সম্প্রতি আসামে গ্রেপ্তার হয়েছে আট সন্ত্রাসী। পশ্চিমবঙ্গ থেকে গ্রেপ্তার পাকিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী। কেন উত্তর-পূর্ব ভারতকে ট্রানজিট রুট বলা হচ্ছে?
বিজ্ঞাপন
শনিবার গভীর রাতে কলকাতা থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ক্যানিং থেকে এক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের অফিসারেরা। ধৃতের নাম জাভেদ মুন্সি। এর আগেও একাধিকবার সন্ত্রাসী কাজকর্মের অপরাধে জম্মু-কাশ্মীরে গ্রেপ্তার হয়েছে জাভেদ। জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের কাছ থেকে খবর পেয়েই ক্যানিংয়ে জাভেদের খোঁজে তল্লাশি চালায় স্পেশাল টাস্ক ফোর্স। শেষ পর্যন্ত পুলিশের জালে ধরা পড়ে সে। পুলিশ জানিয়েছে, জাভেদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথি মিলেছে। যা দেখে মনে করা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে, নেপাল ঘুরে পাকিস্তান যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল জাভেদের।
পুলিশ জানিয়েছে, ধরমপুর থেকে দিল্লি হয়ে শুক্রবার কলকাতায় পৌঁছান জাভেদ। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় একটি বাড়িতে গিয়ে ওঠে সে। বস্তুত, এক কাশ্মীরী শালওয়ালা ওই বাড়িটিতে থাকতেন। জাভেদ তার পরিচিত। ওই শালওয়ালার মাধ্যমেই বাড়িটি ভাড়া করেছিল সে।
সন্ত্রাসবাদীদের বাংলাদেশ-যোগ
এদিকে কেরালায় আরেক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছে সেখানকার স্থানীয় পুলিশ। ওই সন্ত্রাসী পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ায় ডেরা বানিয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। ধৃতের নাম শাব আলি। পুলিশ জানিয়েছে, বাংলাদেশের নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লা বাংলা টিম বা এবিটি-র সদস্য ওই শাব আলি। মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা মিনারুল শেখ এবং আব্বাস আলির মাধ্যমে শাব আলি পশ্চিমবঙ্গে জাল ছড়ানোর চেষ্টা করছিল বলে পুলিশের দাবি। মিনারুল এবং আব্বাসকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, শাবের বাবা মুর্শিদাবাদের লোক। বছর চল্লিশেক আগে তিনি বাংলাদেশে চলে যান। শাবের জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা বাংলাদেশে। তবে মুর্শিদাবাদে এখনো তার পরিবার-পরিজন আছেন। তাদের সূত্রেই মুর্শিদাবাদে নিজের জাল তৈরি করছিল সে।
কলকাতার পুলিশ-কুকুরদের কথা
এরাও পুলিশ। অপরাধীদের ধরতে, বিস্ফোরক, মাদক খুঁজে বের করতে এদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। দক্ষতার সঙ্গে তারা অপরাধীদের ধরে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
তদন্তকারী কুকুর
এমন বহু তদন্তের নজির রয়েছে যার কুলকিনারা তদন্তকারী পুলিশ কর্মীরা করতে পারেননি কিন্তু অপরাধী ধরে দিয়েছে অন্য কেউ। কারো নাম মার্শাল, কেউ বা মিলি, পায়েল, রানি, জিপসি, ব্ল্যাকি, লুসি। এরা হলো কলকাতা পুলিশের প্রশিক্ষিত তদন্তকারী কুকুর বাহিনী।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কবে তৈরি হয়েছিল এই বাহিনী?
১৯৭১ সালে তৈরি হয় কলকাতা পুলিশের ডগ স্কোয়াড। শুধুমাত্র অপরাধীদের চিহ্নিত করার জন্যই নয়, অপরাধ আটকানোর জন্যও এই বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। তাই বিশেষজ্ঞ দিয়ে এদের প্রশিক্ষিত করা হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কুকুর দেবে অনুমতি
এদের সবুজ সঙ্কেত পেলে তবেই নির্দিষ্ট রুটে হাঁটার অনুমতি পান প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি থেকে রাজ্যপাল সকলেই। তবেই অচেনা জায়গায় পা ফেলার ছাড়পত্র পান ভিআইপিরা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নির্ভুল তদন্ত
অভিজ্ঞ পুলিশকর্তাদের মতে মানুষ তদন্তে গিয়ে ভুল করতে পারে, কিন্তু কুকুর অপরাধী চিনতে ভুল করে না। এদের তীব্র ঘ্রাণশক্তি, স্মৃতিশক্তি, দৌড়ঝাঁপ করার ক্ষমতা মানুষের থেকে অনেক বেশি, বুদ্ধিও আছে। মানুষ পুলিশের মত এদেরও রয়েছে ইউনিফর্ম।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বিশেষজ্ঞ সারমেয়
ডোবারম্যান, বিগেল, গোল্ডেন রিট্রিভার, অ্যালসেশিয়ান, জার্মান শেফার্ড, ককার স্পেনিয়াল মিলিয়ে কলকাতা পুলিশের ডগ স্কোয়্যাডের সদস্য ৪৮। এরা প্রত্যেকে বিভিন্ন কাজে দক্ষ। অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজ, অপরাধমূলক তদন্ত, নারকোটিকস, বম্ব স্কোয়াড-সহ আলাদা আলাদা বিভাগ রয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
প্রশিক্ষণের রোজনামচা
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা কুকুরদের প্রশিক্ষণ চলে পিটিএস অর্থাৎ পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে। অফিসার ইন চার্জ শান্তনু মণ্ডল জানালেন, সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনই আউটডোর প্র্যাকটিস চলে। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে অনুশীলন সেরে এসে তাদের পরিষ্কার করা হয়, এরপর যাদের ডিউটি থাকে তারা ডিউটিতে চলে যায়, বিকেলে ফিরে আবার হাল্কা গা ঘামানো। এর মাঝে এমার্জেন্সি ডিউটি পড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে হয় সেখানে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আহার বিধি
ইচ্ছে করলেই মেলে না বাহারি খাবার। ফিট থাকতে যেমন প্রতিদিনের নিয়মিত অনুশীলন জরুরি, তেমনই খাওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে মাপা নিয়ম। চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যালান্স ডায়েটেই থাকতে হয় এদের। রান্নাঘরে হলুদ-রসুনের ঢোকার অনুমতি থাকলেও নুন-চিনিতে নিষেধ রয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
রয়েছে অবকাশও
সাধারণত ছয় থেকে নয় মাস বয়সে একটা কুকুরকে প্রশিক্ষণ দিতে স্কোয়াডে ভর্তি করা হয়। থাকা খাওয়া চিকিৎসা সহ প্রত্যেক পুলিশ-কুকুরদের খরচ বহন করে সরকার। প্রত্যের কুকুরের জন্য বরাদ্দ থাকে একটা করে ঘর। গরম থেকে বাঁচতে রয়েছে কুলারের ব্যবস্থাও। মানুষ পুলিশদের মত এদেরও ছুটিছাটা রয়েছে, সেদিন ঘরে বসে আরাম। তবে উর্দিধারীদের মতোই করতে হয় এমার্জেন্সি ডিউটি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অবসরের বয়স
আট বছর বয়স পর্যন্ত কাজ করতে পারে এরা। তবে কুকুরদের কর্মক্ষমতার উপর নির্ভর করে তারা কত বছরে অবসর নেবে। মানুষের মতই এদেরও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষমতা কমতে থাকে। তখনই অবসরের কথা চিন্তা করতে হয়, তবে মানুষের মত একেবারে নির্ধিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া নেই। অক্ষম কুকুরকে সময়ের আগেও বসিয়ে দেওয়া হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বাইরেও প্রশিক্ষণ
কলকাতা পুলিশের কুকুরের ট্রেনিং যে শুধু কলকাতাতেই হবে এমন কথা নেই। মানুষের মতো এরাও রাজ্যের বাইরে প্রশিক্ষণ নিতে যায়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
প্রশিক্ষণের পদ্ধতি
গন্ধ শুঁকিয়ে, ওপর থেকে ঝাঁপ দিইয়ে, দৌড়ঝাঁপ করিয়ে – নানান উপায়ে প্রশিক্ষিত করা হয় এই কুকুরদের। ছবিয়ে যেমন দেখা যাচ্ছে, একটি কুকুর একজনের হাতে কামড় বসাচ্ছে। এখানে কুকুরটিকে আগে থেকে একটি গন্ধ শুঁকিয়ে সেটি খুঁজে বের করার ‘টাস্ক’ দেওয়া হয়েছিল। কুকুরটি সেই গন্ধ শুঁকে অপরাধীকে খুঁজে তাকে ধরেছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মায়ার বাঁধন
ছোট্ট বয়সে প্রশিক্ষণ নেয় এরা। তখন তাদের সঙ্গে থাকে তাদের হ্যান্ডলার বা মাস্টার। সেই সময় মাস্টারের সঙ্গে আত্মিক যোগ তৈরি হয়ে যায় ওদের। মাস্টারকে দেখতে না পেলে ওদের যতটা মনখারাপ হয় ততটাই মনখারাপ হয় মাস্টার বা ট্রেনারদের। এএসআই কুশল সিং ডেসিলার সামনেই অবসর, এদের ছেড়ে থাকতে হবে ভেবে মন খারাপ তার।
ছবি: Subrata Goswami/DW
12 ছবি1 | 12
আসাম থেকে গ্রেপ্তার
গত সপ্তাহেই আসাম থেকে আটজন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছে আসাম পুলিশ। সেখানেও একজন বাংলাদেশের নাগরিক আছে। আসামের গ্রেপ্তার হওয়া সন্ত্রাসীদের কাছ থেকেও পুলিশ জানতে পেরেছে, পাকিস্তানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। পাকিস্তান যাওয়ারও পরিকল্পনা ছিল তাদের।
উত্তর-পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং আসাম সীমান্ত বরাবরই ট্রানজিট রুট হিসেবে চিহ্নিত। এই সীমান্ত দিয়ে একদিকে যেমন বাংলাদেশ ঢুকে পড়া যায়, তেমনই নেপাল এবং ভুটানের খোলা সীমান্ত ব্যবহার করে অন্য দেশে গা ঢাকা দেওয়া যায়। অতীতেও এই সীমান্ত ব্যবহার করেছে সন্ত্রাসীরা। সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ফের এই রাস্তা ব্যবহার করতে চাইছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলি, এমনটাই মনে করছে পুলিশ।
কলকাতা পুলিশের এক অফিসার ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলি থেকে নানা খবর পাওয়া যাচ্ছে। তারই ভিত্তিতে মুর্শিদাবাদ এবং ক্যানিংয়ে অভিযান চালানো হয়েছিল। আরো অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।''
সাবেক আইপিএস অফিসার সন্ধি মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''এক সময় পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত খুব সহজেই পারাপার করতে পারতো সন্ত্রাসীরা। কারণ, সীমান্তে কাঁটাতার ছিল না। কাঁটাতার লাগানোর পর এবং ভিজিলেন্স বাড়ানোর পর এই প্রবণতা কিছুটা কমেছিল। ইদানীং আবার তা বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে।'' বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি একটি বড় কারণ বলেই মনে করেন সন্ধি।
ভারতীয় সেনার সাবেক লেফটন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্যও সন্ধির সঙ্গে সহমত। তার বক্তব্য, ''পশ্চিমবঙ্গ এবং আসাম সীমান্তে প্রচুর স্লিপিং সেল ছড়িয়ে রাখা আছে। সম্প্রতি সেগুলি আবার অ্যাক্টিভ করা হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত যে গ্রেপ্তারগুলি হয়েছে, তা থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়।'' উৎপলের মতে, পাকিস্তান সীমান্তে সেনার টহল নিশ্ছিদ্র হওয়ার ফলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলি আবার পূর্বের সীমান্ত ব্যবহার করতে চাইছে। সে কারণেই কাশ্মীরের সন্ত্রাসীও পশ্চিমবঙ্গে ঘাঁটি গাড়ছে। এবং এই সমস্ত ঘটনার মধ্যেই একটি যোগসূত্র আছএ বলে তিনি মনে করেন।