পহেলগাম-কাণ্ডে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক তলানিতে
২ মে ২০২৫
গত কয়েক দশক ধরে কাশ্মীর রক্তপাত কম দেখেনি৷ একের পর এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে৷ কখনো সেনা, কখনো আধা সামরিক বাহিনী, কখনো তীর্থযাত্রী আক্রান্ত হয়েছে। কখনো জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর লড়াই হয়েছে। ২০২৬ সালে উরি ও ২০১৯ সালে পুলওয়ামার ঘটনা ও তারপরের প্রত্যাঘাত নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। কিন্তু এবার পহেলগামের ঘটনা শুধু কাশ্মীর নয়, ভারত তথা বিশ্বকেও নাড়িয়ে দিয়ে গেছে।
কাশ্মীরে যত গোলমাল হোক, পর্যটকরা তুলনায় খুবই কম আক্রান্ত হয়েছেন। সাধারণ মানুষের উপর প্রচুর আক্রমণ হয়েছে। ২০০১ সালে বিধানসভা ভবন চত্বরে আত্মঘাতী হামলায় ৩৬ জন মারা যান, ২০০২ সালে চন্দনেশ্বরী বেস ক্যাম্পে হামলায় ১১ জন অমরনাথ যাত্রী প্রাণ হারান, ২০০৩ সালে ২৪ জন কাশ্মীরি পণ্ডিতকে মারা হয়। ২০০৫ সালে পুলওয়ামাতে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে স্কুলের দুই বাচ্চা-সহ ১৩ জন সাধারণ মানুষ ও নয়জন নিরাপত্তা রক্ষী মারা যান। ২০১৭ সালে কুলগামে অমরনাথ যাত্রীদের বাসে হামলার ঘটনায় আটজন মারা যান।
কিন্তু পহেলগামে বৈসরনে যারা মারা গেছেন তারা পর্যটক। পরিচয় জিজ্ঞাসা করে একেবারে ঠান্ডা মাথায় তাদের খুন করা হয়েছে। ২৫ জন পুরুষ পর্যটককে তাদের পরিবারের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। পর্যটকদের বাঁচাতে গিয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছেন ঘোড়াচালক আদিল শাহ। এই ভয়ংকর হত্যালীলা কাশ্মীর, গোটা ভারত এবং বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
পর্যটকদের উপর আক্রমণ
কাশ্মীরে বলা হয়, পর্যটকরা হলেন তাদের মেহমান। আর এই মেহমানদের জন্যই গত কয়েক বছর ধরে একদম সাধারণ, গরিব কাশ্মীরিরা দুটো পয়সার মুখ দেখছিলেন। ২০২৪ সালে কাশ্মীর গিয়েছিলেন ৩৫ লাখ পর্যটক। ২০২৩ সালে ২৭ লাখ ১০ হাজার, ২০২২ সালে ২৭ লাখ ৭০ হাজার, কোভিডের পর ২০২১ সালে ছয় লাখ ৭০ হাজার পর্যটক কাশ্মীর যান। এবার সব রেকর্ড ভাঙার সম্ভাবনা ছিল। এই পর্যটকদের দেখিয়ে ভারত দাবি করছিল, কাশ্মীরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। জঙ্গিরা সেইখানে আঘাত করতে চেয়েছে।
পর্যটকদের যারা গাড়ি দিতেন. তাদের দৈনিক আয় হতো গড়ে চার হাজার টাকা বা তারো বেশি। এবারো পর্যটক কেন্দ্রগুলিতে প্রতিটি হোটেল বুকড ছিল। ঘোড়াওয়ালারা প্রতিদিন কাজ পাচ্ছিলেন। প্রতিটি রেস্তোরাঁয় রমরম করে ব্যবসা হচ্ছিল। দোকানপাট তিন মাসের জিনিস স্টক করে রেখেছিল।
পহেলগামের এক রেস্তোরাঁ মালিক ডয়চে ভেলে সাংবাদিক স্যমন্তক ঘোষকে বলেছেন, তার রেস্তোরাঁয় ৩০ জন কাজ করতেন। তারা ছিলেন কাশ্মীর ও জম্মুর মানুষ। পহেলগামের ঘটনার পর তারা সকলে চলে গেছেন। পর্যটকও নেই বলে, হোটেলগুলিতে একের পর এক বুকিং বাতিল হয়েছে।
এরপরেও কিছু সাহসী পর্যটক কাশ্মীরে যাচ্ছেন বা থেকে গেছেন, কিন্তু তাদের সংখ্যা কম। সরকারও কাশ্মীরের ৪৮টি পর্যটকস্থল বন্ধ করে দিয়েছে। কিছুদিন আগেও কাশ্মীরের বিমানগুলিতে জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। চড়চড় করে ভাড়া বাড়ছিল, সেগুলি এখন খালি যাচ্ছে।
কাশ্মীরিদের প্রতিবাদ
কোনো বড় জঙ্গি বা সন্ত্রাসী হামলার পর এই ধরনের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। কিন্তু পহেলগামের ঘটনার পর এবার কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করেছেন, মোমবাতি মিছিল করেছেন, তারাও এই ঘটনা মেনে নিতে পারেননি। ডাল লেকের বোটচালক, ঘোড়াওয়ালা, ট্যাক্সিচালকরাই শুধু নন, প্রতিবাদ মিছিল করেছেন কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ। জুম্মার নামাজের পর এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়েছে শ্রীনগরের মসজিদে।
ডয়চে ভেলের প্রতিনিধি এবি রউফ গিয়ানি বলেছেন, প্রতিবার এরকম সহিংসতা হলে কাশ্মীরের অনেক মানুষ বলতেন, এটা সরকার করিয়েছে। এবার তারা বলছেন, সরকার নয়, এই কাজ করেছে জঙ্গিরা।
বদলে যাওয়া কাশ্মীরের এটাও একটা বাস্তবতা। পহেলগামের ট্যাক্সিচালকরা বিনা পয়সায় পর্যটকদের শ্রীনগর, জম্মু ও অন্য জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন। লঙ্গর খুলে তাদের খাইয়েছেন। মানবতা-বিরোধী আক্রমণের পাশাপাশি কাশ্মীরের এই ছবিও তো সামনে এসেছে।
পহেলগামের মহম্মদ আলি বেগ ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''আক্রমণটা শুধু পটকদের উপরে হয়নি। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের উপরেও হয়েছে। আমাদের পেটে লাথি মেরেছে জঙ্গিরা।''
কাশ্মীরে ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ মানুষ গরিব বলে নীতি আয়োগের ২০২১ সালের রিপোর্ট জানাচ্ছে। বেকারত্বের হাত ছয় দশমিক এক শতাংশ।
কাশ্মীরে আপেল বাগানের মালিক, আখরোট ক্ষেতের মালিক, শাল ও কার্পেট কারখানার মালিক, জাফরান চাষী, হস্তশিল্প দেশে বিদেশে রপ্তানির সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের হাতে প্রচুর অর্থ আছে। পাশাপাশি গরিব মানুষের সংখ্যাও কম নয়। পর্যটক আকর্ষক জায়গায় সাধারণ মানুষ অনেকটাই পর্যটনের উপর নির্ভরশীল।
পহেলগামের ফারুক ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''আমরাও দোষীদের কড়া শাস্তি চাই। নিরাপত্তা আরো বাড়ানো হোক। বিশ্বাস করুন , আমরা চাই এরকম ঘটনা যেন আর না হয়। আবার পর্যটকে ভরে যাক পহেলগাম। আমাদের ঠিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য এটা জরুরি।''
রাজনৈতিক বদল
সাধারণত, ভারতে কোনো জঙ্গি হামলা হয়, সঙ্গে সঙ্গে বিরোধীরা সরকারকে কাঠগড়ায় তোলে। কিন্তু এইবার এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম দেখা দিয়েছে। কংগ্রেসের দাবি মেনে নিয়ে সরকার পহেলগাম-কাণ্ডের পর সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছিল। সেই বৈঠক থেকে বেরিয়ে বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, সরকার যে পদক্ষেপ নেবে, বিরোধীরা তাকে সমর্থন করবে। এমনকি সেই বৈঠকে সরকার গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথাও স্বীকার করে বলে বিরোধীদের দাবি। বহুদিন পর এই ধরনের বড় ঘটনার পরে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ হয়নি।
তবে কংগ্রেসের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ধাঁচে পোশাক পরা মুন্ডহীন একটি অবয়ব প্রকাশ করে বলা হয়েছিল, গায়েব। বিজেপি হইচই করায় তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। যে নেত্রী এই কাজ করেছেন, তিনি দলের অন্দরে ভর্ৎসিত হয়েছেন বলেও সূত্র জানাচ্ছে।
অসম্ভব সংযত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা। ২০১৯ সালের পর কাশ্মীরের বিশেষাধিকার বা ৩৭০ ধারা বাতিল করা হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর আর পূর্ণ রাজ্য নেই। দিল্লির মতো তা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল যেখানে বিধানসভা আছে। লাদাখকে আলাদা স্বশাসিত অঞ্চল করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পুরোপুরি কেন্দ্র বা তার প্রতিনিধি এলজি-র হাতে আছে।
এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা অনায়াসেই বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপিয়ে দিয়ে বলতে পারতেন, এখানে তার কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু ওমর বলেছেন, তার নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। কারণ, তিনিই তো মেহমান পর্যটকদের কাশ্মীরে আসতে বলেছেন।
পহেলগামের ঘটনার পর ওমরের ন্যাশনাল কনফারেন্স ও মুফতির পিডিপি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এরকম দৃশ্যই বা কাশ্মীরে কবে দেখা গেছে?
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা
পহেলগামের ঘটনার পর ভারতের দাবি এর পিছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে। তারা বলছে, ২০১৬ সালে উরি, ২০১৯ সালে পুলওয়ামাতে যেমন পাকিস্তান স হিংসতার পিছনে ছিল, জঙ্গিদের পুরো মদত দিয়েছিল, এবারও সেটাই হয়েছে।
মোট চারজনের ছবি প্রকাশ করেছে ভারত। তার মধ্যে দুইজন পাকিস্তানের জঙ্গি বলে ভারতের দাবি। বাকি দুইজন কাশ্মীরের যুবক, কিন্তু লস্করের সঙ্গে যুক্ত বলে ভারত দাবি করেছে।
এরপরই ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ ব্যবস্থা নেয়। সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত রাখা হয়েছে, পাকিস্তানের দূতাবাসের আকার কমিয়ে দেয়া হয়েছে, ভারতও পাকিস্তানে দূতাবাস থেকে কর্মীদের একটা অংশকে ফেরত এনেছে। পাকিস্তানীদের সার্ক ভিসা বাতিল করা হয়েছে। তাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চলে যেতে বলা হয়েছে।
ওপি জিন্দল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''যতগুলি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তার মধ্যে জলচুক্তি স্থগিত রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর আগে যুদ্ধের সময়ও ভারত এই কাজ করেনি।''
পাকিস্তানও একগুচ্ছ ব্যবস্থা নিয়েছে। তারা জানিয়ে দিয়েছে, ভারতের বিমান তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করতে পারবে না। তারাও ভারতীয়দের ভিসা বন্ধ করেছে।
দুই দেশই সীমান্তে প্রচুর সেনা মোতায়েন করেছে। কাশ্মীর সীমান্ত দেখে ফিরে আসা ডিডাব্লিউর প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ জানিয়েছেন, সেখানে প্রচুর মুভমেন্ট হচ্ছে।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ভারত আক্রমণ করতে পারে। এককথায় দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে।
ভারতীয় মিডিয়া ও সংবাদসংস্থার রিপোর্ট বলছে, একদিন আগে সেনা কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়ে দিয়েছেন, কবে, কোথায়, কীভাবে আঘাত হানা হবে, তা তারাই ঠিক করবেন।
২০১৬ সালে উরি ও ২০১৯ সালে পুলওয়ামার ঘটনার পর ভারত সীমান্ত পেরোয় ও সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে। এবারও তাই তারা প্রত্যাঘাত করতে চাইছে।
পুলওয়ামার ঘটনা এবং তারপর দুই দেশের সুর চড়ানোর মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফোন করেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। পাকিস্তানকে তিনি বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা করতে। আর ভারতকে তিনি বলেছেন, উত্তেজনা কমানোর ব্যবস্থা করতে।
তবে তার এই পরামর্শে কতটা কাজ হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।