ব্রিটেনে এক প্রাক্তন গুপ্তচর ও তাঁর কন্যার উপর হামলাকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও পশ্চিমা জগতের মধ্যে কূটনৈতিক সংঘাত চরমে উঠেছে৷ রাশিয়া ৬০ জন মার্কিন কূটনীতিককে বহিষ্কারের ঘোষণা করেছে৷
বিজ্ঞাপন
গত শতাব্দীতে শীতল যুদ্ধের অবসানের পর রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা জগতের এমন কূটনৈতিক সংঘাত দেখা যায়নি৷ ব্রিটেনের প্রতি সংহতি দেখিয়ে অ্যামেরিকাসহ ইউরোপের একাধিক দেশ বেশ কিছু রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কারের পর রাশিয়াও পালটা আঘাত হানলো৷ বৃহস্পতিবার সেদেশ সেন্ট পিটার্সবার্গে মার্কিন কনসুলেট বন্ধ করার এবং ৬০ জন মার্কিন কূটনীতিককে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ আগামী ৫ই এপ্রিলের মধ্যে তাঁদের দেশ ছাড়তে হবে৷ অন্য যেসব দেশ রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে, সেসব দেশের কূটনীতিকদেরও বহিষ্কারের ঘোষণা করেছে মস্কো৷ ফলে সব মিলিয়ে পশ্চিমা দেশগুলির ১৫০ জনেরও বেশি কূটনীতিককে মস্কো ছাড়তে হচ্ছে৷ উল্লেখ্য, এর আগে রাশিয়া ২৩ জন ব্রিটিশ কূটনীতিককে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এক সংবাদ সম্মেলনে এই পালটা পদক্ষেপের ঘোষণা করেন৷
ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, মস্কোর এই সিদ্ধান্তের ফলে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটছে৷ তবে এমন সিদ্ধান্ত অপ্রত্যাশিত ছিল না৷ ফলে মার্কিন প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে বলেও সেই বিবৃতিতে জানানো হয়েছে৷ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর আগে রাশিয়ার সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করে আরও পদক্ষেপের হুমকি দিয়েছিল৷ ফলে উত্তেজনা আরও বাড়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে৷
গোটা ঘটনার সূত্রপাত গত ৪ই মার্চ ইংল্যান্ডের স্যালিসবারি শহরে৷ প্রাক্তন ‘ডাবল এজেন্ট' সের্গেই স্ক্রিপাল ও তাঁর কন্যা ইয়ুলিয়া ‘নভিচক' নামের মারাত্মক নার্ভ টক্সিনের কারণে বিষক্রিয়ার শিকার হন৷ সোভিয়েত আমলে এই টক্সিন ব্যবহার করা হতো৷ এই হামলার জন্য ব্রিটেন সরাসরি রাশিয়াকে দায়ী করেছে৷ শুধু বিদেশের মাটিতে হামলা নয়, রাশিয়া রাসায়নিক অস্ত্র সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাও লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে৷
বলা বাহুল্য, রাশিয়া এই অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে৷ তাছাড়া এই অভিযোগের সপক্ষে কোনো প্রমাণ পেশ করা হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে মস্কো৷ রাশিয়ার মতে, লন্ডন ও ওয়াশিংটন ‘রাশিয়া-ভীতি' সৃষ্টি করে বাকি দেশগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করে নতুন শীতল যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে৷
গোটা ঘটনাকে ঘিরে রাশিয়ার আচরণের মধ্যে কিছুটা সংযমের লক্ষণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ কূটনৈতিক যুদ্ধে মস্কো এখনো পর্যন্ত হুবহু একই পালটা পদক্ষেপ নিয়েছে৷ অ্যামেরিকাও ঠিক ৬০ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছিল৷ দুর্বল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে আন্তর্জাতিক স্তরে একঘরে হয়ে পড়া রাশিয়ার পক্ষে মোটেই সুখকর নয়৷ তার উপর মস্কো পশ্চিমা দেশগুলির মধ্যে এমন ঐক্যেরও প্রত্যাশা করেনি৷
রাজনীতির ইতিহাসে বিষ দিয়ে হত্যার যত চেষ্টা
রাজনীতির ইতিহাসে বিষ দিয়ে মারার চেষ্টা বহুবার হয়েছে – কখনো সফল, কখনো অসফল৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Sazonov
আলেক্সি নাভালনি
রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের কট্টর সমালোচক আলেক্সি নাভালনিকে সাইবেরিয়া থেকে জার্মানিতে নেওয়া হয়েছে৷ নাভালনির শরীরে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন সমর্থকরা৷ ১৯ আগস্ট ৪৪ বছর বয়সি সাবেক এই আইনজীবী চা খাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. Kudrayavtsev
সের্গেই স্ক্রিপাল
৬৬ বছর বয়সি সাবেক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপালকে ব্রিটেনের স্যালিসবেরি শহরের একটি শপিং মলের সামনে অজ্ঞান অবস্থায় একটি বেঞ্চের উপর পাওয়া যায়৷ তিনি কোনো অজ্ঞাত বিষের শিকার হয়েছেন বলে পুলিশের ধারণা৷ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেস্কভ এই পরিস্থিতিকে ‘দুঃখজনক’ বললেও যোগ করেছেন যে, ‘‘(ঘটনার) কারণ কী হতে পারে অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কী করেছেন, সে বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/Tass
কিম জং নাম
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের বৈমাত্রেয় ভাই কিম জং নাম ২০১৭ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে প্রাণ হারান৷ দৃশ্যত দুই নারী তাঁর মুখে ভিএক্স নামের একটি রাসায়নিক মাখিয়ে দিয়েছিলেন৷ মালয়েশিয়ার একটি আদালতে অভিযুক্তদের বিচার চলার সময় জানা যায় যে, আক্রান্ত হওয়ার সময় কিম জং নাম-এর পিঠের ব্যাগে ভিএক্স বিষের ডজন খানেক অ্যাম্পুল ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Kambayashi
আলেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কো
সাবেক রুশ গুপ্তচর লিটভিনেঙ্কো দেশ ছেড়ে ব্রিটেনে আশ্রয় নেবার পর সাংবাদিকতা শুরু করেন এবং রাশিয়ার ফেডারাল সিকিউরিটি সার্ভিস এফএসবি ও পুটিনের বিরুদ্ধে দু’টি বই লেখেন৷ ২০০৬ সালের ২৩শে নভেম্বর দু’জন সাবেক কেজিবি কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাতের পর লিটভিনেঙ্কো অসুস্থ হয়ে পড়েন ও পরে হাসপাতালে প্রাণত্যাগ করেন৷ সরকারি তদন্তে দেখা যায় যে, তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম-২১০ বিষের ক্রিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Kaptilkin
ভিক্টর কালাশনিকভ
সোভিয়েত কেজিবি গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক কর্নেল ভিক্টর কালাশনিকভ তখন সাংবাদিক হিসেবে সস্ত্রীক বার্লিনে বসবাস করছিলেন৷ ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে কালাশনিকভ ও তাঁর স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়৷ সেখানে তাদের রক্তে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৭ ও ৫৬ মাইক্রোগ্রাম পারদ পাওয়া যায়৷ স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তে এক থেকে তিন মাইক্রোগ্রাম পারদ থাকা নিরাপদ৷পরে এক সাক্ষাৎকারে কালাশনিকভ বলেন, ‘‘মস্কো আমাদের বিষ দিয়েছে৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/RIA Novosti
ভিক্টর ইউশ্চেঙ্কো
ইউক্রেনের বিরোধী নেতা ইউশ্চেঙ্কো ২০০৪ সালের নভেম্বর মাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন ও দেখা যায় যে, একটি ভাইরাল ইনফেকশন ও সেই সঙ্গে রাসায়নিকের বিষক্রিয়ার ফলে তাঁর অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটিস হয়েছে৷ এর ফলে ইউশ্চেঙ্কোর জন্ডিস হয়, মুখ ফুলে যায় এবং ত্বকে এক ধরণের দাগ থেকে যায়, যা ডাইঅক্সিন বিষের প্রভাবে ঘটে থাকতে পারে বলে চিকিৎসকদের ধারণা৷ সরকারি চররা তাঁকে বিষ দিয়েছে বলে ইউশ্চেঙ্কো দাবি করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Leodolter
খালেদ মেশাল
১৯৯৭ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখে ইসরায়েলের গুপ্তচর বিভাগ হামাস নেতা খালেদ মেশালকে হত্যা করার চেষ্টা করে৷ কথিত আছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্বয়ং নাকি হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ মেশাল জর্ডানের আম্মানে অবস্থিত হামাসের কার্যালয় থেকে বেরোনোর সময় দু’জন ইসরায়েলি গুপ্তচর তাঁর কানে কোনো বিষাক্ত পদার্থ স্প্রে করে৷ মেশাল অক্ষতই থাকেন এবং পরে ঐ দুজন ইসরায়েলি গুপ্তচরকে ধরাও সম্ভব হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Sazonov
গেয়র্গি মার্কভ
১৯৭৮ সালে বুলগেরীয় সরকারবিরোধী মার্কভ বিবিসি-তে কাজ শেষ করে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন – হঠাৎ কিছু একটা তাঁর থাই ফুঁড়ে দেয়৷ ওদিকে মার্কভ দেখেন, এক পথচারী তার ছাতা মাটি থেকে তুলছে৷ ছুঁচ ফোটার জায়গাটা ফুলে উঠে চারদিনের মধ্যে মার্কভ প্রাণ হারান৷ ময়না তদন্ত বলে, একটি শূন্য দশমিক দুই মিলিগ্রাম রিসিন বিষের পেলেট থেকে মার্কভের মৃত্যু ঘটেছে৷ পথচারীর ছাতা থেকেই পেলেটটা ছোঁড়া হয়েছিল, বলে অনেকের বিশ্বাস৷
ছবি: picture-alliance/dpa/epa/Stringer
গ্রিগরি রাসপুটিন
রুশ বিপ্লবের ঠিক আগে রাসপুটিন একজন আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন গুনিন হিসেবে পরিচিত ছিলেন৷ ১৯১৬ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গের ইয়ুসুপভ প্রাসাদে আসেন প্রিন্স ফেলিক্স ইয়ুসুপভের আমন্ত্রণে৷ প্রিন্স ইয়ুসুপভ তাঁকে পটাসিয়াম সায়ানাইড বিষ মাখানো কেক খেতে দেন ও সায়ানাইড মাখানো পাত্রে সুরা পরিবেশন করেন৷ সেই বিষাক্ত কেক ও সুরা থেকে রাসপুটিনের কিছুই হয় না৷ অতঃপর রাসপুটিনকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷