‘পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হত্যার চরিত্র পাল্টেছে'
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯যৌথভাবে তিনি ‘পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হত্যা (১৯৭৭-২০১০)একটি সমীক্ষা' নামের একটি বই লিখেছেন৷ সিপিএম আমলের বিভিন্ন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড তাঁর বইয়ে স্থান পেয়েছে৷ বর্তমানে তিনি কাজ করছেন হাল আমলের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে৷ পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে অনেক কথা ভলেছেন তিনি৷
ডয়চে ভেলে: পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হত্যার ক্ষেত্রে কী বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়?
সুজাত ভদ্র: রাজনৈতিক দল ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য অস্ত্র মজুত করে, সমাজবিরোধীদের আশ্রয় ও প্রশ্র্য় দেয়৷ এর লক্ষ্য এলাকা দখল ও সেই দখলদারিত্ব ধরে রাখা৷ সংসদীয় পথে যে দলগুলি রাজনীতি করে, তারাই এসব কাজ করে৷ যারা সংসদীয় ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে না, সেই চরম বামপন্থি দলগুলির কথা ছেড়েই দিলাম৷ অর্থাৎ, সংসদীয় ব্যবস্থায় বিশ্বাসী দলগুলিই সংবিধানকে উপেক্ষা করে হিংসায় মদত দেয়৷ ২০১১ অবধি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বিশ্লেষণ করে আরেকটি বিষয় উঠে এসেছে, এই রাজনৈতিক সংঘাতে মারা পড়ছে গরীব মানুষ৷ শাসক ও বিরোধী উভয় পক্ষেই৷ কেউ খবর রাখছে না মৃত্যুর পর সেই পরিবারগুলির কী দশা হলো৷
তৃণমূলের শাসনে এই লক্ষণগুলির কোনো পরিবর্তন হয়েছে?
যে দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা বললাম, সেগুলি একই আছে৷ তৃণমূলের শাসনের প্রথম দফায়, অর্থাৎ ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক খুনোখুনির নতুন একটি দিক উঠে আসছে৷ সেটি হলো, শাসকদলের অভ্যন্তরীণ সংঘাত, যাকে ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব' বলা হচ্ছে৷ একটি দলের নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ছে৷ কোন এলাকা কার দখলে থাকবে তা নিয়ে সংঘর্ষ হচ্ছে৷
বামফ্রন্টের মধ্যে কি এই দ্বন্দ্ব ছিল না?
অবশ্যই ছিল৷ সিপিএমের সঙ্গে আরএসপি ও ফরোওয়ার্ড ব্লকের লড়াই লেগে থাকত৷ কিন্তু এরা বামফ্রন্টের শরিক, প্রত্যেকটি আলাদা দল৷ এখনকার শাসকদলের ক্ষেত্রে বিষয়টা আলাদা৷
তৃণমূলের দ্বিতীয় দফার শাসনে কোনো পরিবর্তন দেখছেন?
পরিবর্তন একটাই৷ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থান৷ এবার বইমেলায় দেখলাম, বিজেপি তাদের নিহত কর্মীদের তালিকা বের করেছে৷ নব্যবিজেপিরা খুব হিংসাত্মকভাবে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করছে৷ ফলে হিংসার পরিবেশ জোরদার হচ্ছে৷
সম্প্রতি কৃষ্ণগঞ্জের বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাসের হত্যাকে কোন পর্যায়ে রাখছেন?
এটা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের হত্যা৷ কিন্তু রাজনৈতিক কারণে হত্যা কিনা সেটা তদন্তসাপেক্ষ৷ এই খুন বিরোধীরা করেছে, না অন্য কেউ, সেটা দেখতে হবে৷ এটা ঠিকই যে, মুকুল রায়ের নাম উঠে এসেছে, আদালত আপাতত তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷
রাজনৈতিক হত্যা মামলায় দোষীর সাজাপ্রাপ্তির হার কম কেন?
এসব মামলা রাজনৈতিক ইচ্ছে দ্বারা চালিত হয়ে আসছে৷
আইন আইনের পথে চলবে, এটা বলা যাচ্ছে না৷ অভিযুক্ত কোন পক্ষে রয়েছে, সেটাই নির্ধারণ করছে আইন কোন পথে চলবে! মুকুল রায় তৃণমূলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন, উনি শাসকদল ছেড়েছেন বলে এফআইআর হলো! আবার সবংয়ে তৃণমূল কর্মী খুনে অভিযুক্ত ছিলেন কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া৷ তিনি তৃণমূলে আসার পর অভিযোগ থেকে অব্যহতি পেলেন৷ অর্থাৎ, পুলিশ রাজনৈতিক রং দেখে আদালতে তথ্য-প্রমাণ দিচ্ছে৷ আইন আইনের পথে চলছে, এটা মিথ হয়ে যাচ্ছে৷
বীরভূমে পাড়ুইয়ের সাগর ঘোষের হত্যাকাণ্ডে এটাই হয়েছিল?
আদালতে পুলিশ তথ্য-প্রমাণ না দিলে কিছু করার নেই৷ এই মামলায় তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল অভিযুক্ত ছিলেন৷
এ ক্ষেত্রে খোদ বিচারকই তাঁর মন্তব্যে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি পুলিশি ব্যর্থতায়...
সেটাই বললাম৷ এ ক্ষেত্রে অনুব্রত শাসকদলের হেভিওয়েট নেতা হওয়ার সুবিধা পেয়েছেন৷ এসব মামলায় যাঁরা সাক্ষী দেবেন, তাঁদেরও নিরাপত্তা বলে কিছু থাকে না৷ এ নিয়ে আইনও নেই৷ তাই সাক্ষীদের ভয় দেখানো খুব সোজা৷ আমাদের দেশে সাক্ষীদের নিয়মিত হুমকির মুখে পড়তে হয়৷
নির্বাচন শুরু হওয়ার মুখে কি হিংসা বাড়বে? বেড়ে যাবে রাজনৈতিক হত্যা?
সেটাই তো হয়৷ পঞ্চায়েত ও পৌরসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক হত্যা অনেক বেশি হয়৷ বরং লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনে ‘সুপার পাওয়ার' থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে৷ তখন খুনোখুনির সম্ভাবনা কম৷ এবারে আমাদের রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে কী হলো? নমিনেশনই দিতে দিচ্ছে না৷ এই হিংসাটা থাকবে কেন? অনান্য রাজ্যে উপনির্বাচনে এবার লক্ষণীয়ভাবে হিংসা ছিল না, যেটা পশ্চিমবঙ্গে ছিল৷ রাজনীতিতে দুবৃর্ত্তায়ন বাড়ছে, নির্বাচনের আগে আরো বাড়বে৷
আগের আমলে রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে এ আমলের সহিংসতার ফারাক কতটা?
আগের থেকে জটিলতা বেড়েছে৷ টাকার খেলা বেড়েছে, লোভ বেড়েছে, টেকনোলজি বেড়েছে৷ ফলে হিংসাও বেড়েছে৷ গণতন্ত্র খর্বিত ও লঙ্ঘিত, ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে৷ রাজনীতিতে এখন পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করা, বিরোধীদের সরিয়ে দেওয়ার কুৎসিততম ভাষা বেশি৷ যুক্তিসঙ্গত সমালোচনার ফলে এখন রাজনীতির ভাষায় খেউড় অনেক বেড়েছে৷ এমন ভাষা ব্যবহারের জন্য হিংসা বাতাবরণ অনেক বাড়ছে৷
একটা হত্যার পর তদন্তের আগেই অন্য দলকে দোষী সব্যস্ত করা শুরু হয়ে যাচ্ছে কেন?
এটা একটা ছকের মতো৷ তদন্তের আগে একে অন্যকে দোষারোপ করে প্রতিহিংসার রাজনীতিকে উস্কে দিচ্ছে৷ কার্যকারণ দেখানোর চল নেই৷ পুলিশও রাজনীতির হয়ে তদন্ত করছে৷ এখন তো ডেডবডি নিয়েও দুদলের মধ্যে টানাপোড়েন আর রাজনীতি চলে৷ এখন অন্যদের সাবধান করার জন্য খুন করানো হচ্ছে, যাতে আর কেউ বিষয়টি নিয়ে কথা না বলে৷ এ জন্য হিংসা, প্রতিহিংসা বিদ্যমান৷
প্রায়ই শোনা যায় ,বহিরাগতরা এসে খুন করে যাচ্ছে৷ সত্যিই কি বাইরে থেকে কেউ এসে ঘটনা ঘটান?
সংবিধানে এমন কোনো শব্দ নেই৷ গণতন্ত্রে বহিরাগত বলে কোনো শব্দ হয় না৷ বামফ্রন্টও এ শব্দ ব্যবহার করেছে, মমতাও করেন৷ রাজনীতিতে অহরহ ব্যবহার হয়, কিন্তু এটা ভুল যুক্তি৷ ভারতের নাগরিক যেখানে খুশি যেতে পারে, সেখানে বহিরাগত শব্দটা আসবে কী করে? বিদেশ থেকে কেউ তো এসে খুন করে না৷ আন্দোলনকে বন্ধ করার জন্য বহিরাগত তকমা দেওয়া হয়৷
রাজনৈতিক হিংসায় ভারতের প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান কেমন?
গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ হচ্ছে কমবেশি সব জায়গায়৷ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ হচ্ছে, তা এ রাজ্যেও শাসকদলের বিরুদ্ধে৷ এখানে ভাঙড় আন্দোলনে কালাকানুন প্রয়োগ করা হলো৷ দমনের পদ্ধতি সব জায়গায় কমবেশি একই৷
রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে স্বজনহারা পরিবার কি ক্ষতিপূরণ পান?
ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রেওয়াজ আছে৷ কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো সেগুলো সবসময় দেয় না৷ বিশেষ করে একদম গ্রামে গরীবগুর্বোরা মারা গেলে কিছুই হয় না৷ তারা হারিয়ে যায়৷ মিডিয়া, মানবাধিকার কমিশন ব্যাপারটা নিয়ে হইচই করলে তবেই সেটা নজরে আসে৷ সরকারও অমানবিকভাবে এড়িয়ে যায়৷ ভোটব্যাঙ্কে নড়চড় না হলে সরকার এসব নিয়ে ভাবে না৷
রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড রুখতে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন?
ক্ষমতার বাইরে বা ভেতরে যারা হিংসা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের কিছু নিষেধাজ্ঞা করা উচিত৷ ক্রমাগত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সপক্ষে আর হিংসার বিরুদ্ধে বলতে হবে৷ রাজনীতিতে দুবৃর্ত্তায়নকে আটকানো উচিত৷ প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে আইনের শাসন জারি করতে হবে৷ এছাড়া কোনো উপায় নেই৷