ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ডিসিসিআই-এর গবেষণায় দেখা গেছে গত পাঁচ মাসের হরতালে বাংলাদেশের শিল্প এবং ব্যবসা-বণিজ্য খাতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৫১ হাজার কোটি টাকা৷ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তৈরি পোশাক খাত৷
বিজ্ঞাপন
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাস্তবে ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি৷
জানুয়ারি থেকে মে – এই পাঁচ মাসে দেশব্যাপী হরতাল হয়েছে ৩২ দিন৷ এর বাইরে আঞ্চলিক হরতাল এবং অবরোধসহ অন্যান্য কর্মসূচি ছিল, যা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করেছে৷ ডিসিসিআই গবেষণা করে দেখিয়েছে যে প্রতিদিনের হরতালে ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৬শ' কোটি টাকা৷ সেই হিসেবে ৩২ দিনের হরতালে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা৷ এই ক্ষতির শীর্ষে আছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প৷ এক দিনের হরতালে পোশাক শিল্পে ৩৬০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়৷ আর ৩২ দিনের হরতালে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা৷
হরতালের আগুনে জ্বলছে বাংলাদেশ
যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিবাদে চলতি সপ্তাহে হরতালের সূচনা করে জামায়াত-শিবির৷ এএফপির হিসেবে গত ২১শে জানুয়ারি থেকে ৪ই মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি৷ হরতালের কিছু ছবি নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Reuters
বরিশালে অগ্নিসংযোগ
জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতালের দ্বিতীয় দিন ৪ই মার্চ বরিশালে মোটর সাইকেলে অগ্নি সংযোগ করছে দলটির সমর্থকরা৷ এভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় হরতালের সময় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের উপর হামলায় অংশ নেয় জামায়াত-শিবিরের সমর্থকরা৷ উদ্দেশ্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা৷
ছবি: Reuters
সহিংসতায় নিহত কমপক্ষে ৮০
ঢাকায় ৪ মার্চ হরতাল চলাকালে জামায়াতে ইসলামী কর্মী সন্দেহে এক ব্যক্তিকে আটক করছে পুলিশ৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবিতে গত ২১শে জানুয়ারি থেকে জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন সহিংস কর্মসূচিতে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি৷ নিহতদের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের সদস্য ছাড়াও পুলিশ, আওয়ামী লীগ কর্মী, নিরীহ পথচারী এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকও রয়েছেন৷
ছবি: Reuters
ট্রেনে আগুন
ঢাকায় হরতাল চলাকালে ৪ মার্চ কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানরত একটি ট্রেনে আগুন লাগে৷ ছবিতে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন জনতা৷ ঢাকা থেকে নোয়াখালিগামী ট্রেনটির তিনটি বগি আগুনে পুড়ে গেছে৷ রেলমন্ত্রী মাজিবুল হক ট্রেনে অগ্নিসংযোগের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: Reuters
মসজিদ থেকে গ্রেপ্তার
হরতাল চলাকালে ৪ মার্চ ঢাকার একটি মসজিদ থেকে জামায়াত কর্মী সন্দেহে কয়েকজনকে আটকে করে পুলিশ৷ জামায়াতের ভাইস-প্রেসিডেন্ট দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার পর বাংলাদেশে সহিংসতার তীব্রতা বেড়ে যায়৷ ২৮ ফেব্রুয়ারি এই রায় ঘোষণার পর বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় ৪ মার্চ অবধি প্রাণ হারিয়েছেন ৬৪ ব্যক্তি৷
ছবি: Reuters
অব্যাহত অগ্নিসংযোগ
হরতালের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে অগ্নিসংযোগ৷ রাস্তায় টায়ার পোড়ানো, গাড়িতে আগুন, ট্রেনে আগুন, মার্কেটে আগুন – চলতি হরতালে সবই দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে এখন হরতালের সহিংসতার ভিডিও পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের সব প্রান্তে৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ৩ মার্চ রাস্তায় অগ্নিসংযোগ করছে জামায়াতের সমর্থকরা৷
ছবি: Reuters
‘কপাল পোড়ে’ সাধারণ মানুষের...
জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নেমেছিলেন এই অটোরিকশা চালক৷ ২ মার্চ ঢাকায় জামায়াতের কর্মীদের ছোড়া ইটের টুকরায় গুরুতর আহত হন তিনি৷ অটোরিকশাও ভেঙ্গে গেছে৷ রাজনৈতিক সহিংসতায় এভাবেই ‘কপাল পোড়ে’ সাধারণ মানুষের৷
ছবি: Reuters
শরিক জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি’র তাণ্ডব
দুই মার্চ ঢাকায় এভাবেই গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র কর্মীরা৷ সেদিন ঢাকায় মিছিল করেছিল বিএনপি এবং জামায়াতের সমর্থকরা৷ পুলিশ অবশ্য বিরোধীদের কঠোর হাতে মোকাবিলার চেষ্টা করছে৷
ছবি: Reuters
রাবার বুলেট, বুলেট
২ মার্চ ঢাকায় বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে বন্দুকে রাবার বুলেট ‘লোড’ করছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা৷ তবে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, সেদিন সংঘর্ষ চলাকালে সত্যিকারের বুলেটও ব্যবহার করে পুলিশ৷ এছাড়া হরতাল চলাকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ আত্মরক্ষায় বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে৷
ছবি: Reuters
চোখের সামনে জ্বলছে আগুন
২ মার্চ ঢাকায় বিএনপি সমর্থকরা গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে৷ ছবিতে পুলিশ একটি জ্বলন্ত গাড়ি দেখছে৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে চলমান সহিংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে সমর্থন জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি৷
ছবি: Reuters
একদিনে নিহত কমপক্ষে ৩৪
২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে ফাঁসির রায় ঘোষণার দিনে সহিংসতায় বাংলাদেশে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৩৪ ব্যক্তি৷ এদের মধ্যের ২৩ জন পুলিশ এবং ইসলামপন্থিদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন৷ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একদিনে এত সহিংসতা দেখেনি বাংলাদেশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
10 ছবি1 | 10
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর সহ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, দীর্ঘ মেয়াদে এর চেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়ছে পোশাক শিল্প৷ ক্রেতারা হরতালসহ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে৷ এর প্রধান কারণ হলো তাদের নির্ধারিত সময়ে পোশাক সরবারাহ করা যাচ্ছে না৷ হরতাল অবরোধের কারণে উত্পাদন পুরোপুরি বন্ধ না থাকলে পরিবহন বন্ধ থাকে৷ তিনি জানান, এসব কারণে পোষাক খাতে প্রবৃদ্ধির ধারা এখন নিম্নমুখী৷ ক্রেতারা এখন চীন, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, তাইওয়ান এবং কম্বোডিয়ার দিকে চলে যাচ্ছে৷ তিনি বলেন, সস্তা শ্রমের কারণে পোশাকের দাম কম হলেই চলবে না৷ ঠিক সময়ে পোশাক সরবরাহ করাও জরুরি৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ডিসিসিআই-এর হিসাবে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেনি৷ তিনি বলেন, বাস্তবে এই ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি৷ তাঁর মতে, শুধু এই পাঁচ মাস কেন, বাংলাদেশে যদি হরতাল অবরোধসহ রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকত তাহলে প্রবৃদ্ধির হার হতো শতকরা ১০ ভাগ৷ ডিসিসিআই বর্তমান অবস্থায় উত্পাদন ক্ষতির হিসেব ধরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হিসেব করেছে৷ কিন্তু এই চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় যে সম্ভাবনা নষ্ট হয়েছে তার হিসেব করেনি তারা৷
তিনি বলেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে৷ এরই মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে৷ কমছে রপ্তানি৷ এই ধারা চলতে থাকলে তা অর্থনীতির জন্য হবে বড় আঘাত৷ তাতে বেকারত্ব বাড়বে৷ তার সঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগ যেমন কমবে, তেমনই যাঁরা এখন কাজ করছেন তাঁদের একাংশও কাজ হারাবেন৷
এর বাইরে আরো একটি বড় ধরনের আশঙ্কার কথা বলেন ড. হেলাল৷ তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় তরুণ সমাজের একটি অংশ সেখানে ব্যবহৃত হয়৷ এছাড়া, হেফাজতের মতো মৌলবাদী শক্তির উত্থান হয়৷ সেখানেও তরুণরা জড়িয়ে পড়েন৷ যার ফলে যে তরুণদের উত্পাদন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশ নেয়ার কথা, তাঁরা তা না করে ধ্বংসাত্মক কাজে জড়িয়ে পড়েন৷ যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে৷