1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
বিচার ব্যবস্থাভারত

পশ্চিমবঙ্গে বিচারের আগেই আক্রমণের শিকার হচ্ছেন অভিযুক্তরা

১৪ জুন ২০২৫

আদালতে যাওয়ার পথে হামলা চালানো হলো হাওড়ায় তরুণীকে নিগ্রহ ও পর্নোগ্রাফি চক্র চালানোয় অভিযুক্ত শ্বেতা খানের ওপর। একই ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে অন্য নানা মামলায় অভিযুক্তের ক্ষেত্রেও।

পর্নোগ্রাফি করানোর চেষ্টার অভিযোগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দুজন গ্রেপ্তার
এক তরুণীকে অত্যাচার করে পর্নোগ্রাফি করানোর চেষ্টার অভিযোগে শ্বেতা ও আরিয়ান খানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।ছবি: Satyajit Shaw/DW

বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে আইনের দৃষ্টিতে যেকোনো অভিযুক্তই নির্দোষ হিসাবে বিবেচিত হন। কিন্তু সমাজের একাংশ কি এর আগে নিজেই বিচার করে ফেলছে? এর পেছনে কি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি দায়ী, নাকি অন্য কোনও কারণও রয়েছে নেপথ্যে?

চলতি সপ্তাহে গ্রেপ্তার করা হয় শ্বেতা ও তার পুত্র আরিয়ান খানকে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সোদপুরের এক তরুণীকে নিজেদের হেফাজতে রেখে টানা নির্যাতন চালিয়ে গিয়েছেন তারা।

শ্বেতার ওপর হামলা

বৃহস্পতিবার শ্বেতাকে আদালতে পেশ করা হয়। তাকে যখন পুলিশের গাড়ি থেকে নামানো হয়, সেই সময় বিক্ষোভ দেখান সেখানে জড়ো হওয়া কিছু মানুষ। নিজেদের তৃণমূল কর্মী বলে দাবি করেন তারা। পুলিশ ঘেরাটোপে অভিযুক্তকে নিয়ে যাওয়ার সময়ে তাকে থাপ্পড় মারেন এক নারী, যিনি নিজেকে তৃণমূলের যুবনেত্রী বলে দাবি করেছেন।

কেন থাপ্পড় মারা হল শ্বেতাকে? জমায়েতে উপস্থিত আব্দুস সালাম নিজেকে সাবেক তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য বলে দাবি করে প্রশ্ন তোলেন, কেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছবি তুলে সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন শ্বেতা? তার বক্তব্য, "আমি বহু বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত। কোনো দিন শ্বেতাকে তৃণমূল করতে দেখিনি। কেন তিনি তৃণমূল নেতার সঙ্গে ছবি পোস্ট করে দলকে বদনাম করবেন? ওর কঠোর শাস্তি চাই।"

শ্বেতাকে থাপ্পড় মারা নারীরও দাবি তাই। তিনিও একই সুরে প্রশ্ন তোলেন, কেন তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়েছেন শ্বেতা? রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের সাবেক মন্ত্রী। তিনি হাওড়া জেলার বিধায়ক ছিলেন। মাঝখানে বিজেপিতে যোগ দেন। পরে আবার তৃণমূলে ফিরে আসেন।

শ্বেতা ও তার ছেলের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। সোদপুরের তরুণীর দাবি অনুযায়ী, হাওড়ার বাঁকড়ার ফ্ল্যাটে শ্বেতা তাকে আটকে রেখেছিলেন দিনের পর দিন। পর্নোগ্রাফি ভিডিওতে অভিনয় করানোর জন্য চাপ দিয়েছিলেন। শ্বেতার ছেলে আরিয়ান ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থায় চাকরি দেয়ার ফাঁদ পেতে তাকে ডেকে আনেন। এরপরই শুরু হয় নির্যাতন। তরুণী ফ্ল্যাট থেকে পালানোর পরে সামনে আসে সমগ্র ঘটনা।

দুজনকেই গ্রেপ্তার করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। কিন্তু অভিযোগ এখনও প্রমাণিত হয়নি। শ্বেতা ও আরিয়ান তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

অভিযোগ প্রমাণের আগেই জনতার আদালতে বিচার হয়ে যাচ্ছে কিনা, এই প্রশ্নও উঠেছে জোরেসোরে।

অতীতেও বিভিন্ন অভিযোগে যখন কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের আদালতে পেশের সময় বা অন্যত্র এভাবেই নিগ্রহের মুখে পড়তে হয়েছে। কাউকে শুনতে হয়েছে 'চোর' স্লোগান, কাউকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়েছে জুতো।

সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গে দুটি ভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও সন্দীপ ঘোষের ক্ষেত্রেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল।

নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় রাজ্যের সাবেক মন্ত্রী পার্থর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। তাকে গ্রেপ্তার করে কেন্দ্রীয় সংস্থা। জোকা ইএসআই হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় শারীরিক পরীক্ষার জন্য। সেখান থেকে বেরোনোর মুখে পার্থকে লক্ষ্য করে জুতো ছুড়েছিলেন শুভ্রা ঘোড়ুই।

আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সাবেক অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। আদালতে পেশ করার সময়ে সন্দীপ ঘোষকে চড় মেরেছিলেন এক বিক্ষোভকারী। আর একবার তাকে লক্ষ্য করে উড়ে আসে জুতো।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক ছাত্র স্বপ্নদ্বীপ কুন্ডুর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। র‍্যাগিংয়ের জন্য তার মৃত্যু বলে অভিযোগ ওঠে। একাধিক পড়ুয়াকে এই ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়। প্রিজন ভ্যান থেকে নামিয়ে একে একে যখন ধৃতদের আদালতের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন নারী আইনজীবী এক অভিযুক্তকে থাপ্পড় মারেন।

ন্যায়-অন্যায়ের বিচার যেখানে হয়, সেই আদালতের সামনেও নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। নিগ্রহকারী হিসেবে অভিযোগ উঠেছে আইনজীবীদের একাংশের বিরুদ্ধে। কিছুদিন আগে কলকাতা হাইকোর্টের সামনে নিগ্রহ করা হয় ইউটিউবার রোজিনা রহমানকে। তার সহকারী সাংবাদিকের ক্যামেরা কেড়ে নেওয়া হয়।

এই প্রবণতাকে বিপজ্জনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আইনজীবী ফিরদৌস শামীম ডিডাব্লিউকে বলেন, "জনগণ নিজের হাতে আইন তুলে নিলে আমাদের যে ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ বিচারের পরে শাস্তি দেয়ার বিধান ব্যাহত হয়। দুটো জিনিস হতে পারে। জনগণের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হতে পারে প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার জন্য। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আর একটা গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা ঠিকঠাক থাকলে মানুষ মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় না। প্রশাসনিক গাফিলতি কমাতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে মানুষের আস্থা থাকবে প্রশাসনের উপরে।"

তৃণমূলপন্থী পর্যবেক্ষক ভাস্কর সিংহরায় বলেন, "কোনো অভিযুক্তের উপরে আক্রমণ হওয়া কাম্য নয়। এটা পুলিশ–প্রশাসন নিশ্চয়ই দেখবে। তবে এ ধরনের আক্রমণ মানে সেটা সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মাপকাঠি নয়। শ্বেতা খানের ক্ষেত্রে অভিযুক্তের প্রতি তিক্ততার জন্য কিছু মানুষ বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলার সম্পর্ক নেই। কোনো অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হয়। সেটা দেখে সমগ্র রাজ্যের পরিস্থিতি বিচার করা যায় না। কিন্তু ব্যক্তিগত স্তরে হলেও, এরকম আক্রমণ মোটেই ঠিক নয়। দলের কোনো সমর্থক যদি কোথাও বিক্ষোভ দেখায়, তার অর্থ এই নয় যে, এর প্রতি দলের সমর্থন আছে।"

অ্যাডভোকেট ফিরদৌস শামীম

This browser does not support the audio element.

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের বিভাগীয় প্রধান সুহৃতা সাহা ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘"বিচার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে বিচার পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন, স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে কী হচ্ছে আমরা সেটা দেখেছি। মানুষ পুলিশকে গিয়ে মারধর করছে। পুলিশের কোনো কোনো কাজ মানুষের পছন্দ হচ্ছে না। এক্ষেত্রে প্রশাসনের পাশাপাশি মানুষেরও দোষ আছে। বিচার ব্যবস্থা যা–ই বলুক, প্রশাসন আমাদের দেশে বেশি শক্তিশালী। আদালত বলে দিলেও সেই অনুযায়ী কাজ হয় না। এটা সাধারণ লোককে ক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে হয়তো।"

তার বক্তব্য, "আর জি কর আন্দোলনের সময় সন্দীপ ঘোষকে চড় মারা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে সেটা মারা উচিত হয়নি। কিন্তু, আইনশৃঙ্খলা কী করে এমন জায়গায় যায় যে আরজি করে একজন ডাক্তারকে গিয়ে কেউ ধর্ষণ করে।"

তার মতে, "সামাজিক মাধ্যমের দরুণ চারপাশে অশান্তি, উত্তেজনা বেশি করে ছড়িয়ে পড়ছে। সেটা যেমন অস্থিরতা বাড়িয়েছে, তেমনই মানুষকে কর্মবিমুখ করে তুলেছে। মানুষ চটজলদি ফল প্রত্যাশা করছে। ফলে বিচার ব্যবস্থার উপর দীর্ঘ মেয়াদে আস্থা রাখতে পারছে না। শ্বেতা খান সন্দীপ ঘোষ যা–ই করুক না কেন, আইন–আদালত বিচার না করা পর্যন্ত আমাদের তো তাদের মারধর করার অধিকার নেই। সভ্যতা বলে কি আমাদের কিছু নেই! আমরা বেশিরভাগই ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বাস করি।"

মনো-সমাজকর্মী মোহিত রণদীপ ডিডাব্লিউকে বলেন, "এই ধরনের অপরাধ যারা করেন, তারা কোনো না কোনোভাবে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত মানুষের কোনো শাস্তি হবে না, তারা দিব্যি বেরিয়ে যাবেন, মানুষের মধ্যে এই ধারণা দৃঢ় হতে শুরু করেছে। আইন, বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে। এটা বাস্তবতা। কেস ঠিকভাবে না সাজানোর কারণে অপরাধী অনেক সময়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে মানুষের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হচ্ছে, সে হতাশা থেকে রাগ প্রতিফলিত হচ্ছে তাদের আচরণে।"

তিনি বলেন, "সাধারণ মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে। খুব সাধারণ কারণে অন্য কাউকে চড়–থাপ্পড় চালিয়ে দেওয়াটা খুব সহজ হয়ে গিয়েছে। এটা কোনো সভ্য সমাজের নিদর্শন হতে পারে না। আদালত চত্বরে এই ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, সেটা আইনের মাধ্যমে ঠিক করতে হবে। অপরাধীদেরও নিরাপত্তা প্রয়োজন হয় বিচার ব্যবস্থা সুস্থভাবে পরিচালনা করার জন্য। এরকম যদি চলতে থাকে, তাহলে অনেক গুরুতর অপরাধে আসল অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যেতে পারে। জনরোষের নাম দিয়ে এরকম ঘটলে খুব একটা আশ্চর্য হব না।"

মানবাধিকার কর্মী রঞ্জিত শূরের বক্তব্য, "যতক্ষণ পর্যন্ত একজন বন্দি হেফাজতে থাকছেন, ততক্ষণ তার সমস্ত নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাকে যখন আঘাত করা হচ্ছে, তার মানে রাষ্ট্র তার প্রাথমিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে।"

তিনি বলেন, "আদালত চত্বরেও কাউকে যখন প্রহার করা হয়, তখন অনেক মানুষ মিলে তাকে নিশানা করে। এটা গণপিটুনিরই মানসিকতা। আইন, বিচার ব্যবস্থা, সরকারের উপরে মানুষের চরম অনাস্থা তৈরি হয়েছে। এটা তার একটা গুরুত্বপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, অপরাধীদের ছাড়া পেয়ে যাওয়া এর অন্যতম কারণ। এত বড় শিক্ষা দুর্নীতিতে পার্থ চট্টোপাধ্যায় ছাড়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জেলে নেই। এটা দেখে মানুষের বিচার ব্যবস্থা, সরকারের প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়েছে।"

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ