পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রথমবার ইউরোপাীয় ইউনিয়ন সফর করছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। যাবেন ফ্রান্স, সার্বিয়া, হাঙ্গেরিতে।
বিজ্ঞাপন
২০১৯ সালে শি জিনপিং যখন ইইউ সফর করেছেন, সেই সময়ের সঙ্গে বর্তমান সময়ের কোনো তুলনাই চলে না। তখন কেউ কোভিড ১৯-এর নাম জানত না। রাশিয়া যে ইউক্রেনকেএইভাবে আক্রমণ করবে, তাও ভাবা যায়নি। ব্রাসেলস তখন বেজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করছিল।
এখন সময় একেবারে বদলে গেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ইইউ। চীনের প্রতি নির্ভরতা কমাতে নতুন আইন আনা হয়েছে।
শি তার সফর শুরু করছেন ফ্রান্স থেকে। তারপর তিনি সার্বিয়া ও হাঙ্গেরি যাবেন। প্যারিসে তিনি ইইউ-র কঠোর নীতির মুখে পড়তে পারেন। তবে সার্বিয়া ও হাঙ্গেরিতে তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনা পাবেন। কারণ, এই দুই দেশ রাশিয়ার প্রতি নরম নীতি নিয়ে চলতে চায়।
ইউক্রেন নিয়ে আলোচনা চায় ফ্রান্স
সোমবার প্যারিসে শি জিনপিংয়ের সম্মানে একটি নৈশভোজের আয়োজন করেছেন মাক্রোঁ। সেখানে ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েনও থাকবেন। ফরাসি প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে জানানো হয়েছে, আলোচনা পুরোপুরি রাজনৈতিক হবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন প্রসঙ্গ সেখানে গুরুত্ব পাবে।
শি জিনপিং ও তাঁর রাজনীতি
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তৃতীয়বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন। ছবিঘরে দেখুন তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার৷
ছবি: Reuters/Jason Lee
দেরিতে শুরু
কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা শি ঝংজুন ছিলেন তাঁর পিতা৷ পিতার কীর্তি তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়তে শুরুর দিকে বাধা তৈরি করে৷ ১৯৬২-তে দল থেকে বহিষ্কৃত হন ঝংজুন৷ কয়েক বছর পর চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় নিপীড়িত হন, এমনকি জেলেও যেতে হয় তাঁকে৷ সেই পিতার ছেলের আবেদন বারবার প্রত্যাখ্যান করে অবশেষে ১৯৭৪-এ সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে কমিউনিস্ট পার্টি৷ সেই থেকে শুরু শি জিনপিংয়ের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media/Pictures From History
আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন
রসায়ন প্রকৌশলের ছাত্র শি আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে৷ কঠিন পরিশ্রম করেন৷ আট বছর পর দলের পক্ষে প্রথম বড় পদটি পান৷ ১৯৮২ সালে নির্বাচিত হন দলের হের্বেই রাজ্যের সম্পাদক৷ এরপর একে একে বেশ কয়েকটি প্রদেশের গভর্নর নির্বাচিত হন৷ এমনকি চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য ও ব্যবসাকেন্দ্র সাংহাই রাজ্যদলের প্রধানের পদটিও ঝুলিতে পুরে নেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/CPA
রাষ্ট্রপ্রধান শি
শি’র ক্যারিয়ারে ২০১২ সালের ১৫ নভেম্বর খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন৷ যে দল তাঁর পিতাকে বহিষ্কার করেছে সেই কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি৷ এমন কি কেন্দ্রীয় কমিটি তাঁকে সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত করে, যার অর্থ হলো, অলিখিতভাবে তিনি হয়ে ওঠেন চীনের নেতা৷ সাবেক প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও-এর দু’বারের মেয়াদ শেষ হবার পর চীনের জাতীয় কংগ্রেস তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে৷
ছবি: GOH CHAI HIN/AFP/Getty Images
দ্য চাইনিজ ড্রিম
নির্বাচনের পর শি-এর রাজনৈতিক শ্লোগান হয় ‘চাইনিজ ড্রিম’৷ অনেকে একে আমেরিকান ড্রিমের সঙ্গে মিলিয়ে ফেললেও আসলে এর অর্থ চীনের নবউত্থান৷ শি একে ‘চীনা জাতির মহাউত্থান’ হিসেবেই উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, চীনকে পৃথিবীতে এর ‘প্রাপ্য জায়গা’ নিশ্চিত করতে হবে৷ তাঁর মতে, সেই জায়গা করতে গিয়ে ‘শত্রুর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে’ যেতেও পিছপা হবে না চীন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Wong
ঐতিহাসিক বৈঠক
১৯৪৯ সালের চীনের গৃহযুদ্ধের পর শি’ই প্রথম কোনো চীনা নেতা যিনি তাইওয়ানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ ২০১৫ সালের ৭ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট মা ইয়িং-জু’য়ের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি৷ তার মানে এই নয় যে তিনি ছাড় দিতে রাজি আছেন৷ ২০১৮ সালের মার্চে তিনি তাইওয়ানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, যদি আলাদা হবার চিন্তা আসে মাথায়, তাহলে ‘ইতিহাসের শাস্তি’ জুটবে তাদের কপালে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/W. Maye-E
মূল নেতা
২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর শি কমিউনিস্ট পার্টির মূল নেতার স্বীকৃতি পান৷ এ স্বীকৃতি এর আগে কেবল আধুনিক চীনের স্থপতি, দলের সাবেক চেয়ারম্যান মাও সেতুং এবং আরেক সাবেক চেয়ারম্যান দেং জিয়াওপিং ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন পেয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/Feng Li
সামরিক প্রভাব
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে চীনের সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীকে কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের (যেটি মূলত সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে) নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়৷ এতে করে ৬ লাখ ৬০ হাজার শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ক্ষমতায় অনির্দিষ্টকাল
একনায়কতন্ত্রের খড়গ হতে দেশকে বাঁচাতে ১৯৮২ সালে জিয়াওপিং নিয়ম করেন যে, একজন দু’বারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না৷ ২০১৮ সালের ১৭ মার্চ, চীনের সংসদ শি’কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে এবং ভোটের মাধ্যমে সংশোধনী প্রস্তাব পাশ করে যে, একজন প্রেসিডেন্টের দু’বার নয়, বরং অনির্দিষ্টবারের জন্য নির্বাচিত হতে পারবেন৷ তাই শি-এর সামনে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রেসিডেন্ট থাকার পথ খোলা৷
ছবি: Reuters/Jason Lee
8 ছবি1 | 8
২০২২ থেকে ইইউ রাশিয়ার বিরুদ্ধে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু চীন রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ফ্রান্সে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত অবশ্য দাবি করেছেন, রাশিয়ার প্রতি চীন নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে চলছে।
ফ্রান্সের সরকারি সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া যাতে এই বিরোধ মেটানোর রাস্তায় আসে তার জন্য চীনকে চাপ দেবে ফ্রান্স।
তবে এই চাপে কতটা কাজ হবে তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ, গতবছর ফ্রান্সের অনুরোধে শি জিনপিং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হন। কিন্তু তারপর কিছুই বদলায়নি।
প্যারিসের ক্যাথলিক ইনস্টিটিউটের গবেষক এমানুয়েল লিনকট ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''মাক্রোঁর সঙ্গে শি জিনপিংয়ের বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই মাসের শেষের দিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট চীন সফরে যাচ্ছেন। ফলে বেজিং তাদের অবস্থান থেকে সরবে বলে মনে হয় না।''
তার মতে, ''আন্তর্জাতিক বিষয়ে শি জিনপিংয়ের অবস্থান বিন্দুমাত্র বদলের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।''
শি-জেলেনস্কি কথা, শান্তির দূত পাঠাবে চীন
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কথা বললেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে। শান্তি আলোচনা চান শি।
ইউক্রেন সংকটের পর এই প্রথমবার শি জিনপিং এবং জেলেনস্কির মধ্যে ফোনে কথা হলো। জেলেনস্কি বলেছেন, দীর্ঘ ও অর্থপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে দুই নেতা ফোনে কথা বলেছেন।
ছবি: kyodo/dpa/picture alliance
শি যা বলেছেন
শি জিনপিং বলেছেন, ইউক্রেন সংকটে চীন বরাবরই শান্তির পক্ষে থেকেছে। তারা চায়, দ্রুত শান্তি ফিরে আসুক। তার দাবি, চীনের পররাষ্ট্রনীতি সবসময়ই বাস্তবসম্মত ও বিষয়মুখি। শি জানিয়েছেন, চীন কখনই আগুনে ঘি দেবে না। তারা কোনো পক্ষের হয়ে কথা বলবে না।
ইউক্রেনে দূত পাঠাবেন শি জিনপিং। সেই দূত সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলবে। শান্তির জন্য চেষ্টা করবে। ওই দূত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করবেন। রাশিয়ায় চীনের সাবেক রাষ্ট্রদূতকেই ইউক্রেনে বিশেষ দূত হিসাবে পাঠাচ্ছেন শি।
ছবি: Ihor Tkachov/AFP/Getty Images
জেলেনস্কি খুশি
শি জিনপিংয়ের শান্তিপ্রয়াসে জেলেনস্কি খুশি। তিনি বলেছেন, আমরা দুজনেই চাইছিলাম, কথা হোক। শি জিনিপং যে শান্তির ডাক দিয়েছেন এবং দূত পাঠাচ্ছেন, তাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরালো হবে।
ছবি: Efrem Lukatsky/AP Photo/picture alliance
রাষ্ট্রদূত নিয়োগ
শি-র সঙ্গে ফোনে আলোচনার পরই জেলেনস্কি চীনে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূতের নাম ঘোষণা করেন। তিনি জানিয়েছেন, পাভেল রিয়াবিকিন চীনে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত হিসাবে কাজ করবেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চীনে ইউক্রেনের কোনো রাষ্ট্রদূত ছিলেন না।
হোয়াইট হাউস থেকে শি ও জেলেনস্কির মধ্যে ফোনে আলোচনাকে স্বাগত জানানো হয়েছে। তবে এর ফলে শান্তিচুক্তি হবে কিনা সে বিষয়ে অ্যামেরিকা কোনো কথা বলেনি। জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত মুখপাত্র জন কিরবি বলেছেন, ''এর ফলে কোনো শান্তিপ্রস্তাব আসবে কি না, শান্তিস্থাপিত হবে কি না, তা আমরা জানি না।'' উপরের ছবিতে জন কিরবি।
ছবি: John Kirby/REUTERS
১২ দফা প্রস্তাব
এর আগে চীন ১২ দফা শান্তিপ্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাব ইউক্রেন খারিজ করে দেয়।
ছবি: Wang Zhao/AFP/Getty Images
রাশিয়ার প্রশংসা
চীন যেভাবে ইউক্রেনে শান্তি ফেরানর উদ্য়োগ নিয়েছে তার প্রশংসা করলো রাশিয়া। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, চীনের এই প্রয়াস প্রশংসনীয়। তবে তিনি ইউক্রেনের মনোভাবের নিন্দা করেছেন।
ছবি: ALEXANDER NEMENOV/AFP
8 ছবি1 | 8
ইইউ-চাীন বাণিজ্য সম্পর্ক
শি জিনপিংয়ের সফরের সময় বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা হবে। বলা হচ্ছে, এয়ারবাস চীনকে বড় অর্ডার দিতে পারে। তবে ইইউ-র বরাবরের বক্তব্য, তারা চীন থেকে অনেক বেশি জিনিস আমদানি করে, তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ অনেক কম।
গতবছর চীনের ইলেকট্রিক গাড়ি নিয়ে তদন্ত করার পর ইইউ জানিয়ছিল, বেজিং এই গাড়ির জন্য প্রচুর ভর্তুকি দিচ্ছে।
ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইসাবেলা ফেং জানিয়েছেন, তিনি মনে করেন, ইইউ-চীন বাণিজ্য খুব ধীরে ধীরে কম হতে থাকবে।
ফ্রান্সের পর সার্বিয়ায়
ফ্রান্সের পর সার্বিয়ায় যাবেন শি। এই সময়টাও খুব তাৎপর্যপূর্ণ। ২৫ বছর আগে বেলগ্রেডে মার্কিন বোমা আঘাত করেছিল চীনা দূতাবাসকে। সেই সময় যুগোস্লাভিয়ায় বিরুদ্ধে ন্যাটোর সংঘাতের অংশ ছিল ওই আক্রমণ।
পরে অ্যামেরিকা ওই ঘটনার জন্য ক্ষমা চায়। নিহত চীনা নাগরিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণও দেয়। কিন্তু চীনে অনেকে এখনো মনে করেন, ইচ্ছাকৃতভাবেই তাদের দূতাবাসে বোমা ফেলা হয়েছিল।
বেলগ্রেডের গবেষক স্তেফান ব্লাদিস্লাভিলজেভ বলেছেন, ''চীনের কাছে এটা একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বড় পশ্চিমা শক্তি তাদের ক্ষতি করেছিল। তারা এই ন্যারেটিভ নিয়ে চলতে চাইছে যে, বিশ্ব ব্যবস্থার পুনর্গঠন জরুরি।''