সময়টা ২০১৬'র এপ্রিল৷ মা-কে নিয়ে ১৬ দিনের ভারত ট্যুর৷ গন্তব্য কলকাতা, দিল্লি, আগ্রা, জয়পুর হয়ে কাশ্মীর৷ কলকাতা থেকে জয়পুর পর্যন্ত প্রচণ্ড গরমে অস্থির হয়ে দিল্লির প্লেনে চেপে বসলাম কাশ্মীরের উদ্দেশে৷ কিছুক্ষণ পরেই নীচের দিকে তাকিয়ে মন ভরে গেল হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য দেখে৷ যখন নামলাম রীতিমতো ঠান্ডা৷ কাশ্মীর ভ্রমণের সবরকম ব্যবস্থা করে রেখেছিল আমার কাশ্মীরি বান্ধবী ইশরা, যার সাথে আমার পরিচিয় ডয়চে ভেলেতে৷ ও তখন ডয়চে ভেলেতে দুই মাসের ট্রেনিং শেষে শ্রীনগরের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে৷ শ্রীনগর বিমানবন্দরের নিরাপত্তার ব্যাপক তোড়জোর পেরিয়ে বাইরে এসেই দেখি আমার বান্ধবী দাঁড়িয়ে৷ এমনভাবে আমাদের আলিঙ্গণ করেছে যেন সবাই ওর বহুদিনের চেনা৷ এরপর কাশ্মীরি ভাষায় ড্রাইভারকে আমাদের কথা বললো৷ ড্রাইভারের নাম সালমান এবং তার চেহারা ভোলার মতো নয়, হলিউডের অভিনেতাকেও হার মানায়৷ পুরো সাত দিন তিনি আমাদের ঘুরিয়েছেন৷ সালমান কাশ্মীরির পাশাপাশি হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় সাবলীল৷ আমাদের জানালেন, দিনে যদি ৩ থেকে ৪ বার বিমানবন্দরে কোনো যাত্রীকে আনতে বা পৌঁছে দিতে যান, ততবার তার কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হয় এবং ওই কাগজ না থাকলে বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না, এতটাই কড়াকড়ি৷
আমাদের গাড়ি ডাল লেককে পাশ কাটিয়ে সুন্দর সবুজ পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে চলে গেল বেশ অনেকটা ওপরে৷ যেখানে পর্যটকদের আনাগোনা অনেকটাই কম৷ সেখানেই এক হোটেলে আমাদের নামিয়ে দিয়ে বান্ধবী গাড়ি নিয়ে চলে গেল৷ বললো, বিকেলে আমরা আশেপাশে কয়েকটা পার্ক আছে, সেখানে যাবো৷ হোটেলের রুমে ঢুকতেই জানালা দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি একটা বন্দুক হাতে একজন সেনা নজর রাখছে৷ বন্দুকের নল ঠিক জানালা বরাবর৷ কী ভয়ঙ্কর অবস্থা! যা-ই হোক, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য আমাদের মন ভরিয়ে দিলো৷ আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হোটেলেই করা হয়েছিল৷ কারণ, হোটেলের বার্বুর্চি কলকাতার বাঙালি এবং তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করে রান্না করতেন আমরা কী খেতে চাই৷ এবং মা'র জন্য এটা চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো অবস্থা৷ বিকেলে আমরা শালিমার বাগ ঘুরতে যাই৷ মুঘল আমলের অপূর্ব এই উদ্যানে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসি হোটেলে৷ পরেরদিন বান্ধবী ইশরা ওদের বাসায় নিয়ে যায় পরিবারের সাথে পরিচয় করাতে৷ ওর মা হাত ধরে আমাদের নিয়ে যায় বাসার ভেতরে৷ বসার ঘরে কাশ্মীরি কার্পেট পাতা৷ দেয়ালে ঝোলানো আলমারিতে অল্প কিছু শো-পিস, আর কোনো আসবাব নেই৷ কী সাধারণ! সবাই কার্পেটে বসেই আলাপ করলাম৷ ওর মা কাশ্মীরি ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানেন না৷ সেক্ষেত্রে ইশরা দোভাষীর কাজ করলো৷ ভাষা ভিন্ন হলেও আন্তরিকতা ও আতিথেয়তায় কোনো কমতি ছিল না৷
এরপরের দিনগুলোতে আমরা শ্রীনগর ভালো করে ঘুরে দেখলাম, দারুণ সব কাবাব খেলাম৷ আর সব দোকানে ফ্রি চা কাহভা, যেটা এলাচ, দারুচিনি, জাফরান এবং বাদাম দিয়ে বানানো৷ কাশ্মীরের আবহাওয়ার জন্য এই চা যথার্থ৷ দ্বিতীয় দিন গুলমার্গ, তৃতীয়দিন সোনমার্গ ঘুরে বেড়ানোর পর চতুর্থ দিনে আমরা রওনা দিলাম পহেলগামের উদ্দেশে৷ সকাল ১০টায় নাশতা করে আমরা তৈরি হতেই দেখি গাড়ির হর্নের আওয়াজ৷ বুঝলাম, আমাদের সারথি সালমান উপস্থিত৷ দুই রাত আমাদের পহেলগামে থাকার কথা৷
আমাদের গাড়ি শ্রীনগর ছাড়িয়ে চলতে লাগলো৷ কিছু দূর যেতেই দুপাশে জাফরানের ক্ষেত৷ মাঝে একটা দোকানে নেমে জাফরান, বাদাম, কাহভা, কিছু মসলা কেনা হলো৷ দোকানী সবাইকে গরম গরম কাহভা খাওয়ালেন৷ এরপর গাড়ি ছাড়লো৷ এবার ভীষণ বিপজ্জনক রাস্তা৷ এত সরু এবং প্যাঁচানো রাস্তা আমি কখনো দেখিনি৷ আমার বান্ধবী বলেছিল, যে জায়গাটা সে বুক করেছে, সেখানে পর্যটক একেবারেই কম৷ প্রকৃতির সংস্পর্শ বেশি৷ আমরা দেখতে পেলাম একটা জায়গায় অনেক হোটেল৷ সেই জায়গা পেরিয়ে আরো অনেকটা দূর এগিয়ে চললো গাড়ি৷ রাস্তায় অল্প দূরে দূরে সেনা ছাউনি৷ মাঝে এবার নামিয়ে গাড়ি তল্লাশী করা হলো৷ এরপর গাড়ি চলছে উঁচু-নীচু পথে৷ নীচের দিকে তাকালে ভয়ে চোখ বন্ধ হয়ে আসে৷ মনে হয়, এই খাদে পড়ে যাচ্ছি৷ কিন্তু যখন গন্তব্যে পৌঁছালাম, আমাদের প্রাণ- মন জুড়িয়ে গেল৷ হিমালয় তার বিশালতা নিয়ে হাজির আমাদের সামনে৷ আর চারপাশে সবুজের সমারোহ এবং মাঝে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী লিডার৷ কী অপূর্ব তার শব্দ৷ এ যেন সত্যি স্বর্গ৷ নীরবতা ভেদ করে নদীর ঝিরঝির শব্দ, পাখির কলকাকলি৷ আশেপাশে দু-একটা ঘোড়া আর খচ্চর ঘাস খাচ্ছে- মনে হচ্ছে এ যেন স্বপ্ন৷
সালমান জানালেন, এখানে তাদের গাড়ি রাখার অনুমতি নেই৷ তাই তাকে শ্রীনগর ফিরতে হবে৷ দু'দিন পরে সে এসে নিয়ে যাবে৷
আমাদের যেখানে থাকার ব্যবস্থা, সেটাকে হোটেল বলা চলে না৷ মাটি, কাঠ আর খড় দিয়ে বানানো থাকার জায়গা, যেটাকে তারা রিসোর্ট বলছে৷ মাত্র ৫-৬ টা ঘর৷ ঘরের ভেতর বিছানা ছাড়া কিছু নেই৷ পাশে লাগোয়া টয়লেট৷ খাবার ব্যবস্থা বাইরে তাঁবুতে৷ রোদ পড়ে যেতেই হঠাৎ ভীষণ ঠান্ডা৷ আমাদের কাছে পর্যাপ্ত শীতের কাপড় ছিল না৷ ধারণাই ছিল না এপ্রিলে এতটা ঠান্ডা পড়তে পারে৷ তারপরও বান্ধবী ইশরা তার এবং তার মায়ের শীতের কিছু কাপড় আমাদের দিয়েছিল পরার জন্য৷ সেগুলো না থাকলে আমাদের অবস্থা যে কী হতো বলাই বাহুল্য৷ ঘরের বাইরে বের হওয়াই হতো না৷ ওখানেই তাঁবুর বাইরে আগুন জ্বালিয়ে রান্না হলো৷ আগুনের চারপাশে অতিথিরা গোল হয়ে বসে একে অপরের সাথে পরিচিত হচ্ছে৷ রাঁধুনী ব্যক্তিটি যখন জানলেন বাংলাদেশ থেকে এসেছি, বললেন, এর আগে তাদের ওখানে কোনো বাংলাদেশি থাকেননি৷ বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের নাম জানেন৷ মাশরাফি, সাকিব, তামিমদের ব্যাপক প্রশংসা করলেন৷
খাওয়ার পর আর কিছুই করার ছিল না৷ কারণ, বাইরে নিকষ অন্ধকার৷ তাই ঘরে গিয়ে ঘুম৷ ভোরের আলো ফুটতেই জানালার দিকে চোখ গেল৷ হিমালয়ের চূড়ায় যেন সোনা জ্বলছে৷ এত অপূর্ব৷ দেখেই মা-কে বললাম, চলো বাইরে যাই৷ মা বললো, ভীষণ ঠান্ডা৷ বললাম, যতগুলো চাদর আছে সব জড়িয়ে নাও সোয়েটারের ওপর৷ তারপর আমরা রিসোর্টের বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে লাগলাম৷ ঝর্ণার পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকতেই আমাদের বার্বুর্চি চা নিয়ে উপস্থিত৷ আমরা এত সকালে উঠে গেছি দেখে উনি নিজেই চা বানিয়ে নিয়ে এসেছেন৷ আমরা লিডার নদীর পাশে একটা পাথরের উপরে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে পহেলগামের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম৷ এরপর নাশতা করে আশপাশ ঘুরে দেখছিলাম৷ রিসোর্টের মানুষগুলো অতিথিদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ভীষণ সচেতন৷ কারণ, পাকিস্তান সীমান্ত বেশি দূরে নয়৷ তাই রিসোর্টের একজন সাথে ছিলেন৷
অনেকটা দূর হাঁটার পর দেখতে পেলাম একটা মাটির ঘর৷ তার সামনে কয়েকটা ঘোড়া নিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় এক ব্যক্তি৷ আমাদের সাথের ব্যক্তিটি ওই মানুষটিকে কি যেন বললেন তাদের ভাষায়৷ উনি হাসি মুখে বললেন ওনার সাথে যেতে৷ পরে জানলাম, স্থানীয় মানুষটি আমাদের চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন৷ মাটির ঘরটার ভেতরে বেশ কয়েকজন মানুষ৷ দুই পরিবার থাকে৷ মোট ৭,৮ জন হবে৷ সবাই ওই একটি ঘরে৷ ঘরের ভেতরে চুলা জ্বলছে৷ ভেড়ার দুধ জ্বাল দেয়া হচ্ছে৷ আমরা মাটিতে বসে পড়লাম৷ ওনারা বললেন, গরীব মানুষ অতিথি আপায়্যনের বেশি কিছু নেই৷ আমরা বললাম, আপনারা আমাদের চেনেন না৷ তারপরও বাসায় নিয়ে এসে গরম চা খাওয়াচ্ছেন এটা যে কত বড় বিষয়৷ খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম এই মাটির ঘরগুলো কী গরম! বের হয়ে আসছি, তখন নারীরা আমাদের জড়িয়ে ধরলেন মমত্বে৷
রিসোর্টের লোকটি জানালো এই পরিবারের একটি ছেলে কিছুদিন আগে সেনাবাহিনীর গুলিতে মারা গেছে৷ হঠাৎ হঠাৎ এখানে তল্লাশী অভিযান চলে৷ কিশোর, যুবক, তরুণ সন্দেহ হলে ধরে নিয়ে থানায় আটকে রাখে নয়ত ক্রসফায়ারে মেরে ফেলে৷ তাদের পরিবারের ছেলেটির মৃত্যুর পর পুরো পরিবার পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে ছিলো৷ পরিস্থিতি শান্ত হলে আবার ফিরেছে৷ শুধু এই পরিবার নয় বেতাব ভ্যালিতে যখন গিয়েছিলাম, তখনও আমাদের ট্যুরিস্ট গাইড একটি বাড়ি দেখিয়ে জানালেন কয়েকদিন আগে এই বাড়িতে ৬টি ছেলে মারা গেছে সেনাবাহিনীর গুলিতে৷ বাড়ির গায়ে অজস্র বুলেটের দাগ৷ জানালেন, সন্দেহ ছিল ধরে নিয়ে যেতে পারতো৷ কিন্তু মেরে ফেললো৷ আমি কিন্তু এই মানুষগুলোর চোখে আক্রোশ দেখিনি দেখেছি হতাশা আর শুনেছি দীর্ঘশ্বাস৷ এত সুন্দর একটা জায়গায় এই কথাগুলো শুনলে সব সৌন্দর্য কেমন ফিকে হয়ে যায়৷ তখন মনে হয় এই পর্যটকরা অল্প কিছুদিনের জন্য এখানে আসে, কিন্তু এই মানুষগুলোর জন্ম স্থান এটা এখানেই তাদের থাকতে হয়, জীবিকা নির্বাহ করতে হয়৷ সব দুঃখ শোক ভুলে জীবন চলতে হয়৷ পহেলগামের ২টা দিন আমার জীবনের অনন্য স্মৃতি হয়ে রয়েছে৷ সেখানকার অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা কখনো ভুলবার নয়৷ যেমন, ভোলার নয় সেখানকার মানুষদের আতিথেয়তা, সারল্য আর ভালোবাসা৷
পহেলগাম থেকে ফেরার পর দুইদিন আমরা ডাল লেকের বোট হাউজে কাটিয়ে তারপর ফিরেছিলাম৷ কাশ্মীরে যে জিনিসটা সবচেয়ে আপনাকে স্পর্শ করবে সেটা হল মানুষের আন্তরিকতা৷ ভাষা, ধর্ম, দেশ আলাদা হলেও আন্তরিকতায় কোন কমতি নেই সেখানকার মানুষের৷ কাশ্মীরে আসার আগে অনেক মানুষের মনেই সন্ত্রাস নিয়ে শঙ্কা থাকে৷ কিন্তু যারা একবার সেখানে ঘুরতে গেছেন তারা এটা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, সাধারণ কাশ্মীরিরা এই সন্ত্রাসের বিপক্ষে৷ তাদের আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন৷ আর তাই তারা প্রাণ দিয়ে হলেও পর্যটকদের সবধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত৷