পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় সরকারি মদের দোকান এবং পানশালা খোলার সিদ্ধান্ত নিলো মমতা ব্যানার্জির আবগারি দপ্তর৷ মদের ক্রমশ বেড়ে চলা বিক্রিই এমন সিদ্ধান্তের কারণ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Adhikary
বিজ্ঞাপন
চলতি কথায় বলে, দুটি ব্যবসার কোনো মার নেই – ওষুধ এবং মাদক৷ দুটি বস্তুই যখন কারো দরকার হয়, না হলে চলে না৷ ফলে শিল্পহীন, চাকরিহীন, কর্মহীন পশ্চিমবঙ্গে অন্তত মদের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠছে প্রতি বছর, এটাই সরকারকে উৎসাহিত করার পক্ষে যথেষ্ট৷ এ কারণে এক বেনজির সিদ্ধান্ত– সরকার মদের খুচরো বিক্রিতে নামবে৷ এর আগে দেশি মদ এবং আইএমএফএল, অর্থাৎ ইন্ডিয়ান মেড ফরেন লিকার, যাকে চলতি কথায় ‘বিলিতি মদ’ বলা হয়, এই দুই ধরনের মদেরই বাণিজ্যিক সরবরাহের দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিজের হাতে নিয়েছিল৷ রাজ্যের সমস্ত মদের দোকান, পানশালা এবং রেস্তোরাঁ, যেখানে মদ বিক্রি হয়, তাদের সবার লাইসেন্স নতুন করে নিতে হয়েছিল৷ এর পরের ধাপ ছিল চলতি বছরের জুলাইয়ে, এক হাজারেরও বেশি নতুন মদের দোকানের লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত, যা নিয়ে রীতিমতো বিতর্ক শুরু হয়েছিল৷ কারণ, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো এবং পথ দুর্ঘটনা এড়াতে, সামগ্রিকভাবে দেশের সড়কগুলিকে অপরাধমুক্ত রাখতে কেন্দ্র সরকার ২০১৭ সালেই এক নতুন আইন করে জাতীয় সড়কের ১,৫০০ মিটার ব্যাসের মধ্যে মদের দোকান, পানাশালা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার লটারির মাধ্যমে মদের দোকানের লাইসেন্স বিলি করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সেই বিধি-নিষেধ কার্যত আগ্রাহ্য করছিল৷ তখন মমতা ব্যানার্জির সরকারের যুক্তি ছিল, আশপাশের রাজ্য এবং পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে মদের চোরা কারবার রুখতে, বেআইনি জাল মদের রমরমা ব্যবসা বন্ধ করতে এবং মদ্যপায়ীরা যাতে খাঁটি মদ পান, তা নিশ্চিত করতেই নতুন দোকানের লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত৷ এবার সরকার নিজেই মদের ব্যবসায় নেমে পড়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় অবশ্য আসল কথাটি বলেছে৷ বলেছে, মদের বিক্রি যে হারে বাড়ছে, সরকার এই খাতে রাজস্ব আদায় আরো বাড়াতে চায়৷ এবং সেই রাজস্ব আদায় করতে চায় সরাসরি, সরকারি মদের দোকান এবং পানশালার মাধ্যমে৷ এখন রাজ্যে প্রায় ৪,৫০০ বেসরকারি মদের দোকান, যার থেকে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়৷ রাজ্যের আবগারি দপ্তরের অনুমান, সরকার সরাসরি মদের ব্যবসায় নামলে এই আদায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ২০ হাজার কোটি হতে পারে৷
কোন মাদকের কারণে শরীরে কী ক্ষতি হয়?
বাংলাদেশে মাদকাসক্তি একটি বড় সমস্যা৷ মাদক হিসেবে একসময় ফেনসিডিল ও গাঁজার বেশ চল থাকলেও এখন সেই স্থান নিয়েছে ইয়াবা৷ এছাড়া আছে হেরোইন, আফিম, অ্যালকোহল, প্যাথিডিন ইত্যাদি৷
ছবি: bdnews24.com
ইয়াবা
বাংলাদেশে বর্তমানে মাদক হিসেবে এটিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে৷ এর ফলে কিডনি, লিভার ও ফুসফস ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ সাময়িক যৌন উত্তেজনা বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়৷ এছাড়া ইয়াবার কারণে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/epa/Barbara Walton
ফেনসিডিল
একসময় এটিই প্রধান মাদক ছিল৷ ইয়াবা আসার পর ফেনসিডিলের ব্যবহার কিছুটা কমেছে৷ এটি খাওয়ার কারণে ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যায়৷ ফলে খাবার না খাওয়ায় শরীর পর্যাপ্ত পুষ্টি পায় না৷ এতে স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ ইয়াবার মতো ফেনসিডিলও যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়৷ এছাড়া শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
ছবি: bdnews24.com
গাঁজা
রক্তবাহী শিরার ক্ষতি করে, ফলে রক্ত পরিবহনে সমস্যা হয়৷ মস্তিষ্কের উপর প্রভাবের কারণে স্মৃতিশক্তির ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়৷ তাছাড়া মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে৷ পুরুষের ক্ষেত্রে টেস্টিকুলার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে৷ অনেকের ধারণা গাঁজা খেলে সৃজনশীলতা বাড়ে৷ তবে এটি ভুল বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে৷ গাঁজা খেলে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয়, চোখের দৃষ্টি কমে যায়৷
ছবি: AFP/Getty Images/F. K. Godhuly
হেরোইন
যারা অধিক পরিমাণে হেরোইন সেবন করেন তারা নানারকম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েন৷ যেমন লিভার সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ, তীব্র কোষ্ঠকাঠিন্য, কিডনি রোগ, হার্ট ও ত্বকে সমস্যা, হেপাটাইটিস, নারীদের সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা, গর্ভপাত ইত্যাদি৷
ছবি: bdnews24.com
আফিম
আফিম খেলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে, যা থেকে অবচেতন হয়ে পড়া এবং বেশি পরিমাণে খেলে মৃত্যুও হতে পারে৷ এছাড়া মুখ ও নাক শুকিয়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি হতে পারে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Majeed
অ্যালকোহল
জার্মানির সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট ফর মেন্টাল হেল্থ-এর ফাল্ক কিফার বলেন, অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ হয়ে জীবনের মূল্যবান বছরগুলি হারিয়ে যায়৷ লিভার সিরোসিস থেকে শুরু করে কর্মক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন অনেকে৷ ডাব্লিউএইচও-র রিপোর্ট বলছে, ২০১২ সালে বিশ্বব্যাপী মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে ৩.৩ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেন৷ এছাড়া ২০০টি নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ হতে পারে অতিরিক্ত অ্যালকোহলের কারণে৷
ছবি: picture-alliance/empics/Y. Mok
6 ছবি1 | 6
প্রাথমিক পর্যায়ে ঠিক হয়েছে, প্রায় ২,০০০ মদের দোকান এবং পানশালা খুলবে সরকার৷ জেলার সেইসব অঞ্চলে, যেখানে এখনো কোনো মদের দোকান নেই৷ এইসব দোকান চালাবে রাজ্য সরকারের বেভারেজ কর্পোরেশন, বা পানীয় নিগম৷ কিন্তু মমতা ব্যানার্জি সরকারের এই বাণিজ্যিক উদ্যোগ নিয়ে সঙ্গত কারণেই আপত্তি, অভিযোগ উঠছে৷ বিশেষত প্রতিবেশী রাজ্য বিহারে যেখানে মদ্যপানের সমস্যা থেকে সমাজকে মুক্তি দিতে রাজস্ব ক্ষতি সত্ত্বেও মদের দোকান বন্ধ করে দিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের সরকার, গুজরাটে দীর্ঘদিন ধরেই মদ কেনা-বেচা নিষিদ্ধ, বিধিনিষেধ আরোপিত আছে মহারাষ্ট্র এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্যেও, মূলত জনস্বাস্থ্য রক্ষার খাতিরে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ হঠাৎ কেন শুঁড়িখানার ব্যবসায় নামল, সে প্রশ্ন উঠছে৷ যেখানে আরও বেশি স্কুল-কলেজ দরকার, সুলভে চিকিৎসার সুযোগ দরকার, আরো বেশি সরকারি হাসপাতাল দরকার, সেখানে কেন মদের দোকানের সংখ্যা বাড়াতে মনোযোগী হলো সরকার?
‘‘আসলে আগে মদ বিক্রির ক্ষেত্রে যেটুকু আড়াল-আবডাল ছিল, সেটুকুও এবার উঠে গেল!’’ ডয়চে ভেলেকে সখেদে বললেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার৷ তাঁর সোজাসাপটা বক্তব্য, ‘‘আমি প্রাচীনপন্থি এবং নীতিবাগীশ, তাই হয়ত আমার এরকম মনে হচ্ছে, কিন্তু এ এক সর্বনেশে সিদ্ধান্ত৷ এতে এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে-মেয়েদের কাছেও মদ সুলভ হবে, যার জেরে অপরাধ প্রবণতা বাড়বে৷ আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হবে৷’’
ওদিকে সোশ্যাল মিডিয়াও সরব ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে৷ তার মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয়টি হলো— গ্রামে গঞ্জে সরকারি মদের দোকান থেকে মদ বিক্রি হবে, এবার রেশন দোকানে মদের চাট বিক্রির ব্যবস্থা থাকলে ষোলো কলা পূর্ণ হয়৷
মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও নিরাময় কেন্দ্র
বাংলাদেশে বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম আহসানিয়া মিশন পরিচালিত মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও নিরাময় কেন্দ্র৷ ঢাকায় নারীদের জন্য একটি ও ঢাকার বাইরে পুরুষদের জন্য দু’টি কেন্দ্রের মাধ্যমে সংস্থাটি কাজ করছে৷
ছবি: DW
নারীদের জন্য একটি, পুরুষদের দু’টি
ঢাকার মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে আহসানিয়া মিশন পরিচালিত অ্যাডিকশন ম্যানেজমেন্ট এবং ইন্টেগ্রেটেড কেয়ার সেন্টার৷ সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় ছাড়াও এখানে আছে নারীদের জন্য মাদকাসক্তির চিকিৎসা ও নিরাময় কেন্দ্র৷ এখান থেকেই গাজীপুর ও যশোরে পুরুষদের দু’টি নিরাময় কেন্দ্রের কার্যক্রমের তদারকি চলে৷
ছবি: DW
‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’
লাল কাপড়ে সুঁচি কাজের এ লেখাগুলো শোভা পাচ্ছে আহসানিয়া মিশনের নারী মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের প্রবেশ পথে৷ এটি তৈরি করেছেন কারাবন্দি মাদকাসক্তরা৷ আহসানিয়া মিশন তাদের তিনটি কেন্দ্রের মাধ্যমে মাদকাসক্ত মানুষকে আলোর পথ দেখানোর কাজে নিয়োজিত৷ বন্দি মাদকাসক্তদের নিরাময়েও সংস্থাটি কাজ করে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
মাদকাসক্তদের মধ্যে নারীরা বেশি
আহসানিয়া মিশনের মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে আলোর মুখ দেখতে আসা নারী মাদকাসক্তরা৷ প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক ডা. ফারাহ দিবা জানান, তাদের কাছে সেবা নিতে আসা মাদকাসক্তদের মধ্যে ১৫-২৫ বয়সের মেয়েরাই বেশি৷ নারীদের মধ্যে আসক্তির অন্যতম কারণ হিসেবে তারা চিহ্ণিত করেছেন বন্ধুদের বা পরিবারের অন্য কোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ৷
ছবি: DW
বিভিন্ন রকম ‘প্রোগ্রাম’
‘ব্রোকেন ফ্যামিলির’ সন্তানদের মধ্যেও অবশ্য মাদকাসক্ত মানুষ দেখা যায়৷ তাই আহসানিয়া মিশনের নারী মাদকাসক্ত কেন্দ্রে চলছে সাইকো-সোশ্যাল এডুকেশন প্রোগ্রাম৷ এ কেন্দ্রে এ রকম নানান প্রোগ্রামের মাধ্যমে মাদকাসক্তদের সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
যাঁদের জন্য সুস্থ হয়ে উঠছেন মাদকাসক্তরা
আহসানিয়া মিশনের এই নারী মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে আছে সার্বক্ষণিক কাউন্সিলর ও চিকিৎসক৷ কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে মাদকাসক্তদের ভালো করে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন এ কাউন্সিলররা৷
ছবি: DW
দেখভাল প্রয়োজন প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টায়
আহসানিয়া মিশনের নারী মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এখানকার সদস্যদের কার্যক্রম৷ মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের সদস্যদের সার্বক্ষণিক দেখভালের মধ্যেই রাখতে হয়৷
ছবি: DW
যেখানে থাকেন মাদকাসক্ত নারীরা
ঢাকার মোহাম্মদপুরে নারী মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের থাকার জায়গা৷
ছবি: DAM
পুরুষদের মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র
আহসানিয়া মিশনের রাজেন্দ্রপুরের পুরুষ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র৷ এটি পারিবারিক মিটিং বা ‘ফ্যামেলি মিটিং’-এর ছবি৷
ছবি: DAM
‘ফ্যামিলি মিটিং’
নিরাময় কেন্দ্রের সেবায় সুস্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার পর, পরবর্তী সময় পর্যবেক্ষণের অংশ হিসেবে আয়োজন করা হয় এ ধরনের ফ্যামিলি মিটিংয়ের৷
ছবি: DAM
খেলার ছলে চিকিৎসা
গাজীপুরের রাজেন্দ্রপর কেন্দ্রের মাদকাসক্ত চিকিংসার অংশ হিসেবে চলছে খেলাধুলা৷