পশ্চিমবঙ্গে সাংবাদিকরা কেন বারবার আক্রান্ত?
৪ মার্চ ২০২২রাজ্যের ১০৮টি পুরসভার নির্বাচন হয়ে গেল রবিবার৷ বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতার ছবি সামনে এসেছে৷ এই সংক্রান্ত খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আক্রমণের মুখে পড়েছেন নয় জন সাংবাদিক৷ কেউ রক্তাক্ত হয়েছেন, কারো ক্যামেরা ভেঙে দেওয়া হয়েছে৷ কেউ চোখে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন, কাউকে দৃষ্কৃতীরা মাটিতে ফেলে মেরেছে৷ এই আক্রমণের জন্য মূলত আঙুল উঠেছে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে৷
সাংবাদিকের বিপন্নতা
ভারতে সাংবাদিকদের বিপন্নতার ইতিহাস নতুন নয়৷ প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারত ক্রমশ নীচে নামছে৷ ১৮০টি দেশের তালিকায় এখন অবস্থান ১৪২ নম্বরে৷
সাংবাদিক নির্যাতনে পশ্চিমবঙ্গও পিছিয়ে নেই৷ অতীত থেকে বর্তমানে এ ধরনের ঘটনার নজির আছে৷ শুধু মারধর নয়, চরিত্র হননের চেষ্টাও করা হয়েছে সাংবাদিকদের৷ এবিপি আনন্দের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সুমন দে তাঁর টেলিভিশন অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, উত্তরবঙ্গে নির্বাচন চলাকালীন একবার তাঁদের সাংবাদিকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনা হয়৷ ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার সাংবাদিক প্রসূন আচার্য এ সম্পর্কে বলেন, ‘‘সিপিএমের মুখপত্র গণশক্তির পাতায় আমার চরিত্র হনন করা হয়েছিল৷ কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই ২০১৫ সালে গণশক্তি পত্রিকায় বেরোয়, আমি মদ্যপ অবস্থায় হুমকি দিয়েছি বাম কাউন্সিলরকে৷’’ একধাপ এগিয়ে সিপিএম আমলে খুনের চেষ্টার অভিযোগও এনেছেন তিনি৷ বলেন, ‘‘১৯৯০ সালের জুন মাসে কলকাতা পুরসভার ভোটে সিপিএমের রিগিংয়ের বিরুদ্ধে লিখেছিলাম৷ ৪৮ নং ওয়ার্ডে কারা রিগিং করলো, তা নিয়ে পরের দিন তথ্যানুসন্ধানে গেলে একদল দুষ্কৃতী ঘিরে ধরে গুলি করার চেষ্টা করে৷ কোনো মতে উল্টোদিকের বাসে উঠে প্রাণ বাঁচাই৷’’ এ নিয়ে কোন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল? প্রসূন বলেন, “এ নিয়ে পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ জানাই৷ এফআইআরও করা হয়৷ ১৩ জন গ্রেপ্তারও হয়৷ কিন্তু সিপিএমের মুখপত্রে তিনদিন ধরে ত্রিকোণ প্রেমের গল্প সাজিয়ে আমার চরিত্র হনন করা হয়৷ মূল অভিযুক্ত ধরা পড়েনি৷’’
এক দিনে নয় সাংবাদিক আক্রান্ত যখন
পুরভোটে টিভি নাইন বাংলার একাধিক সাংবাদিক প্রহৃত হন৷ এ সব ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ করেন চ্যানেল কর্তৃপক্ষ? কী প্রতিক্রিয়া টিভি নাইন বাংলার সম্পাদক অমৃতাংশু ভট্টাচার্যর? তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সব সম্পাদকই বিশ্বাস করেন, সাংবাদিকদের খবর সংগ্রহের স্বাধীনতা থাকা উচিত৷ বাধাহীনভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত৷ কিন্তু যদি কোনো সমস্যা বা বাধা আসে, সেটাও আমাদের কাজেরই অঙ্গ৷’’ তবে সাংবাদিকদের ওপর ক্রমাগত হামলাকে প্রফেশনাল হ্যাজার্ড বা শংসাপত্র হিসেবে মানতে রাজি নন প্রবীণ সাংবাদিক বিশ্বজিৎ রায়৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রতিবাদের ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট অনেকে এড়িয়ে যেতে চান৷ টিভি বা চিত্রসাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি আক্রমণের মুখে পড়েন৷ তাঁরা আলাদা করে পথে নেমেছেন বেশ কয়েকবার৷ কিন্তু সেটা দানা বাঁধেনি৷’’ প্রসূনের বক্তব্য, ‘‘সাংবাদিক নিগ্রহ হলে থানায় এফআইআর হয়, এতে ভেঙে যাওয়া যন্ত্রপাতির বিমা পাওয়া যায়৷ এর বেশি কিছু হয় না৷’’
অতীতের মতো এবারও ক্ষমতাসীনদের বক্তব্যে সাংবাদিক নিগ্রহের বিচার এবং দোষীদের শাস্তির বিষয়টি প্রবলভাবে উঠে আসছে না৷ তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক, সাংবাদিক কুণাল ঘোষের বক্তব্যেও যেন আক্রান্ত সাংবাদিকদেরই কাঠগড়ায় তোলার চেষ্টা, ‘‘সাংবাদিকদের একাংশ ভোটের সময় তৃণমূলকে ভোট দেবেন না বলে প্রচার করেছেন৷ এটা চাপের রাজনীতি, ব্ল্যাকমেলিং৷ সরকার ও শাসক দলকে প্ররোচনা দেওয়া৷ তাঁদের উপর আক্রমণ আমরা সমর্থন করি না৷ ঘটনায় তৃণমূলের কেউ জড়িত থাকলে দল খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবে৷’’
পশ্চিমবঙ্গে সাংবাদিকতার প্রতিকুলতা : অতীত থেকে বর্তমান
সাংবাদিক নিগ্রহের পরম্পরা শুরু হয়েছে সেই কংগ্রেসের জমানা থেকে৷ ভারতে সাংবাদিকতার সবচেয়ে কালো অধ্যায় বলে মনে করা হয় ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থাকে৷ সেন্সরশিপের খাঁড়া নেমে এসেছিল সংবাদমাধ্যমের উপর৷ কিন্তু সংগঠিত ক্ষেত্র হিসেবে সাংবাদিক মহল থেকে কেন কখনো জোরালো প্রতিবাদ হয় না? বিশ্বজিৎ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কংগ্রেসের আমল থেকেই সরকারি কমিটিতে ঠাঁই ও জমি-ফ্ল্যাটের প্রলোভনে সাংবাদিকের শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়ার কৌশল নেওয়া হয়েছিল৷ কালক্রমে প্রেস ক্লাবের অনেক কর্তার চাওয়া-পাওয়াই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে৷ আজও সেই ট্র্যাডিশন চলছে৷’’ প্রেস ক্লাবের পাশাপাশি কলকাতায় রয়েছে ইন্ডিয়ান জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইজেএ) ও ন্যাশনালিস্ট ইউনিয়ন অফ জার্নালিস্ট (এনইউজে)৷ কিন্তু সাংবাদিক নিগ্রহের প্রতিবাদ সেভাবে দেখা যায় না৷ সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কেন প্রতিবাদ করেন না? বিশ্বজিৎ বলেন, ‘‘একটা সময়ে ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট অ্যাক্টে আমরা কিছুটা হলেও সুরক্ষা পেয়েছি৷ এখন সাংবাদিকদের চুক্তি চাকরির সুরক্ষা নেই৷ দলে দলে ছাঁটাই হলেও প্রতিবাদ হয় না৷’’ তাঁর মতে, ‘‘বাম জমানায় রাইটার্সের প্রেস কর্নার ভাঙার ঘটনা থেকে সাংবাদিকদের মধ্যে ভাঙন বেড়েছে৷ বিহার, অসমে তবু ঐক্য আছে, এখানে এমনই সরকারের বশংবদ যে কেউ আওয়াজ তোলে না৷’’
প্রতিবাদের বাণী নীরবে নিভৃতে...
প্রেস ক্লাব-সহ সাংবাদিক সংগঠনগুলির ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে৷ ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আইজেএ-এর সদস্য সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান ডয়চে ভেলেকে৷ বলেন, ‘‘নির্বাচনে ছাপ্পার পরম্পরা চলছে৷ সিপিএমের আমলে হাওড়ায় আমাদের বোমা মারতে মারতে তাড়া করেছিল৷ এখনও পরিস্থিতি একই আছে৷’’ সাংবাদিক সংগঠনের ভূমিকা তা হলে কী? সুপ্রিয় বলেন, ‘‘আমরা অতীতে মিছিল করেছি৷ প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছি৷ কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সহনশীলতা নেই৷ প্রতিবাদ করেও লাভ হয় না৷’’ সাংবাদিকদের ঐক্য প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘নিচুতলার সংবাদকর্মীদের মধ্যে কিন্তু একতা আছে৷ তাঁরা একজোট হয়ে কাজ করেন৷ আক্রমণের মুখে প্রতিবাদও করেন৷ রবিবারের ঘটনা নিয়ে কী করা হবে, তা নিয়ে এখনও আলোচনা হয়নি৷’’ যদিও প্রসূনের বক্তব্য, “এ রাজ্যের ঘটনা সম্পর্কে মঙ্গলবার বিবৃতি দিয়েছে দিল্লির প্রেস ক্লাব৷ ৭৬ বছরের ঐতিহ্য কলকাতা প্রেস ক্লাবের৷ তারা কী করছে? আজ যারা শাসকের ঘনিষ্ঠ, তাঁরা অতীতে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় আলিমুদ্দিনের চোখে ভালো সাজার জন্য প্রতিবাদ করতেন না৷’’