গত এক মাসে অন্তত ৪০ জনের বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি আইনের অধীনে অভিযোগ দায়ের করেছে পাকিস্তানের পুলিশ৷ একে আশঙ্কাজনক উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশটির মানবাধিকার কর্মীরা৷
বিজ্ঞাপন
পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনকে কেন্দ্র করে মামলা, হত্যা, সাজার ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে৷ দেশটির বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা থেকে শুরু করে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরও এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে৷
হিউম্যান রাইটস কমিশন অব পাকিস্তান (এইচআরসিপি) জানিয়েছে গত এক মাসে ৪০টিরও বেশি এমন মামলা নিবন্ধন করেছে পুলিশ৷ বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, এই মামলাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে৷ বার্তা সংস্থা ডিপিএ-কে এইচআরসিপির চেয়ারম্যান মেহদী হাসান বলেন, ‘‘এটা (মামলা) অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, যা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উস্কে দিতে পারে বলে আমাদের আশঙ্কা৷''
সবশেষ গত বুধবার ব্লাসফেমি বা ধর্মনিন্দার অভিযোগে এক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে পাকিস্তানের আদালত৷ ৩৭ বছরের ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ, ইসলাম নিয়ে ‘অন্যায়’ এবং ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য করেছেন তিনি৷ যদিও তার আইনজীবীর দাবি, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে না চাওয়ায় তার বিরুদ্ধে ধর্মনিন্দার অভিযোগ করা হয়৷ প্রায় সাত বছর ধরে বিচার চলার পরে মঙ্গলবার নিম্ন আদালত তাকে ফাঁসির সাজা দেয়৷
ব্লাসফেমি আইন
পাকিস্তানে এই আইনের সূচনা হয় সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউল হকের অধীনে ১৯৮০ এর দশকে৷ এই আইন অনুযায়ী ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) কে অবমাননা করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ এছাড়া ইসলাম ধর্ম, পবিত্র কোরআনসহ নির্দিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিদের নিন্দা বা অবমাননায় কারাদণ্ডসহ কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে৷
শিখদের শ্মশানঘাট পাহারায় পাকিস্তানের মুসলিম পরিবার
04:13
যুক্তরাষ্ট্রের কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম (ইউএসসিআরএফ)-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৮০ জন এই ‘ব্লাসফেমির অপরাধে' কারাগারে আটক রয়েছেন৷ তাদের অর্ধেকই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি৷
তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, সংখ্যালঘুদের দমনে এই আইনের অপব্যবহার করা হচ্ছে৷ অনেক ক্ষেত্রে এমনকি মুসলিমরাও ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে একজন আরেকজনকে ব্লাসফেমি মামলায় ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন৷
বিচারের আগেই হত্যা
জুলাই মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানের পেশোয়ারে তাহির নামিস নামে একজনকে বিচার চলাকালে আদালতকক্ষের ভিতরেই গুলি করে হত্যা করা হয়৷ তার বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছিল৷ ঐ ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় বিবৃতি দিয়ে নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ হত্যাকারীকে ‘ধর্ম যোদ্ধা’ অ্যাখ্যা দিয়ে তার মুক্তির দাবিতে তখন মিছিলও করে কয়েক হাজার কট্টর সমর্থক৷
বিচার চলাকালীন এমন হত্যার ঘটনা এই প্রথম নয়৷ ১৯৮০-র দশক থেকে এখন পর্যন্ত ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছে এমন ৭৫ জন ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন৷
এইচআরসিপি চেয়ারম্যান মেহদী হাসান বলেন, বিচারাধীন ব্যক্তির ভাগ্য মানুষের করুণার উপর ছেড়ে দিয়ে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন করছে৷
জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরও এ নিয়ে মুখ খুলেছে৷ সংস্থার মুখপাত্র রুপার্ট কলভিলে সাংবাদিকদের বলেন, ব্লাসফেমির অভিযোগ খুবই উদ্বেগজনক৷ কেননা, অভিযুক্ত ব্যক্তি সহিংসতার ঝুঁকিতে পড়ছেন৷ এ বিষয়ে পাকিস্তানের সরকারের কাছে তারা উদ্বেগ তুলে ধরেছেন বলেও জানান তিনি৷ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে ব্লাসফেমি আইনের প্রয়োগ বাড়ছে উল্লেখ করে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার উস্কানিমূলক ঘটনা বন্ধে দেশটির নেতৃত্বের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তারা৷
এফএস/এসিবি (ডিপিএ, এএফপি, রয়টার্স)
২০১৮ সালের ছবিঘরটি দেখুন...
পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইন ও একজন আসিয়া বিবি
আসিয়া বিবি পাকিস্তানের এক খ্রিষ্টান নারী৷৷ ২০১০ সালে তাঁকে পাকিস্তানের এক আদালত ব্লাসফেমির দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়৷ কে এই আসিয়া, কেনই বা তাঁর এই মামলা কেড়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর?
ছবি: picture alliance/dpa
পানি নিয়ে বিরোধ
২০০৯ সালে পাঞ্জাবের শেখুপুরা জেলায় এক মাঠে কাজ করার সময় মহানবি হযরত মোহাম্মদকে অপমান করার অভিযোগ ওঠে আসিয়া বিবির বিরুদ্ধে৷ মাঠে মুসলিম ধর্মাবলম্বী কিছু নারী কাজ করছিলেন৷ আসিয়া বিবি পানি নিতে গেলে ‘অমুসলিম’ বলে তাঁকে পানির পাত্র ধরতে দেননি তাঁরা৷ তারপর তাঁরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আসিয়া বেগমের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্পর্শকাতর বিষয়
মাঠের বাকবিতণ্ডার পর আসিয়ার বাসায় কিছু ‘ক্ষুব্ধ জনতা’ হামলা চালায় বলে জানায় স্থানীয় সংবাদমাধ্যম৷ পরে পুলিশ আসিয়াকে তাদের হেফাজতে নিয়ে যায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনা ব্লাসফেমির অভিযোগের তদন্ত শুরু করে৷ ৯৭ শতাংশ মুসলিমের দেশ পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননাকে বেশ স্পর্শকাতর বিবেচনা করা হয়৷
ছবি: Arif Ali/AFP/Getty Images
বিতর্কিত আইন
১৯৮০ সালে সেনা শাসক জেনারেল জিয়াউল হক ব্লাসফেমি আইন চালু করেন৷ অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, অনেকক্ষেত্রেই এই আইনকে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা মেটানোর কাজে ব্যবহার করা হয়৷ খ্রিস্টান, হিন্দু, এমনকি ইসলামের সংখ্যালঘু গোত্র আহমাদিয়াদের বিরুদ্ধেও এই আইনের অপপ্রয়োগ করা হয়৷
ছবি: Noman Michael
রাষ্ট্র বনাম আসিয়া
২০১০ সালে এক আদালত আসিয়াকে ধর্ম অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে৷ বাদীর আইনজীবী অভিযোগ করেন, ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছে৷ কিন্তু আদালত আসিয়ার ফাঁসির রায় দেন৷ ২০১০ সাল থেকেই আসিয়ার পরিবার ভয়ের মধ্যে বাস করছে৷ তখন থেকে আসিয়ার মুক্তির জন্য তাঁর স্বামী আশিক মাসিহ আইনি-যুদ্ধ করে চলেছেন৷
ছবি: picture alliance/dpa
গুপ্তহত্যার শিকার সমালোচকরা
২০১০ সালে পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর সালমান তাসির আসিয়ার পক্ষে দাঁড়ান৷ ব্লাসফেমি আইনের সংস্কারেরও দাবি তুলে তিনি৷ তাঁর এই অবস্থানে ক্ষুব্ধ হয় চরমপন্থিরা৷ ২০১১ সালে ইসলামাবাদে নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন তাসির৷ একই বছর ব্লাসফেমি আইনের আরেক সমালোচক তৎকালীন সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিও বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন৷
ছবি: AP
হত্যাকারীকে সংবর্ধনা
তাসিরের হত্যার পর চরমপন্থি নেতা কাদরি রীতিমতো নায়কে পরিণত হন৷ তাকে কারাগারে নেয়ার সময় লাল গোলাপ ছিটিয়ে সংবর্ধনা দেয়া হয়৷ ২০১৬ সালে কাদরিকে ফাঁসি দেয়া হয়৷ কাদরির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হাজার হাজার ইসলামপন্থি জড়ো হয়েছিলেন৷ এমনকি কাদরির নামে তার স্মরণে একটি মাজারও প্রতিষ্ঠা করে তার সমর্থকরা৷
ছবি: AP
বিচার বিভাগে ভীতি
ব্লাসফেমি আইনের সমালোচকদের হত্যাকাণ্ডে ভয় ঢুকেছে আইনজীবীদের মধ্যেও৷ আসিয়ার পক্ষে হাই কোর্টে লড়তে কোনো আইনজীবীই সম্মতি জানাননি৷ ২০১৪ সালে লাহোর হাই কোর্ট আসিয়ার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে৷ ২০১৬ সালে এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে গেলেও এক বিচারক ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে তাতে অংশ নিতে রাজি হননি৷
ছবি: Reuters/F. Mahmood
আইনের খাড়া
অ্যামেরিকান সেন্টার ফর ল অ্যান্ড জাস্টিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে পাকিস্তানে অন্তত ৪০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সেক্যুলার মুসলিমদের এই আইনের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়৷ এখনো এই আইনের আওতায় কারো বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করা না হলেও ক্ষুব্ধ জনতার হাতে মৃত্যুর উদাহরণ রয়েছে অনেক৷
ছবি: APMA
ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর নিপীড়ন
পাকিস্তানে খ্রিষ্টান ও অন্যান্য অমুসলিম ধর্মাবলম্বীরা প্রায়ই আইনি ও সামাজিক বৈষম্যের অভিযোগ করেন৷ গত কয়েক বছরে প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র সন্দেহের বশে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে অনেক খ্রিষ্টান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে৷
ছবি: RIZWAN TABASSUM/AFP/Getty Images
ইসলামপন্থিদের হুমকি
আসিয়ার মৃত্যুদণ্ডের রায় পালটে গেলে ‘ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির’ হুমকি দিয়ে রেখেছে পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা, বিশেষ করে তেহরিক-ই-লাবাইক পাকিস্তান- টিএলপি৷ দেশটির খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের আশংকা, বিচারকরা রায় পালটানোর সিদ্ধান্ত জানালে পুরো দেশজুড়ে তাঁদের ওপর নৃশংসতা শুরু হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/B. K. Bangash
আন্তর্জাতিক সমর্থন
বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের সরকার ও মানবাধিকার সংগঠন আসিয়ার মামলার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়েছে৷ আসিয়ার মেয়ে ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়ে পোপ ফ্রান্সিসের সাথে দেখা করে এসেছেন৷২০১৪ সালে লাহোর হাই কোর্টের রায়কে ‘ভয়াবহ অবিচার’ আখ্যা দেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ অ্যামেরিকান সেন্টার ফর ল অ্যান্ড জাস্টিস আসিয়ার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের নিন্দা জানিয়েছে৷