পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মুসলিম ভোট গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে নতুন দল তৈরির কথা জানালেন ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি।
বিজ্ঞাপন
ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, আগামী ২১ জানুয়ারি নতুন রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে আসবে। পিছন থেকে সেই দলের পৃষ্ঠপোষকতা করবেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মুসলিম ভোট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট আছে রাজ্যে। মুসলিমরা কোন দলকে ভোট দিচ্ছেন, তার উপর নির্বাচনের ফলাফল অনেকটাই নির্ভর করে। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণ তীব্র হয়েছে। যার সুযোগ পেয়েছে বিজেপি। প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছে গেরুয়া শিবির। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, মুসলিম ভোটের বড় অংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে ছিল বলেই তিনি বিজেপির থেকে কয়েক শতাংশ ভোট বেশি টানতে পেরেছিলেন। আর এখানেই গুরুত্বপূর্ণ ফুরফুরা শরিফের প্রসঙ্গে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ফুরফুরা শরিফ বরাবরই নানা ভাবে অংশ নেয়। ভোটের আগে এখানকার পিরজাদারা মুসলিমদের কাকে ভোট দেওয়া উচিত, এই মর্মে নানা মন্তব্য করেন। মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি অংশ ফুরফুরা শরিফকে বিশ্বাসও করে। ফুরফুরা শরিফের আরেক পিরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি বরাবরই মমতাপন্থি বলে পরিচিত। এবারও তিনি মমতা বিরোধী কথা বিশেষ বলেননি। কিন্তু আব্বাস সিদ্দিকি বেশ কিছুদিন ধরেই মমতাবিরোধী মন্তব্য করছেন। মাঝে তাঁর সঙ্গে এসে দেখা করেছেন এমআইএম প্রধান আসাউদ্দিন ওয়েইসি। আসাউদ্দিন ভারতে মুসলিম রাজনীতির জন্য জনপ্রিয়। বিহারে সাফল্য পাওয়ার পরে হায়দরাবাদের এই রাজনীতিক পশ্চিমবঙ্গেও ভোটে লড়তে চাইছেন। সে কারণেই পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন তিনি আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে কথা বলতে।
এক নজরে ভারতের আঞ্চলিক দল
২০১৯ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচন৷ ইতিমধ্যে কেন্দ্রে ও রাজ্যে সরকার গড়া এবং টিকিয়ে রাখায় আঞ্চলিক দলগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছে৷ জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এই দলগুলি নিয়েই এই ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP/Strdel
মা-মাটি-মানুষের তৃণমূল কংগ্রেস
১৯৯৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে জন্ম৷ দলের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ প্রতীক জোড়া ঘাসফুল ও স্লোগান ‘মা-মাটি-মানুষ’৷ ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১১ সালে এককভাবে ১৮৪টি আসন পেলেও কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিধানসভার ২২৭ টি আসন নিয়ে প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করে৷ ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে ২৯৪টি আসনের মধ্যে এককভাবে ২১১টি আসন পেয়ে আবার ক্ষমতায়৷
ছবি: UNI
দলিতের দল বহুজন সমাজ পার্টি
উত্তরপ্রদেশের বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) দলিত ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের পার্টি৷ ভারতীয় সংবিধান রচনার প্রাণপুরুষ, দলিত নেতা ডক্টর বি. আর আম্বেদকরের আদর্শে ১৯৮৪ সালে দলটি গঠন করেন কাঁসিরাম৷ ২০০১ সালে দলের ভার নেন উত্তরপ্রদেশের চারবারের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী৷ রাজ্যের প্রথম দলিত মুখ্যমন্ত্রী তিনি৷ নির্বাচনী প্রতীক চিহ্ন হাতি৷ বর্তমানে সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিএসপির চারজন থাকলেও লোকসভায় একজনও নেই৷
ছবি: Bahujan Samaj Party
ক্ষমতার আশায় সমাজবাদী পার্টি
১৯৯২ সালে মূল জনতা দল ভেঙে গঠিত সমাজবাদী পার্টি (এসপি) উত্তরপ্রদেশে খুবই প্রভাবশালী৷ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুলায়েম সিং যাদব, তবে বর্তমান দলনেতা অখিলেশ সিং যাদব৷ দলের মতাদর্শ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র৷ নির্বাচনী প্রতীক সাইকেল৷ ২০১২ সালের বিধানসভা ভোটে শাসক দল বহুজন সমাজ পার্টিকে পরাজিত করে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে উত্তরপ্রদেশে সরকার গঠন করে৷ লোকসভা এবং রাজ্যসভায় বর্তমান আসন সংখ্যা যথাক্রমে ৭টি এবং ১৩টি৷
ছবি: picture-alliance
দাঁড়িপাল্লায় অকালী দল
পাঞ্জাব ও হরিয়ানার শিখ ও পাঞ্জাবি জাতীয়তাবাদী আঞ্চলিক দল শিরোমণি অকালী দল৷ সব থেকে পুরানো এবং প্রভাবশালী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলটি ‘অকালী’ নামেই পরিচিত৷ নির্বাচনি প্রতীক দাঁড়িপাল্লা৷ বর্তমান সভাপতি সুখবীর সিং বাদল৷ গুরুদোয়ারার মতো শিখ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ন্ত্রণ করে তাঁর দল৷ প্রতিষ্ঠা ১৯২০ সালে৷ বর্তমানে সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় অকালী দলের সাংসদ চারজন, বিধানসভায় ১১৭ টি আসনের মধ্যে মাত্র ১৫টি৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Panthaky
দক্ষিণ ভারতের এআইএডিএমকে
অখিল ভারত আন্না দ্রাবিড় মুনেত্র কড়গম, বা সংক্ষেপে এআইএডিএমকে, ভারতের তামিল নাডু রাজ্যের রাজনৈতিক দল৷ ১৯৭২ সালে এম.জি. রামচন্দ্রন কর্তৃক এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷ দলীয় প্রতীক জোড়া পাতা৷এই দল সংসদে তৃতীয় বৃহত্তম দ্রাবিড় আঞ্চলিক পার্টি৷ ‘আম্মা’ জয়ললিতার নেতৃত্বে ১৯৮৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখে এআইএডিএমকে৷ রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল এআইএডিএমকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Sankar
উদীয়মান ডিএমকে?
দ্রাবিড় মুনেত্র কড়গম, সংক্ষেপে ডিএমকে তামিলনাড়ু রাজ্যের পুরনো আঞ্চলিক দল৷ প্রতিষ্ঠাতা সি.এন আন্নাদুরাই৷ ‘জাস্টিস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত দ্রাবিড় কড়গম পার্টি ভেঙে গঠিত হয় ১৯৪৯ সালে৷ ১৯৬৯ সাল থেকে আমৃত্যু দলের নেতৃত্ব দেন করুণানিধি৷ মতাদর্শ সামাজিক গণতন্ত্র ও আঞ্চলিকতাবাদ এবং নির্বাচনি প্রতীক উদীয়মান সূর্য৷ বিরোধীনেত্রী জয়ললিতার মৃত্যুর পর আগামী ভোটে কেমন ফল করে ডিএমকে, এখন তা-ই দেখার অপেক্ষা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Sankar
আম জনতার আম আদমি পার্টি
২০১২ সালে গঠিত আম আদমি পার্টি বর্তমানে দিল্লির শাসক দল৷ ২০১১ সালে জন লোকপাল বিল পাস করানো নিয়ে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকারী আন্না হাজারে ও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়৷ ২০১৩ সালে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে নামে আম আদমি পার্টি ও সরকার গঠন করে৷ অবিলম্বে লোকপাল বিল আনার শর্ত পূরণ হবার সম্ভাবনা না থাকায় ৪৯ দিনের মাথায় ইস্তফা দিলেও ২০১৫ সালের বিধানসভা ভোটে ফের ক্ষমতায় আসে৷
ছবি: Reuters/A. Mukherjee
বিজু-র জয়রথ কি বজায় থাকবে?
১৯৯৭ সালে গঠিত বিজু জনতা দল বর্তমানে ওড়িষায় ক্ষমতাসীন৷ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজু পট্টনায়েকের ছেলে নবীন পট্টনায়েক এখন মুখ্যমন্ত্রী৷ পিতার নামেই দলের নাম৷ দলের প্রতীক চিহ্ন শঙ্খ৷ নবীন পট্টনায়েক ২০০৯ সালের সংসদীয় নির্বাচনে দাঁড়ান এবং বিপুল ভোটে জয়ী হন৷ ২০০০ সাল থেকে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় নবীন পট্টনায়ক এখন মোট চারবারের মুখ্যমন্ত্রী৷
ছবি: Getty Images/AFP/Strdel
8 ছবি1 | 8
ডয়চে ভেলেকে আব্বাস জানিয়েছেন, ''শুধু এমআইএম নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই আমাদের কথা চলছে। কারা আমাদের সমর্থন করছেন, সে বিষয়ে ২১ তারিখ বিশদে জানাতে পারবো। পশ্চিমবঙ্গে বেশ কয়েকটি আসনে আমরা আসন দিতে চাইছি।'' বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, আব্বাস সিদ্দিকির পৃষ্ঠপোষকতায় দল তৈরি হলে মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের একটি অংশ তৃণমূলের থেকে সরে যাবে। যা বিজেপির জন্য সুবিধাজনক হবে। মেরুকরণের পরিবেশে তৃণমূলের ভোট কাটবে। কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের বক্তব্য, পিছন থেকে আব্বাসকে উসকে দিচ্ছে বিজেপি।
‘‘কারা আমাদের সমর্থন করছেন, সে বিষয়ে ২১ তারিখ বিশদে জানাতে পারব’’: আব্বাস সিদ্দিকী
বস্তুত, আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে এক সময় মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ যোগায়োগ ছিল। মুকুল তখন তৃণমূলে। এখন তিনি বিজেপিতে এসে আব্বাসকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। আব্বাস অবশ্য সে কথা মানতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ আছে। এবং তাঁর রাজনীতি যতটা তৃণমূলবিরোধী, ঠিক ততটাই বিজেপিবিরোধী। ২১ তারিখ তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। আব্বাস বলেছেন, ''ফুরফুরা শরিফে মমতা এসেছেন, কংগ্রেস-সিপিএম সবাই আসে। মুসলিম দল বলেও কিছু হয় না। আমরা যে দল তৈরি করতে চাইছি, তা মূলত পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়কে নিয়ে। সেখানে খ্রিশ্চানও আছে, আদিবাসী, দলিত সকলেই আছে। ফলে ধর্মের ভিত্তিতে আমরা কোনো দল তৈরি করতে চাইছি না।''
কংগ্রেসের একটি সূত্রের দাবি, আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে তাদেরও কথা হয়েছে। ধর্মের সঙ্গে যদি সম্পর্ক না থাকে, তাহলে রাজ্যের কয়েকটি পকেটে বাম-কংগ্রেস জোটের কাছাকাছি আসতে পারে আব্বাসের দল। তবে সবটাই নির্ভর করছে আব্বাসের দলের সমীকরণ কী হবে, তার উপর। কারণ, ধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলে বিশেষ করে বামেদের পক্ষে সেই দলের সঙ্গে প্রকাশঅযে জোট তৈরি করা অসম্ভব।
সমীকরণ যা-ই হোক, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে আব্বাস সিদ্দিকি যে নতুন অঙ্ক তৈরি করতে চলেছেন, তা মোটামুটি স্পষ্ট। আব্বাস জানিয়েছেন, পঞ্চাশেরও বেশি আসনে প্রার্থী দিতে চান তিনি। ধরে নেওয়া যায়, মুসলিম পকেটকেই তিনি টার্গেট করছেন। যদি তাই হয়, তা হলে সেখানে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা তৈরি হবে। বিজেপি যার সুযোগ পেতে পারে।