পশ্চিমবঙ্গে মার্কিন সংস্থার আগমন কতটা ইতিবাচক
৫ জুন ২০২৫
গত বছরে ওয়াশিংটন সফরের সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন, কলকাতায় তৈরি হবে সেমিকন্ডাক্টর কারখানা। ‘কোয়াড' সদস্য রাষ্ট্রগুলির বৈঠকে যোগ দিতে আমেরিকায় গিয়েছিলেন মোদী। তার ফাঁকে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সঙ্গে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়। সেই আলোচনার পরে মোদী যে ঘোষণা করেছিলেন, তার কাজ ধাপে ধাপে এগোচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সময়ে জানিয়েছিলেন, রাজ্য সরকারের সঙ্গে মার্কিন দূতাবাস ও প্রশাসনের আলোচনা চলছে বছর তিনেক ধরে। এই আলোচনা এবার ফলপ্রসূ হতে চলেছে। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে একাধিক বড় সংস্থা পশ্চিমবঙ্গে পা রাখার পরে হার্ডওয়ারের পরিসরে নয়া সম্ভাবনার মুখে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ।
অ্যামেরিকার সংস্থা গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজ কলকাতায় সেমিকন্ডাক্টর কারখানা তৈরি করবে, তা গত বছরে ঘোষণা করেছিল। সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে তথ্যপ্রযুক্তি তালুকে এই সংস্থাকে ১৩ হাজার বর্গফুট জায়গা দেয়া হয়। এর উপরে আরো ১৯ হাজার বর্গফুট জায়গা চেয়েছে সংস্থাটি। সেই জায়গা দেয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছে নবান্ন।
গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরির সংস্থা। বহুজাতিক সংস্থা তথ্য প্রযুক্তি তালুকে ন্যানো ইলেকট্রনিক্সের প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে চায়। সেজন্য এখানে গড়ে উঠবে সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার অত্যাধুনিক ইউনিট।
গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজের পরে আরো একটি সংস্থা পশ্চিমবঙ্গে তাদের ইউনিট তৈরি করতে চলেছে। এ বিষয়ে বুধবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে বৈঠক করেন পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের কনসাল জেনারেল ক্যাথি জাইলস ডিয়াজ। এই বৈঠকের পরে নবান্ন জানিয়েছে, আরো এক আমেরিকার কোম্পানি সেমিকন্ডাক্টর কারখানা তৈরি করতে চায়। এ ছাড়াও একাধিক বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজ ছাড়াও আরো একটি মার্কিন সংস্থা কলকাতায় তাদের ইউনিট স্থাপনে আগ্রহী। নিউ জার্সির স্যানটেক গ্লোবাল সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরি ও ন্যানোইলেকট্রনিক্সের অগ্রণী সংস্থা। নবান্ন সূত্রে খবর, এই সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চলছে। রাজ্য সরকার তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে।
বিভিন্ন বৈদ্যুতিন সামগ্রীতে মাইক্রোচিপ বা চিপ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেল ফোন থেকে টেলিভিশন ডিজিটাল ক্যামেরা থেকে কম্পিউটার, সব ক্ষেত্রেই অন্যতম চালিকাশক্তি এই মাইক্রোচিপ এই চিপের ভিতরে যে অংশটি তড়িৎ পরিবহনের কাজ করে তার নাম সেমিকন্ডাক্টর। বিশ্বজুড়ে বৈদ্যুতিন সামগ্রির চাহিদা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সামগ্রী তৈরির উপকরণ হিসেবে বাড়ছে মাইক্রোচিপের চাহিদা। সে কারণেই গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রিজ বা স্যান্টেক গ্লোবাল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের কারখানা তৈরি করতে চাইছে, চাহিদা অনুযায়ী সেমিকন্ডাক্টর জোগান দেয়ার জন্য।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবার বিপুল চাহিদার ফলে এই ক্ষেত্রে বড় সংখ্যায় কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই জায়গা কমে আসছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ফলে। সম্প্রতি কম্পিউটার সংস্থা আইবিএম ঘোষণা করেছে, তারা আট হাজার কর্মীকে সরিয়ে সেই দায়িত্ব এআই এজেন্টদের হাতে তুলে দেবে। এ ছাড়া গুগল, মাইক্রোসফট, আমাজনের মতো বহুজাতিক সংস্থা গত বছর দুয়েকে কর্মী সঙ্কোচন করেছে।
এই পরিস্থিতিতে হার্ডওয়ার শিল্পের উন্নতি ইতিবাচক বলেবিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ভাস্কর গুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমরা তথ্যপ্রযুক্তির কথা বললেও ধীরে ধীরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেই জায়গায় থাবা বসাচ্ছে। ফলে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে মানুষ যে কাজ করছে, সেই জায়গা নিয়ে নিচ্ছে এআই। সে কারণেই এখন হার্ডওয়ার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সুবাদেই মার্কিন সংস্থার এ রাজ্যে আগমন নিয়ে আমি খুব আশাবাদী।"
তিনি বলেন, "এখনকার উন্নতমানের কম্পিউটার অনেক দ্রুত কাজ করতে পারে। দ্রুত ডেটা প্রসেসিং করতে পারে। এর ফলে কোনো সিস্টেমকে নিখুঁতভাবে চালানো সম্ভব হয়। এর জন্যই হার্ডওয়ার ক্ষেত্রের বিকাশ দরকার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যালগোরিদম কোনো নতুন বিষয় নয়, হার্ডওয়ারের উন্নতির ফলেই সেটা একটা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। আগামী দিনে উন্নয়নের অনেকটাই এর উপরে নির্ভরশীল হয়ে আছে। এর একটা অন্যতম দিক চিপ ডিজাইন। সুতরাং কর্মসংস্থান হলে, এক্ষেত্রে হওয়ার সম্ভাবনা, সফটওয়্যারে নয়।"
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তির অধ্যাপক মুনমুন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "কোর ইন্ডাস্ট্রিজে ইলেক্ট্রনিক্স বা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের পড়ুয়ারা কাজ করতে পারবে। আজকাল যে কোনো শিল্পে তথ্যপ্রযুক্তির পড়ুয়াদের চাহিদা আছে। যেহেতু প্রত্যেক শিল্পে কম্পিউটারের উপরে নির্ভর করে সফটওয়্যার চলছে। তথ্যপ্রযুক্তির ছেলেরা সফটওয়্যার তৈরি থেকে শুরু করে ডেটা সংগ্রহ, সব কাজটা করে। এই সেমিকন্ডাক্টর এবং ন্যানো ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচুর পরিমাণে ডেটা সংগ্রহের জন্য তথ্য প্রযুক্তি বিভাগের পড়ুয়া বা আইটি ইঞ্জিনিয়ার দরকার। শুধুমাত্র ইঞ্জিনিয়ারদের লাগবে তা নয়, সঙ্গে কম্পিউটার সায়েন্সের পড়ুয়াও প্রয়োজন। কোর ইন্ডাস্ট্রির জন্য সাধারণ শ্রমিক থেকে আরম্ভ করে ডিজাইন কর্মী লাগবে। যদি সত্যি এ রকম কোনো সুযোগ থাকে, তাহলে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে।"
অর্থনীতিবিদ রতন খাসনবিশ ডিডাব্লিউকে বলেন, "যে তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র বামফ্রন্টের আমলে তৈরি হয়েছিল, সেটাতেই এই সম্ভাবনাগুলো ছিল যে, গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজের মতো সংস্থা এসে এখানে কাজ করতে পারবে। এতদিন পর্যন্ত এখানে সফটওয়্যার নিয়ে কাজ হত, হার্ডওয়ার নিয়ে কাজ করার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান আসেনি। এবার সেই প্রতিষ্ঠান আসছে। অর্থাৎ অতীতে যে সম্ভাবনাগুলো তৈরি হয়েছিল, সেগুলোই এখন বিলম্বিত হলেও আসছে।"
যে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান এখন অনেকাংশেই পুঁজিনিবিড় হয়ে উঠেছে। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও এআই ব্যবহারের ফলে ক্রমশ কর্মসংস্থান কমছে। সার্বিক শিল্পায়নের স্বার্থে সরকারকে আরো উদ্যোগী হতে হবে বলে মত খাসনবিশের। তার বক্তব্য, "এখানকার শিল্পগুলো সরকারের কাছ থেকে কিছু ইনসেনটিভ পেত। গত মাসে একটা সরকারি নোটিস দিয়ে এই ইনসেনটিভ তুলে নেওয়া হয়েছে। শিল্পায়নের যে ভিত্তি আগে তৈরি করা হয়েছিল, তার উপরে কিছু কিছু অঙ্কুরোদগম হচ্ছে। এগুলো সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে, কিন্তু আরো বড় ধরনের কিছু উন্নয়নের পরিকল্পনা করা দরকার।"