স্কুলশিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার শঙ্কা
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩স্কুলশিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির মামলায় এর আগে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী থেকে কমিশনের চেয়ারম্যান, পর্ষদের সভাপতিকে পাকড়াও করেছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা৷ কিন্তু এই মামলায় অপেক্ষাকৃত ‘লো প্রোফাইল' হলেও বাগদার ‘রঞ্জন' ওরফে চন্দনের নাম বার বার উঠে আসছিল৷
শুক্রবার সিবিআই ডেকে পাঠিয়েছিল চন্দনকে৷ দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ২০২১ সালে তার নাম ‘সৎ রঞ্জন' হিসেবে সামনে এনেছিলেন সিবিআইয়ের সাবেক কর্তা ও তৃণমূলের একসময়ের বিধায়ক উপেন বিশ্বাস৷ তারপর অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে৷ অবশেষে দুর্নীতির অন্যতম কান্ডারি হিসেবে অভিযুক্ত গোয়েন্দাদের জালে৷
উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার মামা-ভাগিনা গ্রামে থাকেন চন্দন৷ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন৷ কিন্তু স্থানীয় সূত্রের খবর, স্কুলের বিভিন্ন স্তরে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে তার হাত বেশ ‘লম্বা’৷ গ্রামের স্কুলে পার্শ্বশিক্ষকের কাজ করেন চন্দন৷ কিন্তু প্রভাবে খাটো নন৷
উপেন বিশ্বাস সোশ্যাল মিডিয়া ‘সৎ রঞ্জনের' নাম প্রকাশ্যে আনার পর তাকে ঘিরে রহস্য ঘনীভূত হয়৷ স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, রঞ্জনের দোতলা বাড়ির সামনে একটা সময় চাকরিপ্রার্থীদের ভিড় লেগে থাকত৷ চাকরি অনুযায়ী প্রার্থীদের কাছ থেকে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা নেওয়া হত৷ চন্দনকে টাকা দিলে চাকরি হত৷ আর চাকরি না হলে তিনি নাকি টাকা ফেরতও দিতেন৷
কেন্দ্রীয় সংস্থার দাবি, একঝাঁক এজেন্টের মাধ্যমে প্রার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকার লেনদেন চলত৷ মিডলম্যানরা সেই টাকা পৌঁছে দিত রাজনীতি ও প্রশাসনের উচ্চস্তরে৷ যেসব প্রার্থী টাকা দিতেন, তাদের তথ্য আসত চন্দনের কাছে৷ তার সঙ্গে স্কুল সার্ভিস কমিশনের উপদেষ্টাদের যোগাযোগ ছিল বলে সূত্রের খবর৷ তাই সাদা খাতা জমা দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর নাম পৌঁছে যেত সর্বোচ্চ স্তরে৷
নিয়োগ দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে আটক প্রসন্ন রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল চন্দন মণ্ডলের৷ আবার ইডি-র হাতে আটক হুগলির তৃণমূল যুব নেতা কুন্তল ঘোষের সঙ্গে চন্দনের যোগ রয়েছে বলে তদন্তকারীদের দাবি৷ চন্দন, কুন্তলের মতো দুর্নীতির চাঁইদের সঙ্গে ধৃত মানিক ভট্টাচার্য, সুবীরেশ ভট্টাচার্য, শান্তিপ্রসাদ সিনহাদের কী যোগ ছিল তা খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি৷
বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য থেকে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর দাবি, ‘কুন্তল, চন্দনরা দুর্নীতির ছোট অপরাধী৷ বড় মাথাদের ধরতে হবে৷ তাদের নাগাল কি পাবে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি- এনিয়ে বার বার প্রশ্ন তুলেছে খোদ আদালত৷
চন্দনকে গ্রেপ্তার করার পর শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘গ্রেপ্তার হয়েছে জানি৷ কিন্তু কী হবে? কিছুই হবে না৷’’
তা হলে কি সারদা বা নারদ তদন্তের মতো কেটে যাবে বছরের পর বছর? তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ কটাক্ষ করেছেন, ‘‘সিবিআই সম্পর্কে অনাস্থাই বোঝাচ্ছে তারা এই তদন্তে কতটা উপযুক্ত৷’’
তদন্তকারীদের নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন উপেন বিশ্বাসও৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘এত দিন পর রঞ্জনের গ্রেপ্তারিতে খুশি নই৷ যেভাবে তদন্ত করা উচিত, সিবিআই করেনি৷’’ উল্লেখ্য উপেন বিশ্বাস পশুখাদ্য মামলার তদন্তের নেতৃত্ব দেন যার পরিণতিতে কারাবাসের সাজা হয় বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবের৷
যদিও সাবেক সিবিআই কর্তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক পুলিশ কর্তা নজরুল ইসলাম৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘উপেন বিশ্বাস যখন মন্ত্রী ছিলেন তখনই এই দুর্নীতি সম্পর্কে জানতেন বলে মনে হয়েছে তার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে৷ তা হলে তিনি সেই সময়ই কেন মুখ্যমন্ত্রীকে বিষয়টা জানাননি? পুরো মেয়াদে মন্ত্রী থেকেছেন, পরে রঞ্জনের নাম সামনে এনেছেন৷’’
চন্দন মণ্ডলের আইনজীবী নাম উল্লেখ না করে উপেনের দিকে আঙুল তুলেছেন৷ তার দাবি, এক প্রভাবশালী চক্রান্ত করে চন্দনকে ফাঁসিয়েছে৷ অর্থাৎ এত বড় মাপের দুর্নীতি ও বেআইনি লেনদেনের পর্দা ফাঁস হয়েছে মূলত উপেনের হাত ধরেই৷ কিন্তু সংবাদমাধ্যম থেকে শিক্ষক বা ছাত্র সংগঠন কেন আগে এতে আলোকপাত করেনি?
অ্যাডভান্স সোসাইটি ফর হেডমাস্টার্স অ্যান্ড হেডমিস্ট্রেস-এর রাজ্য সম্পাদক চন্দন মাইতি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা আভাস পাচ্ছিলাম যে টাকার লেনদেন হচ্ছে৷ কিন্তু এর সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসন পুরোপুরি যুক্ত৷ পুলিশের গাড়ি এসকর্ট করত অপরাধীদের৷ ফলে ব্যাপারটির তল পাওয়া কঠিন ছিল৷’’