিক কিছু বিক্ষোভ নিয়ে এই ছবিঘর।
ছবি: Satyajit Shaw,/DW
শিক্ষকের চাকরির দাবিতে
২০১৬ সালে শিক্ষক হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন তারা। অভিযোগ, শিক্ষক নিয়োগের জন্য চাকরির পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়েও চাকরি হয়নি। কম নম্বর যারা পেয়েছে, তাদের চাকরি হয়েছে। তাই কলকাতায় গান্ধীমূর্তির সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন তারা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
নারী বিক্ষোভকারী
বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অনেকেই নারী। দেড় মাসের বেশি সময় ধরে খোলা আকাশের নীচে চলছে তাদের অবস্থান-বিক্ষোভ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শিশুকে সঙ্গে নিয়ে
শিশুকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের বিক্ষোভ। বিক্ষোভস্থলেই শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছেন তিনি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিক্ষোভকারীদের দাবি
বিক্ষোভকারীদের দাবি, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়েছে। তারা চাকরি পাওয়ার জন্য পরীক্ষা দিয়েছেন। ভালো নম্বর পেয়েছেন। তাও চাকরি পাননি দুর্নীতির জন্য। তারা সেই চাকরি চান।
ছবি: Satyajit Shaw,/DW
গান্ধী মূর্তির কাছে
গান্ধীজির মূর্তির কাছেই বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন শিক্ষক পদপ্রার্থীরা। গান্ধীজির দেখানো অহিংস পথেই তাদের বিক্ষোভ।
ছবি: Satyajit Shaw,/DW
মমতাও করেছিলেন
গান্ধী মূর্তির কাছে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বিধানসভা ভোটের আগে। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে। তিনি চেয়ারে বসে শুধু ছবি এঁকেছিলেন। এখন তার সরকারের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে গান্ধী মূর্তির পাশে বসে।
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
পার্শ্ব শিক্ষকদের বিক্ষোভ
দীর্ঘদিন ধরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন পার্শ্বশিক্ষকরা। কিছুদিন আগে সল্টলেকের বিকাশ ভবনের বিক্ষোভে চারজন শিক্ষিকা বিষ পর্যন্ত খেয়েছিলেন। সরকার তাদের বেতন বাড়ানোর কথা বললেও, তাদের স্থায়ী নিয়োগের দবি মানেনি। আন্দোলন চলবে বলে জানাচ্ছন তারা। উপরের ছবিটি অতীতে পার্শ্ব শিক্ষকদের বিক্ষোভের।
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
নার্সদের বিক্ষোভ
সম্প্রতি নার্সদের বিক্ষোভ দেখেছে কলকাতা। বেতন পরিকাঠামো নিয়ে তাদের ক্ষোভ রয়েছে। তাছাড়া সমান কাজের জন্য সমান বেতন, বদলির ক্ষেত্রে অনিয়ম সহ নানা দাবিতে তারা বিক্ষোভ দেখান।
ছবি: Satyajit Shaw,/DW
হাইকোর্টের নির্দেশে বন্ধ
কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে নার্সরা বিক্ষোভ বন্ধ রেখেছেন। আদালতে সরকার জানিয়েছে, মন্ত্রী ও সচিবরা বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখছেন। আদালত এক মাস দেখবে সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়। ৩ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী শুনানি হবে। ততদিন বিক্ষোভ বন্ধ রাখতে হবে।
ছবি: Satyajit Shaw,/DW
অপেক্ষায় নার্সরা
নার্সরা এক মাস অপেক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাজ্য সরকার ও হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের জন্য তারা অপেক্ষা করবেন। দরকার হলে পরে আবার রাস্তায় নামবেন বলে জানিয়েছেন তারা।
ছবি: Satyajit Shaw,/DW
10 ছবি1 | 10
পরীক্ষার্থীদের বক্তব্য
পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে পরীক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, সামাজিক মাধ্যমে যে সব প্রশ্ন ধুরছে, সেগুলি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গেছে।
পরীক্ষার্থী প্রলয় রায় আনন্দবাজারকে বলেছেন, ''মোবাইল নিয়ে যেতে দেয়া হয়নি, জলের বোতল নিয়ে যেতে দেয়া হয়নি। এত কড়া সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল। তারপরেও কী করে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়?''
এই সময়কে একাধিক নারী পরীক্ষার্থী জানিয়েছেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন এবং তারা যে প্রশ্নপত্র হাতে পেয়েছেন, তা হুবহু এক। ইপ্সিতা সাহার বক্তব্য, ''চাকরি নেই। এখন প্রশ্ন ফাঁস করছে। মানুষ প্রতিবাদ করতে গেলে মার খাচ্ছেন। এই তো হবে। হল থেকে বের হয়ে ভয়ংকর ঘটনা।'' ২০২২ সালে টেট পাস এক পরীক্ষার্থী বলেছেন, তারা পরীক্ষা দিচ্ছেন এবং প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে এটা মানা যায় না। টালিগঞ্জের স্বান্তনা মণ্ডল ইটিভি ভারতকে জানিয়েছেন, ''গত বছর পাস করা কেউ চাকরি পাননি। নোটিফিকেশন জারি হয়নি। আমরা চাই, সকলে চাকরি পান।''
পর্যদ জানিয়েছে, প্রায় দুই লাখ ৬৭ হাজার পরীক্ষার্থী রোববার টেট পরীক্ষা দিয়েছেন।
বিরোধীদের বক্তব্য
রাজ্যের বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেছেন, ''টেটের প্রশ্নপত্র বাইরে বিক্রি হয়েছে। তবে যতই পরীক্ষা হোক, চাকরি হবে না।''
বিক্ষোভকারী কমেছে, তাও প্রতিবাদ চলছে
কলকাতায় শহিদ মিনারের কাছে একধিক প্রতিবাদ চলছে। একটি তো প্রায় নয়শ দিন ধরে। এখন কেমন সেই প্রতিবাদের চেহারা?
ছবি: Subrata Goswami/DW
সবচেয়ে বেশিদিনের প্রতিবাদ
২০১৬ সালে তারা শিক্ষক হওয়ার পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন। তারপরেও চাকরি পাননি। কারণ, নিয়োগ-দুর্নীতি। অভিযোগ, পয়সা দিয়ে অযোগ্য প্রার্থীরা চাকরি পেয়ে গেছেন। প্রায় ৮৮০ দিন ধরে তারা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। আগে এই বিক্ষোভে প্রচুর মানুষ আসতেন। এখন দেখা যাচ্ছে মাত্র একজনকে। কোনো দিন আরো কিছু বিক্ষোভকারী আসেন। কিন্তু আগের মতো প্রতিদিন এক-দেড়শ মানুষের বিক্ষোভ হয় না।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ডিএ আদায়ের দাবিতে
একই হাল বকেয়া মহার্ঘভাতা বা ডিএ আদায়ের জন্য গঠিত সংগ্রামী যৌঘ মঞ্চের। সেখানে কয়েকজন বসে-শুয়ে আছেন। একটা সময় এই মঞ্চও গমগম করত। প্রচুর মানুষ বিক্ষোভ দেখাতে আসতেন। উৎসাহ-উদ্দীপনা তুঙ্গে ছিল। এখন আর সেই ছবি নেই।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সিসিটিভি ক্যামেরা
যৌথ সংগ্রামী মঞ্চে সিসিটিভি ক্যামেরা বসেছে। কারা আসছেন, কী করছেন, তার উপর নজর রাখার জন্য। বিশেষ করে বহিরাগতরা যাতে ঢুকে কিছু করতে না পারে, তার জন্য বেশি করে এই সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অর্থ চাই
এই আন্দোলন টিকিয়ে রাখার জন্য অর্থের আবেদনও জানানো হয়েছে। রাখা হয়েছে ইউপিআইয়ের কিউআর কোড। যা স্ক্যান করে মানুষ পয়সা দিতে পারবে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
টেট-বিক্ষোভের একই হাল
যারা টেট পরীক্ষায় পাস করেও চাকরি পাননি, তারা আলাদা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। টেট মানে টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট। যা পাস করলে প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর জন্য শিক্ষকের চাকরি পাওয়া যায়। এখানেও বিক্ষোভকারীর সংখ্যা কমেছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কেন এই অবস্থা?
সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, শিক্ষকরাই তাদের মঞ্চে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আসতেন। এখন স্কুল খুলে গেছে। পরীক্ষা চলছে। প্রশ্নপত্র থেকে খাতা দেখার কাজ আছে। তাই শিক্ষকরা সেভাবে আসতে পারছেন না। অন্য অনেকে ব্যস্ততার জন্য আসতে পারছেন না।
ছবি: Subrata Goswami/DW
দীর্ঘ আন্দোলনের প্রস্তুতি
অনিরুদ্ধের দাবি, দীর্ঘ আন্দোলনের প্রস্তুতি তারা নিয়েছেন। অগাস্টে তারা দুইটি কর্মসূচি হাতে নিচ্ছেন। ১৪ অগাস্ট তাদের বিক্ষোভের দুইশ দিন পূর্ণ হবে। তখন একটা কর্মসূচি হবে। অগাস্টের প্রথম সপ্তাহেও একটা কর্মসূচি নেয়া হবে। তিনি স্বীকার করেছেন, সকলের একইরকমভাবে লেগে থাকার মানসিকতা থাকে না।
ছবি: Subrata Goswami/DW
উৎসাহ কমছে
মধ্যমগ্রামের অভিষেক সেন স্বীকার করে নিয়েছেন, মানুষের উৎসাহ কমেছে। আগের মতো তাই বিক্ষোভকারী আসছেন না।
ছবি: Subrata Goswami/DW
এভাবে কতদিন?
কল্যানীর তনয়া বিশ্বাস বললেন, এভাবে আর কতদিন চলা যায়? পেট তো চালাতে হবে। কিছু না কিছু কাজ করতে হচ্ছে। তাই আন্দোলনে আর প্রতিদিন আসা যায় না। সবকিছু ছেড়ে যারা আন্দোলনে ঝাঁপিযে পড়েছিলেন, তারা এখন এই কঠোর বাস্তবের সামনে পড়েছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
তবু প্রতিবাদ চলছে
মানুষ আগের মতো আসতে পারছেন না। তা সত্ত্বেও প্রতিবাদ থেমে যায়নি। চলছে। প্রতিটি প্রতিবাদমঞ্চে অল্প হলেও মানুষ আসছেন। আগের মতো রোজ প্রত্যেকে আসতে পারেন না। কিন্তু প্রতিবাদের আগুন নিভে যায়নি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
10 ছবি1 | 10
রাজ্য সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ''পশ্চিমবঙ্গে টাকার বিনিময়ে চাকরি হয়, টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন বিলি হয়, টাকার বিনিময়ে চাকরি হয়।'' সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ''তৃণমূল সরকার একটা পরীক্ষাও স্বচ্ছ্বতার সঙ্গে নিতে পারেনি।''
বামেদের জোটশরিক আইএসএফের নেতা নওসাদ সিদ্দিকি জানিয়েছেন, ''এই রাজ্য তৃণমূল ক্ষমতায় থাকলে ঠিকভাবে স্বচ্ছ্ব নিয়োগ হবে না। এই দলই দুর্নীতিগ্রস্ত।''
'নিয়োগ না করে শুধু পরীক্ষা কেন?'
প্রবীণ সাংবাদিক আশিস গুপ্ত বলেছেন, ''শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। কিন্তু নিয়োগের পরীক্ষা হচ্ছে। নয় বছর ধরে চাকরি পাননি এমন প্রার্থী রাস্তায় বসে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। গত বছরও পরীক্ষা হয়েছে, চাকরি হয়নি। এই বছরও পরীক্ষা হলো। তাতে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগও উঠলো।''
তার মতে, ''আসলে পরীক্ষার নিয়ম মানা হলো ঠিকই, কিন্তু যারা পাস করছে, তাদের চাকরির নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছে না। একটা আনুষ্ঠানিকতার পর্যায়ে বিষয়টি চলে গেছে। এত বিতর্ক, আইনি লড়াই, প্রতিবাদের পরেও নিয়োগ না হওয়ার ফলে গোটা শিক্ষাব্যবস্তার উপরই আঘাত এসে পড়ছে।''