তার ১৪ বছর আগে তিনি হয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট, নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন তারও এক বছর আগে, অথচ তখনও নেলসন ম্যান্ডেলা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছিলেন নিছক এক ‘সন্ত্রাসী', ভাবা যায়!
বিজ্ঞাপন
সময় বদলায়, বদলে যায় ইতিহাস৷ নেলসন ম্যান্ডেলা আসলেই এক ইতিহাসের রূপ বদলে দেয়া নাম৷ নইলে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কেন তিনি থাকবেন যুক্তরাষ্ট্রের করা সন্ত্রাসীদের তালিকায়? ম্যান্ডেলার বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামী জীবনের কথা যাঁরা জানেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এটাও জানেন যে সংগ্রামের বড় একটা সময় জুড়ে যুক্তরাষ্ট্র ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার তখনকার বর্ণবাদী সরকারের মিত্র৷ সে কারণে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বর্ণবাদের অভিশাপ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার অশ্বেতাঙ্গদের মুক্ত করতে নামা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি)-র শীর্ষস্থানীয় সব নেতার মতো ম্যান্ডেলাও ছিলেন প্রিটোরিয়া সরকার এবং ওয়াশিংটনের চক্ষুশূল৷ সন্ত্রাসীদের তালিকায় সে কারণেই রাখা হয়েছিল ম্যান্ডেলার মতো এক মানবতাবাদীর নাম৷
নেলসন ম্যান্ডেলা: স্বাধীনতার কণ্ঠ
নেলসন ম্যান্ডেলার হাসিমাখা এই মুখের কথা দক্ষিণ আফ্রিকার বেশিরভাগ মানুষেরই মনে থাকবে৷ যাঁকে সবাই ভালোবেসে ‘মাদিবা’ নামেই ডাকতেন৷
ছবি: Getty Images
প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ
১৯৯৪ সালের ১০ মে নতুন ইতিহাসের জন্ম হয়৷ গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন৷ ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন৷
ছবি: AP
গান্ধী থেকে অনুপ্রেরণা
অহিংস আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধীর জীবন একসময় নেলসন ম্যান্ডেলার জন্য বড় প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল৷ তাইতো ২৭ বছরের কারাজীবন শেষে যখন তিনি বাইরে বেরিয়ে আসেন তখন ম্যান্ডেলা সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে অহিংস আন্দোলনকেই বেছে নিয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP/DW
যুগান্তকারী এক পরিবর্তন
নেলসন ম্যান্ডেলার হাসিমাখা এই মুখের কথা দক্ষিণ আফ্রিকার বেশিরভাগ মানুষেরই মনে থাকবে৷ যাঁকে সবাই ভালোবেসে ‘মাদিবা’ নামেই ডাকতেন৷ আর যাঁর অবদান বিশ্বের ইতিহাসে এনে দিয়েছে যুগান্তকারী এক পরিবর্তন৷ ম্যান্ডেলা তাঁর জীবনের প্রায় তিন দশক কাটিয়েছেন কারাগারে৷
ছবি: Reuters/Mark Wessels
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আইনজীবী
১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রদেশে জন্ম নেন নেলসন রোলিলালা ম্যান্ডেলা৷ উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর তিনি আইন পড়ার সিদ্ধান্ত নেন৷ ছাত্র হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি, বিশেষ করে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে শিক্ষাজীবন থেকেই সংগ্রাম চালিয়েছেন ম্যান্ডেলা৷ ১৯৫২ সালে তিনি জোহানেসবার্গে অলিভার টাম্বোকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আইনচর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন৷
ছবি: AP
বর্ণবিদ্বেষ
বর্ণবিদ্বেষ – সোজা কথায় বললে কৃষ্ণাঙ্গ এবং শেতাঙ্গদের মধ্যকার মৌলিক বিভাজন – শিশু এবং তরুণকালে ম্যান্ডেলার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে৷ ফলে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন তিনি৷ কোসা ভাষায় ম্যান্ডেলার বাবা তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘‘রোলিলালা৷’’ এই নামের অর্থ হচ্ছে, ‘‘যিনি শাখা ভেঙে দেন’’, কথ্যভাষায় ‘‘সমস্যা সৃষ্টিকারী৷’’
ছবি: AP
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
১৯৬৪: বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট ম্যান্ডেলা এবং অন্যদের শুনানি চলছিল আদালতে৷ কিন্তু পুলিশ সেই আদালতের বাইরে অবস্থানরতদের সরিয়ে দেয়৷ তথাকথিত ‘রিভোনিয়া ট্রায়াল’ এ ম্যান্ডেলাকে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়৷
ছবি: AP
দীর্ঘ কারাজীবন
রবেন দ্বীপের কারাগারে একটি পাঁচ বর্গমিটার ঘরে ১৮ বছর কাটিয়েছেন ম্যান্ডেলা৷ তাঁর পরিচয় নম্বর ছিল ৪৬৬৬৪৷ জেল থেকে মুক্তির পর ম্যান্ডেলা বলেন, ‘‘আমি একটি নম্বর হিসেবে পরিচিত ছিলাম৷’’
ছবি: cc-by-sa- Paul Mannix
গোটা বিশ্বের আগ্রহ
১৯৮৮ সালে লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে নেলসন ম্যান্ডেলার জন্য একটি দাতব্য সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়৷ সেই অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি সংগীতশিল্পীরা ম্যান্ডেলার সত্তরতম জন্মদিন উদযাপন করেছেন এবং বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷ দশঘণ্টার সেই কনসার্টে হাজির হয়েছিলেন সত্তর হাজার মানুষ, যা ষাটটির বেশি দেশে সম্প্রচার হয়েছিল৷
ছবি: AP
অবশেষে মুক্তি
১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি - সাতাশ বছর পর - কারাগার থেকে মুক্তি পান ম্যান্ডেলা৷ ছবিতে মুষ্টিবদ্ধ হাত উচিয়ে ম্যান্ডেলা এবং তাঁর তৎকালীন স্ত্রী উইনি দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বিরুদ্ধে নিজেদের বিজয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছেন৷
ছবি: AP
রাজনীতিতে ফেরা
১৯৯০ সালের মে মাসে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি)-র হাল ধরেন ম্যান্ডেলা এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রিডেরিক উইলিয়াম ডি ক্লার্ক (বামে) সঙ্গে আলোচনায় নেতৃত্ব দেন৷ এই আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বর্ণবিদ্বেষ মুছে ফেলার উপায় বের করা৷ ১৯৯৩ সালে তিনি এবং ক্লার্ক নোবেল শান্তি পুরস্কার জয় করেন৷
ছবি: AP
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট
১৯৯৪ সালের ১০ মে দিনটি ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে৷ সে বছরের এপ্রিলে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়লাভের পর সেদিন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ম্যান্ডেলা৷ ১৯৯৯ সাল অবধি এই দায়িত্বে ছিলেন তিনি৷ পরবর্তীতে তাঁর কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাবো এমবেকি৷
ছবি: AP
‘‘রেইনবো নেশন’’ কি ব্যর্থ হয়েছে?
২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বড় শহরগুলোর অনেক বস্তিতে বিদেশি বিদ্বেষ এবং সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে৷ এ সময় অনেক অভিবাসী প্রাণ হারায়৷ ফলে যে প্রশ্নটি দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে যে ‘‘রেইনবো নেশন’’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ম্যান্ডেলা, বিশেষ করে যেখানে সবার মিলে মিশে থাকার কথা, সেটি কি ব্যর্থ হয়েছে?
ছবি: AP
ক্রীড়াপ্রেমী ম্যান্ডেলা
যুব বয়সে নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন একজন বক্সার৷ খেলাধুলা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ছিল এরকম – খেলায় শ্রেণি, ধর্ম বা বর্ণের কোনো ভূমিকা নেই৷ ক্রীড়াপ্রেমি ম্যান্ডেলা কারাগারে থাকার সময়ও নিজেকে ফিট রেখেছেন৷ সেখানে তিনি নিয়মিত ব্যায়াম করতেন৷
ছবি: Getty Images
শেষবার জনসম্মুখে
২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ আর সেসময়ই ম্যান্ডেলাকে শেষবারের মতো জনসম্মুখে দেখা গিয়েছিল৷ উপরের ছবিটি ২০০৪ সালের ১৫ মে তারিখের৷ কারণ ঐ বছরই দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত হয়৷
ছবি: AP
ম্যান্ডেলার সঙ্গে ড. ইউনূস
২০০৯ সালে ম্যান্ডেলার ৯১তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে আয়োজিত উৎসবে বক্তব্য রেখেছিলেন বাংলাদেশের নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷ ম্যান্ডেলার মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীকে লেখা চিঠিতে ইউনূস ঐ ঘটনাটিকে তাঁর জীবনের অন্যতম সুখকর ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন৷
ছবি: AP
জীবনের শেষ দিনগুলো
ম্যান্ডেলা তাঁর জীবনের শেষ কয়েকটি বছর মানুষের সামনে আসেননি৷ সে সময়টুকু তিনি পরিবারের সাথে কাটিয়েছেন৷ ছবিতে ২০১১ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার ৯৩তম জন্মদিনে তাঁকে নাতি-পুতিদের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
16 ছবি1 | 16
কিন্তু ২৭ বছরের কারাজীবনে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে আনার পরিকল্পনা থেকে এএনসিকে বের করে আনেন ম্যান্ডেলা৷ হিংসার পথ ছেড়ে তাঁর অহিংসার পথে আসার পেছনে মহাত্মা গান্ধীর জীবন বড় প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল৷ সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতেও এসেছিল পরিবর্তন৷ পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছিল যুক্তরাষ্ট্রেও৷ তাই যে দেশে ম্যান্ডেলার নাম একটা সময় পর্যন্ত প্রকাশ্যে, শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করা ছিল অস্বাভাবিক, সে দেশেই আশির দশকে ডেমোক্র্যাট দলের প্রয়াত সেনেটর টেড কেনেডির উদ্যোগে বর্ণবাদ বিরোধী বিল উত্থাপন করা হয়৷ বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন সফল করায় সেই উদ্যোগ বড় ভূমিকা রেখেছিল৷
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল৷ টেড কেনেডির উদ্যোগে আনা বর্ণবাদ বিরোধী বিলের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি৷ সেই বিল অনুযায়ী দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে আপত্তি ছিল তাঁর৷ রেগান বলেছিলেন, তিনি মনে করেন, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে দক্ষিণ আফ্রিকায় অশ্বেতাঙ্গদের ওপর নির্যাতন আরো বাড়বে৷
তবে প্রেসিডেন্টের এই মতামত যুক্তরাষ্ট্রে তখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়নি৷ কংগ্রেসে রেগানের ‘ভেটো' হালে পানি পায়নি৷ যুক্তরাষ্ট্র অতীতের পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে সার্বিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর৷ তাতে খুব চাপে পড়েছিল বর্ণবাদী সরকার, এক সময় ম্যান্ডেলার এএনসির কাছে হার মানতে হয়েছিল বর্ণবাদীদের, দক্ষিণ আফ্রিকায় এসেছিল শ্বেতাঙ্গ এবং অশ্বেতাঙ্গদের সহাবস্থানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি৷
এই পরিবর্তনে এক পর্যায়ে সরাসরি ভূমিকা রাখলেও যুক্তরাষ্ট্রের করা সন্ত্রাসীদের তালিকায় কিন্তু ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছিল ম্যান্ডেলার নাম৷ ততদিনে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া হয়ে গেছে, ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হয়ে মেয়াদও শেষ করে ফেলেছেন সেই ১৯৯৯ সালে৷ ম্যান্ডেলা তখন অবসর জীবনে৷ তখনও তাঁর ‘সন্ত্রাসী' থাকার বিষয়টি গোচরে আসা মাত্রই নড়েচড়ে বসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন৷ তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয় ম্যান্ডেলাসহ এএনসির অন্য সব নেতার নাম৷ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তখন সেনেটর৷ তালিকা থেকে ম্যান্ডেলার নাম বাদ দেয়ার পর তিনি বলেছিলেন, ‘‘অবশেষে বিলটি পাস হলো বলে আমি খুব খুশি৷''