পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে
১৩ ডিসেম্বর ২০১৯২০০৮ সালে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এসেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির একটি- যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে আওয়ামী লীগ৷ তখন থেকেই পাকিস্তান এই বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বেশ সরব ভূমিকা নিয়ে আসছে৷ আন্তর্জাতিক নানা সংস্থাতেও দেশটির প্রতিনিধিরা একে বিতর্কিত করার সবরকম চেষ্টা চালিয়েছেন৷
ফলে এ নিয়ে নতুন করে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি হয়৷
২০১২ সালের নভেম্বর৷ আমি তখন একটি বেসরকারি টেলিভিশনের কূটনৈতিক সংবাদদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করি৷ খবর আসে, ইসলামাবাদে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোট ডি-৮-এর শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানাতে কয়েক ঘণ্টার জন্য ঢাকা আসছেন তৎকালীন পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানী খার।
যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে বিতর্ক শুরুর পর পাকিস্তান সরকারের শীর্ষস্থানীয় কোনো প্রতিনিধির এটিই প্রথম ঢাকা সফর৷ ফলে সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের ভিড়৷ তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি মাত্র কিছুক্ষণ স্থায়ী বৈঠকেই আলোচনায় তুলে আনেন ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি৷
জবাবে হিনা রব্বানী খার বলেন, দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পেছনের কথা ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু ‘পেছনের কথা' যে হিনা বা পাকিস্তানের অন্য রাজনীতিবিদ, সামরিক শাসকদের মতো এতো সহজে ‘ভুলে যাওয়া' যায় না, সেটা পাকিস্তান আবারো প্রমাণ করে মাত্র কদিন পরেই৷ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়৷ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে এর প্রতিক্রিয়ায় নিন্দা জানায়৷
মজার বিষয় হলো পাকিস্তান জামায়াতের সংসদ সদস্য শের আকবর খান নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করলে তাতে সমর্থন জানায় দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ৷ এছাড়া মুসলীম লীগ, আওয়ামী মুসলীম লীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কায়েদে আজম) ও জমিয়তে উলামা ইসলামও এই প্রস্তাবে সমর্থন জানায়৷
প্রস্তাবে বলা হয় ‘বাংলাদেশের উচিত হবে না ৪২ বছর আগের পুরনো ক্ষতকে নতুন করে জাগিয়ে তোলা'৷
২০১৬ সালে আরেক যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির পরও বিবৃতি দেয় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ ফাঁসির ঘটনায় পাকিস্তান ‘গভীরভাবে শোকাহত' বলে উল্লেখ করা হয়৷ বলা হয়, "তার একমাত্র অপরাধ ছিল তিনি (১৯৭১ সালে) পাকিস্তানের সংবিধান এবং আইন সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেছিলেন।"
সকল বিরোধীতার মধ্যেও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার এগিয়ে চলেছে৷ এখন রাজাকারের তালিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে৷ স্বভাবতই বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির ‘অন্ধকার দিক' আমাদের অনেককে ভাবিয়ে তুলছে, এই তালিকা মুক্তিযুদ্ধের তালিকার মতো নিজ স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয় কিনা৷
কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্য৷ রাজাকার বাহিনী কোনো হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ‘অখণ্ডতা রক্ষার দেশপ্রেমিক বাহিনী' ছিল না৷ বরং মুক্তিযোদ্ধাদের ঠেকাতে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর সুপরিকল্পিত সৃষ্টি ছিল এই সশস্ত্র বাহিনী৷
১৯৭১ সালের ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স ১৯৭১ জারি করে রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন৷ ৭ সেপ্টেম্বর জারিকৃত পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়৷ পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক অধিনায়ক জেনারেল এ.কে নিয়াজি৷ পরবর্তী পর্যায়ে এই বাহিনীকে একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তরের মর্যাদা দেওয়া হয়৷ রাজাকারদের অস্ত্র সরবরাহই নয়, যুদ্ধের ট্রেনিংও দেয় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী৷
ফলে সেসময়ে রাজাকার বাহিনীর যে নৃশংসতা ও অপরাধ, তার দায় কোনোমতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও সরকার এড়াতে পারে না৷ নিকট অতীতে রাষ্ট্রীয়ভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধীতা থেকে এটাও স্পষ্ট, পাকিস্তান এখনও ১৯৭১ সালের গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের জন্য একেবারেই অনুতপ্তও নয়৷
জার্মানিতে ইহুদিদের ওপর যে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল হিটলারের নাৎসি বাহিনী, সেজন্য এখনও দেশটির সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান বিভিন্ন দেশের কাছে সুযোগ পেলেই ক্ষমা চান৷ নাৎসি বাহিনীকে নিষিদ্ধ করা থেকে শুরু করে আবার যাতে এরা মাথাচাড়া দিতে না পারে, সে ব্যবস্থাও সরকারই নিয়েছে৷
রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গেছে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া৷ বাংলাদেশেও জনগণও সোচ্চার, রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিচার চান তারাও৷ আফসোস হয় অর্ধ শতাব্দী কেটে যাচ্ছে, বাংলাদেশ এখনও নিজেদের দাবিই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করতে পারলো না৷ খুব যে চেষ্টা চলছে, সে আলামতও চোখে পড়ছে না৷
পাকিস্তান যতোই ‘পুরানো ক্ষত ভুলে' যাওয়ার কথা বলুক, ক্ষতের নিয়মই এটি৷ যথাযথ চিকিৎসা না হলে গভীর ক্ষতের ব্যথা বরাবরই ফিরে ফিরে আসে৷ তাই না?