পশ্চিমবঙ্গে ‘পানি’ নিয়ে অনাকাঙ্খিত বিতর্ক
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩গত মঙ্গলবার ভা্ষা দিবস উপলক্ষে রাজ্য সরকারের কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানটি হয় দেশপ্রিয় পার্কে। মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও সেখানে ছিলেন শিল্পী, বিদ্বজ্জনরা। এই অনুষ্ঠানে চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের একটি মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়।
মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে শুভাপ্রসন্ন বলেন, "বাংলা ভাষার উচ্চারণ, বাংলা ভাষার তাৎপর্য, বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য থেকে আমরা সরে আসছি। আমরা দেখছি বহু কারণে নানা সাম্প্রদায়িক ছাপ বাংলা ভাষায় চলে এসেছে।” এই প্রসঙ্গে তিনি ‘পানি', ‘দাওয়াত' শব্দ ব্যবহারের প্রসঙ্গ তোলেন যা পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুরা বলে থাকেন।
এরপর বক্তৃতা করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী শুভাপ্রসন্নের মন্তব্যকে খারিজ করে দেন। তার বক্তব্য, "যত বেশি বাংলা শব্দ বৃদ্ধি পাবে, তত বেশি বাংলা ভাষার বৃদ্ধি হবে। আমরা যদি হৃদয়কে ছোট করে রাখি, তা হলে হৃদয় কোনোদিনই বৃ্দ্ধি পাবে না। মূল ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখে ভাষাকে বাড়াতে হবে।”
মুখ্যমন্ত্রীর আগে বক্তৃতা করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়িও শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি দেখান। বাঙালি বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিকরাও খারিজ করেছেন শুভাপ্রসন্নর বক্তব্য। তা সত্ত্বেও চিত্রশিল্পী নিজের অবস্থানে অনড় রয়েছেন।
বৃহস্পতিবার শুভাপ্রসন্ন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রবীন্দ্রনাথ লক্ষ লক্ষ বাংলা শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু গোসল, পানি, দাওয়াত লিখেছেন কি? বিবেকানন্দ বলেইছিলেন, শান্তিপুর-ঢাকাকে নিয়ে কলকাতার ভাষাই হবে মান্য। ফলে পণ্ডিতরা যা-ই বলুন, একটি সম্প্রদায়ের ভাষা দিয়ে আমরা চিহ্নিত হতে চাই না।”
শুভাপ্রসন্ন রাঘঢাক না করেই বলেছেন, কোনো একটি সম্প্রদায়ের ভাষা হিসেবে ওই শব্দগুলি বাংলায় এসেছে। এভাবে ভাষাকে কেন্দ্র করে বিভাজনের তীব্র বিরোধিতা করেছেন বিশিষ্টজনেরা।
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, "বাংলাদেশে সবাই পানি, দাওয়াত বলেন। এই শব্দগুলি সে দেশে গৃহীত হয়েছে। এতে কোনো সমস্যা নেই। অন্য ভাষার শব্দকে আপন করে নেওয়া যেতেই পারে।”
সাহিত্যিক অমর মিত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বাঙালি মানে তো শুধু হিন্দু নয়, মুসলমানও আছে। ভারতের অবাঙালি হিন্দু-মুসলমান সকলেই পানি বলে। যদি ইনভাইট করছি বলতে আপত্তি না থাকে, তা হলে দাওয়াতে আপত্তি কেন? এই যে রিকশায় চেপে যাচ্ছি, রিকশা কি বাংলা শব্দ!”
নৃসিংহপ্রসাদ থেকে কবি সুবোধ সরকার এ নিয়ে শুভাপ্রসন্নর মন্তব্যের বিপরীত অবস্থা নেওয়ায় তাদের তীব্র আক্রমণ করেছেন শিল্পী। যদিও এই বিতর্কে বাংলার কোনো বিদ্বজ্জনকে পাশে পাননি শুভাপ্রসন্ন।
শুধু বাংলাদেশ নয়, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলমান জনতাও ‘পানি' শব্দটি ব্যবহার করেন। তাই শুভাপ্রসন্নর বক্তব্য রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন অভিঘাত রাখে, এ কথা বলাই যায়। শিল্পীর ভাষায়, "আমি রাজনীতির মানুষ নই। ভোটে লড়ি না। ছবি আঁকি। মুখ্যমন্ত্রীর এভাবে বলায় অসুবিধা থাকতে পারে।”
এই মন্তব্যে আরো বড় বিপদের গন্ধ পাচ্ছেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য। ভাষাচর্চার অসংখ্য বইয়ের প্রণেতা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "শ্রীহট্টে আমাদের মতো হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের একাংশে পানি বলার রেওয়াজ ছিল। তাতে কি এসে গিয়েছে! বাঙালিকে হিন্দু ও মুসলমানে ভাগ করার রাজনৈতিক চেষ্টা হচ্ছে। এ সব যারা বলছেন তারা বাঙালির শত্রু।”