পশ্চিমবঙ্গে নিরাপত্তা ছাড়াই ভোটার সমীক্ষায় নামছেন শিক্ষকরা
৩ নভেম্বর ২০২৫
সুরক্ষার প্রশ্ন তুলছেন বুথ লেভেল অফিসাররা (বিএলও)৷ তারা প্রতিটি ভোটকেন্দ্র বা বুথের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা৷ বিএলওরা সাধারণত সরকারি স্কুলের শিক্ষক, পঞ্চায়েত কর্মকর্তা বা অন্যান্য নিম্নপদস্থ সরকারি কর্মচারী হন৷
পয়লা নভেম্বর শনিবার থেকে শুরু হয়েছে বিএলও-দের প্রশিক্ষণ৷ এসআইআর সমীক্ষায় এরাই মূলত ফিল্ড ওয়ার্ক করবেন, অর্থাৎ বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের তথ্য যাচাই করবেন৷ প্রশ্ন উঠছে, তাদের ছাড়া কীভাবে স্কুল চলবে? উত্তপ্ত রাজনৈতিক আবহাওয়ায় তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবে?
সুরক্ষার দাবি
প্রশিক্ষণে বিএলওদের বোঝানো হচ্ছে, তারা কীভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমীক্ষার কাজ করবেন৷ কলকাতা থেকে জেলায় অনুষ্ঠিত শিবিরগুলিতে জেলা প্রশাসনের কাছে একঝাঁক প্রশ্ন তুলে ধরেছেন বিএলওরা৷ এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশ্ন৷
কলকাতার নজরুল মঞ্চে বিএলওদের প্রশিক্ষণ শিবির চলছে৷ শনিবার ফিল্ড কর্মীদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন আলিপুরের মহকুমা শাসক৷ সেখানে তিনি বিএলওদের অজস্র প্রশ্নের মুখে পড়েন৷ শুধু কলকাতা নয়, জেলায় জেলায় বিএলওরা এমনই প্রশ্ন তুলে ধরেছেন প্রশিক্ষকদের কাছে৷ যদিও এসব প্রশ্নের উত্তর ছিল না তাদের কাছে৷ প্রশাসনের কর্তাদের বক্তব্য, তারা নির্বাচন কমিশনকে বিষয়টি জানাবেন৷
এসআইআর ঘোষণার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সরগরম৷ একের পর এক অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা উত্তাপ বাড়িয়েছে৷ এসব মৃত্যুর জন্য এসআইআর আতঙ্ক দায়ী বলে দাবি করেছে তৃণমূল কংগ্রেস৷ সর্বশেষ ঘটনা সামনে এসেছে শনিবার৷
পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের বাসিন্দা বিমান সাঁতরার মারা গিয়েছেন তামিলনাড়ুতে৷ তিনি সেখানে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন৷ ২৬ অক্টোবর ৫১ বছরের বিমান হাসপাতালে ভর্তি হন৷ সেখানেই ৩০ অক্টোবর তার মৃত্যু হয়৷ ধানজমিতে কাজ করার সময়ে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন৷ পরিবারের দাবি, এসআইআর নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন প্রৌঢ়৷ এ কারণেই অসুস্থ হয়ে পড়েন৷
এরই মধ্যে মঙ্গলবার ভোটাধিকার রক্ষার দাবিতে রাস্তায় নামছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ পাল্টা তৃণমূলকে আক্রমণ করছে বিজেপি৷ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেছেন, বিএলওরা সমস্যায় পড়লে তিনি পাশে দাঁড়াবেন৷
সমীক্ষা নিয়ে এই চাপানউতোরের ফলে ক্রমশ চাপে পড়ে যাচ্ছেন বিএলওরা৷ তারা নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবি তুলছেন৷
রানিচক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাম মুর্মু বিএলও হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন৷
তিনি বলেন, ‘‘অন্যান্য রাজ্যে তো এই সমস্ত সমস্যা হচ্ছে না৷ আমাদের রাজ্যেই শুধু হচ্ছে৷ নির্বাচন কমিশনকে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিযুক্ত করতে হবে৷ নইলে নিরাপত্তা কোথায়? বিএলওদের হুমকি দেয়ার রাজনীতি শুরু করেছেন যারা, তারা কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলে সতর্ক হবেন৷''
দক্ষিণ ২৪ পরগনার লক্ষ্মীকান্তপুর এলাকায় বিএলও হিসেবে কাজ করছেন স্কুল শিক্ষক রাইহান মোল্লা৷ তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের যেহেতু স্থায়ী কর্মী নেই, তাই এই সমস্যার সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা কম৷ স্কুল থেকে ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরে যে শিক্ষকের বাড়ি, তিনি স্কুল থেকে ফিরে আবার ভোটার লিস্টের কাজ করবেন কী ভাবে? মহিলা বিএলওদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরো বেশি৷ আশা করছি কেন্দ্রীয় বাহিনী এলে সমস্যার সমাধান হবে৷''
ভোটকর্মী ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক স্বপন মণ্ডল ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘বিএলওদের সুরক্ষার কথা বলা হলেও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি৷ এ নিয়ে লিখিত অর্ডার জারি হয়নি৷ মঙ্গলবার থেকে ফিল্ড ওয়ার্ক শুরু হচ্ছে৷ সুতরাং আগামীকাল, সোমবার বিকেলের মধ্যে নির্দেশিকা জারি করতে হবে৷''
এছাড়াও আরো দুই দফা দাবিতে মুখ্য নির্বাচনি আধিকারিককে চিঠি পাঠিয়েছে মঞ্চ৷ তিনি বলেন, ‘‘অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের বিএলও হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে৷ নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী, এটা করা যায় না৷ এরা সকলেই চুক্তিভিত্তিক কর্মী৷ কোনো চুক্তিভিত্তিক কর্মীকে বিএলওর কাজ করানো যাবে না৷ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা কাজ করলে তার সুবিধে পাবে শাসক দল৷ এদের বিএলওর ডিউটি থেকে অব্যাহতি দিতে হবে৷ এছাড়া যে কর্মীরা নিজেদের কর্মক্ষেত্র ছেড়ে সমীক্ষার কাজ করবেন, তাদের অন ডিউটি দেখাতে হবে৷ সে ব্যাপারে ধোঁয়াশা রয়েছে৷ এই বিষয়গুলি জানিয়ে আজই আমরা সিইও দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছি৷''
স্কুলে শিক্ষা সংকট
রাজ্যে ৮০ হাজারের বেশি বুথ রয়েছে৷ প্রতি বুথে ভোটারদের কাছে যেতে হবে বিএলওদের৷ শিক্ষক সংগঠনের দাবি, বিএলও হিসেবে কমিশন যাদের নিযুক্ত করেছে, তাদের ৯০ শতাংশ স্কুলের শিক্ষক৷ অর্থাৎ ৮০ হাজারের বিএলওকে সমীক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে, তার ৭০ হাজার স্কুল শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত৷
সোমবারও বিএলওদের প্রশিক্ষণ চলবে৷ তাই স্কুল ছেড়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে থাকতে হবে শিক্ষকদের৷ মঙ্গলবার থেকে শুরু হবে বাড়ি বাড়ি যাওয়া৷ সেদিন থেকে এনিউমারেশন ফর্ম বিলি করবেন বিএলওরা৷ এই ফর্ম পূরণ করতে হবে ভোটারদের৷ এজন্য সমীক্ষকদের ভোটারের দরজায় দরজায় ঘুরতে হবে৷
পুজোর দীর্ঘ বিরতির পরে গত সপ্তাহের শনিবার স্কুল খুলেছিল৷ ছট পুজোর ছুটি পার করে বুধবার থেকে স্কুল খোলে৷ কিন্তু এর মধ্যেই শিক্ষকদের কাঁধে এসে পড়েছে নিবিড় সমীক্ষার দায়িত্ব৷ পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে যখন পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, সব স্কুলে সেই সময়ে নির্বাচনের কাজ পড়ুয়াদের পঠনপাঠনকে আরো অনিশ্চিত করে তুলেছে৷
শিক্ষক সংগঠনগুলির দাবি, সমীক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে কোনো স্কুল থেকে তিন কোথাও পাঁচ কোথাও বা সাত-আট জন শিক্ষককেও নেয়া হয়েছে৷ কিন্তু অনেক স্কুলেই এই সংখ্যক শিক্ষকই নেই৷ কোথাও বিএলওর কাজ করতে যাওয়ার ফলে মাত্র একজন কিংবা দুজন শিক্ষক স্কুলে পড়ে থাকছেন৷
উচ্চ মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে বাড়তি সমস্যা বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের নিয়ে৷ কোথাও হয়তো বিজ্ঞান বা দর্শনের শিক্ষককে বিএলওর কাজের জন্য কমিশন নিযুক্ত করেছে৷ এর ফলে ওই বিষয়ে পড়ানোর জন্য স্কুলে আর কেউ থাকছেন না৷ এই পরিস্থিতিতে দ্বাদশ শ্রেণির চতুর্থ সেমিস্টারের পঠন-পাঠন কীভাবে শেষ হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে৷
এই সমস্যার সমাধানে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ ইউটিউব ভিডিওর মাধ্যমে পঠনপাঠন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে৷ কিন্তু এটা ক্লাসরুমে পড়াশোনার বিকল্প হতে পারে না বলে মত পড়ুয়া ও অভিভাবকদের বড় অংশের৷
পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়ার বিবেকানন্দ বিদ্যাভবনের প্রধান শিক্ষক হরিদাস ঘটক ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘পড়াশুনোর দিকে কারো নজর নেই৷ নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে রাজ্য এবং কেন্দ্রের শাসক দল, সকলেই ভোটকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় গুরুত্ব দিচ্ছে৷ কিন্তু সমাজ যে ছাত্রছাত্রীদের হাত ধরে বিকশিত হবে, সেটা নিয়ে ভাবার সময় কারো নেই৷''
রাম বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন প্রথমে বলেছিল, শিক্ষকদের কোনো কাজ করতে হবে না৷ পরে বলেছে শিক্ষকদের স্কুলেও যেতে হবে, আবার বিএলওর কাজ করতে হবে৷ কর্মস্থল থেকে বাড়ির দূরত্ব যাদের বেশি, তাদের পক্ষে স্কুল ছুটির পরে এই কাজ করা কষ্টসাধ্য৷ এতে যে কোনো একটা দিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ যে শিক্ষকের ক্লাস থাকছে, তিনি ক্লাস নিতে না পারলে অন্য কেউ এসে তার অভাব পূরণ করতে পারবেন না৷ তাহলে পড়ুয়াদের কী হবে? তারা পিছিয়ে যাচ্ছে৷ তাদের মধ্যে ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বাড়ছে৷''
হরিদাস বলেন, ‘‘আমি দেখেছি, এমনও প্রাথমিক স্কুল আছে যেখানে প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকাকে বিএলও হিসেবে নিযুক্ত করা দেয়া হয়েছে৷ সেই স্কুলে পড়াশোনাটা হবে কী করে? স্কুলটা প্রায় এক মাস বন্ধ৷ এতে শিক্ষা ব্যবস্থা, সমাজ ভেঙে পড়বে৷ এর বিকল্প ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশন বা সরকারকে ভাবতে হবে৷ অন্য অনেক সরকারি কর্মচারী আছেন যারা বসে আছেন, তাদের নেওয়া হোক৷ শিক্ষকদের উদ্বৃত্ত ভাবার কারণ কী, জানি না৷''
শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক কিংকর অধিকারী ডিডাব্লিউ কে বলেন, ‘‘এ ব্যাপারটা নিয়ে আমরা অনেকদিন ধরেই নির্বাচন কমিশনে ডেপুটেশন দিয়েছি বিক্ষোভ দেখিয়েছি৷ রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী শিশুদের শিক্ষার অধিকার রয়েছে৷ একদিকে রাষ্ট্র বলছে শিশুদের শিক্ষার অধিকার আছে, অন্যদিকে সেই রাষ্ট্র বলছে শিক্ষকদের পড়ানো বাদ দিয়ে অন্য কাজ করতে৷ সেজন্যই আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি, কেন বিএলওর ডিউটির জন্য শিক্ষকদের তুলে নেয়া হবে৷ এতে যে শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ আমরা দাবি জানিয়েছি নির্বাচন কমিশনের কাছে, যাতে শিক্ষকদের নিরাপত্তার লিখিত প্রতিশ্রুতি তারা দেয় এবং ভবিষ্যতে এই কাজের জন্য স্থায়ী কর্মী নিয়োগ করে৷ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যখন-তখন শিক্ষা বহির্ভূত কাজে যেন না লাগানো হয়৷’’