পশ্চিমবঙ্গে দাপট বাড়ছে সিন্ডিকেটের
২৩ এপ্রিল ২০২২সিন্ডিকেট শব্দের আভিধানিক অর্থ যাই হোক, কালক্রমে তা অপরাধ ও আতঙ্কের সমার্থক হয়ে উঠেছে৷ ১২ এপ্রিল বেহালা থানার চড়কতলায় এলাকা দখল ও সিন্ডিকেটের বরাত পাওয়া নিয়ে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়৷ ১৮ এপ্রিল তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের লেক গার্ডেনসের পাড়ায় একটি বাড়ি ভাঙাকে কেন্দ্র করে সিন্ডিকেটের গোষ্ঠী সংঘর্ষ হয়৷ তার পরের দিন ফের বাঁশদ্রোণীতে সিন্ডিকেট বিবাদে গুলি চলে৷
কেনো এই বিবাদ?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গোষ্ঠী সংঘর্ষের মূলে রয়েছে রাজনৈতিক সমীকরণ৷ ক্ষমতায় যখন যে থাকে, তার হাত ধরেই বাড়তে থাকে সিন্ডিকেটের প্রভাব-প্রতিপত্তি৷ কিন্তু ভোটে সেই সমীকরণ বদলে গেলে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ ও লভ্যাংশ ঘিরে বাঁধে গোষ্ঠী বিবাদ৷ স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশ-প্রশাসন সব জানে৷
এর জবাবে প্রাক্তন পুলিশ কর্তা সলিল ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আগে যেমন রাজনীতিবিদ-দুষ্কৃতী আঁতাঁত ছিল, এখন তেমন রাজনীতির সঙ্গে দুষ্কৃতীরা একেবারে জড়িয়ে গিয়েছে৷''
প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিক পঙ্কজ দত্ত বলেন, ‘‘একটা দল যখন গণতান্ত্রিক কাঠামোতে শাসন করে তখন তার বেশ কিছু স্তর থাকে৷ সেই একাধিক স্তরে বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকারীরাও থাকে৷ একটি দলের সম্পূর্ণ হতে এই সমস্ত স্তরের প্রয়োজেন৷ তবে সুসংগঠিত দলে কখনোই সিন্ডিকেটের অংশটি খুব শক্তিশালী হওয়া উচিত নয়৷''
শুধু শহরে নয়, জেলায় জেলায় সিন্ডিকেটের দাপট দেখা যাচ্ছে৷ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাম আমলে সিন্ডিকেট ছিল, তার রমরমা ক্রমশ বাড়ছে৷ রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ক্ষেত্রে সিমেন্ট-বালি-স্টোন চিপসের মতো ইমারতি দ্রব্যের সরবরাহ থেকে বালি-পাথর খাদান কিংবা জমি, সর্বত্রই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কেনাবেচা চলে৷
কিন্তু এর জেরে নদীর ঘাটও পর্যন্ত বেহাত হয়ে যাচ্ছে৷ হুগলির গোঘাট এলাকার কুমারগঞ্জে দ্বারকেশ্বর নদের ঘাটকে মানুষজন চেনেন চুরির ঘাট হিসেবে৷ রাতে এখান থেকে বালি চুরি হয় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের৷ খনি শিল্পাঞ্চল আসানসোলেও একই চিত্র৷ সেখানে অবৈধ খনি থেকে কয়লা কিংবা কারখানার পরিত্যক্ত সামগ্রী চুরি ও পাচার ঘিরেও রয়েছে সিন্ডিকেট৷ বেআইনি ভাবে পুকুর ভরাট, মাটি কাটার কাজেও সক্রিয় সিন্ডিকেট৷ আবার উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে সিন্ডিকেট মানে সরকারি জমি বেদখল৷ সেই জমি আবার উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শুভময় মৈত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ফ্ল্যাটবাড়ি ব্যক্তিমালিকানা থেকে সৃষ্ট সম্পদ যেমন, তেমনই নদী, বালিখাদান বা কয়লাখাদানের মালিকানা রাষ্ট্রের৷ রাষ্ট্র যদি এই প্রাকৃতিক সম্পদগুলি সঠিকভাবে বিতরণ করতে পারে, তাহলে গরিব মানুষের সুবিধা হয়৷ কিন্তু যখন সেটা প্রাইভেট কোম্পানি বা সিন্ডিকেটের হাতে চলে যায়, তখন একটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়৷ মালিকের কাছে বেশি টাকা চলে যায় আর গরিব মানুষ আরও গরিব হয়৷
পেশা যখন সিন্ডিকেট!
সিন্ডিকেটের ব্যবসা ও সেই সংক্রান্ত হিংসার জন্য বিরোধীরা শাসক দলের দিকে আঙুল তুলেছে৷ তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ দাবি করেছেন, এই গোষ্ঠী সংঘর্ষের সঙ্গে রাজনীতির কোনো যোগ নেই৷ যদিও এই দাবি খারিজ করে দিয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন পুলিশ কর্তা নজরুল ইসলাম৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সিন্ডিকেট মানে হচ্ছে করে-খাওয়া৷ আপনি বাড়ি তৈরি করলে আমার কাছ থেকে সিমেন্ট-বালি নিতে হবে৷ বাড়ি ভাঙলে আমি দর ঠিক করে দেব৷ এটাই সিন্ডিকেটের আসল কথা৷''
তার মতে, ‘‘শাসক দলের সঙ্গে যোগ না থাকলে এভাবে একচেটিয়া ব্যবসা করা যাবে না৷ এদের কাছে বেআইনি অস্ত্র থাকলেও পুলিশ ধরবে না৷ সিন্ডিকেটের টাকার ভাগ রাজনীতিতে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছায় বলে এতো দাপট৷''
পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, কর্মসংস্থান ক্রমশ সঙ্কুচিত হওয়ায় তরুণ, যুবারা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন রোজগারের আশায়৷
শুভময় মৈত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কোভিড এবং তার পরবর্তীতে গোটা পৃথিবীর অবস্থাই সুবিধের নয়৷ পশ্চিমবঙ্গও তার থেকে আলাদা নয়৷ পশ্চিমবঙ্গেও মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে, সাধারণ মানুষ বিপদে পড়ছেন৷ সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে মানুষকে কাজ খুঁজতে হচ্ছে৷ সম্পদের সীমাবদ্ধতায় সাধারণ মানুষ কাজ খুঁজতে চেষ্টা করলে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়৷''
তার বক্তব্য, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে বিপুল শিল্প হচ্ছে, এমনটাও নয়৷ ফলে শহরের বুকে নির্মাণের সৌজন্যে যে সম্পদ তৈরি হচ্ছে, তার ভাগ নেওয়ার চেষ্টাতেই সংঘাত দেখা যাচ্ছে৷''
এই শ্রেণি বিকল্প কর্মসংস্থান খুঁজে পেলে সিন্ডিকেটে কিছুটা লাগাম পরানো যাবে বলে অনেকের দাবি৷ শুভময় মৈত্র বলেন, ‘‘পুলিশ প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে৷ যদি সেখানেই গোলমাল থাকে, দুর্নীতি ঢুকে যায়, তাহলে সমস্যা বাড়বে৷''