মারভিয়া মালিক নামে একজন ট্রান্সজেন্ডার প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের একটি টিভি চ্যানেলে সংবাদ পাঠিকা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন এবং সংবাদ উপস্থাপন করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
মারভিয়া মালিক কোনো চ্যানেলে সংবাদ পাঠিকা হিসেবে চাকরি পাওয়া প্রথম ট্রান্সজেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ৷ না, কোনো সহানুভূতি দেখিয়ে তাঁকে নিয়োগ দেয়নি পাকিস্তানের বেসরকারি চ্যানেল কোহিনূর৷ বরং তাঁর যোগ্যতা দেখেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে৷ মারভিয়া সাংবাদিকতায় স্নাতক৷ এর আগে ফ্যাশন মডেল হিসেবে র্যাম্পেও হেঁটেছেন তিনি৷ তিন মাস ধরে উপস্থাপিকা হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং প্রথমবারের মতো সফলভাবে সংবাদ উপস্থাপনাও করেছেন৷
২৪শে মার্চ চ্যানেল কোহিনূর চ্যানেলে তিনি সংবাদ পাঠ করার সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে তা ভাইরাল হয়ে যায়৷ এর মাত্র কয়েকদিন আগেই পাকিস্তানের ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিলের ফ্যাশন শো-তে ক্যাট ওয়াক করেছিলেন তিনি, যা এর আগে কোনো ট্রান্সজেন্ডার করেননি৷
একটি প্রেমের ছবির অভিনেত্রী হিসেবে ট্রান্সজেন্ডার কর্মী জারা চাঙ্গেজি যখন তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন, তখনই প্রথম আলোচনায় আসেন মারভিয়া৷ তাঁর বয়স এখন ২১ বছর৷ প্রথমবার সংবাদ উপস্থাপনার পর প্রচুর মানুষ ফোন করে এবং বার্তা পাঠিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন তাঁকে৷ এটাকে তিনি নিজের জীবন যুদ্ধের পুরস্কার হিসেবে উল্লেখ করেছেন৷ মারভিয়া বলেন, ‘‘দশম শ্রেণিতে পড়ার পর আমার বাড়ি থেকে পড়ার খরচ বন্ধ করে দেয়া হয়৷ এরপর আমি একটি বিউটি সেলুনে কাজ শুরু করি, যাতে অন্তত সেই অর্থ দিয়ে কলেজে যেতে পারি৷ কিন্তু সেটাও এত সহজ ছিল না৷ রাস্তায় যেসব হিজড়াদের দেখেন, আমার গল্পটাও ঠিক তাদের মতোই হতে পারতো৷ তাই পরিবর্তন আনতে হলে ঘর থেকেই সেটা শুরু করতে হবে৷’’
কেবল পাকিস্তান নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ, যেমন বাংলাদেশ, ভারতে হিজড়াদের উপর প্রায়ই হামলার ঘটনা ঘটে৷ তাঁদের ধর্ষণ করা হয় বা যৌন কর্মে বাধ্য করা হয়৷ অথবা কেউ বাধ্য হয় ভিক্ষা করতে৷ তবে পাকিস্তান এক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়েছে৷ তারা শিক্ষা ও চাকুরির ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বৈষম্য কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে৷
ইন্টারসেক্স এডুকেটর সানা ইয়াসির সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘‘পাকিস্তানে হিজড়াদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে, তবে এখনও অনেক জায়গায় তাঁদের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ সাধারণ মানুষ হিজড়াদের সমকামী হিসেবে ধরে নেয় এবং ঘৃণার চোখে দেখে৷’’
পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক টুইটার পেজ ‘গভর্নমেন্ট অফ পাকিস্তান’-এও অভিনন্দন জানানো হয় মারভিয়াকে৷ সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো৷ এর আগেও মারভিয়া ফ্যাশন মঞ্চে হেঁটে সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন৷ এই মাসের প্রথমদিকে সেনেট ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার নিয়ে নতুন বিল ২০১৭-এ সমর্থন দেয়৷ এর মাধ্যমে তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের মানুষদের আরও ক্ষমতায়ন হয়েছে৷’’
কেবল পাকিস্তানের মানুষই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অভিনন্দন জানানো হয়েছে মারভিয়াকে৷ একজন লিখেছেন, ‘‘পাকিস্তানের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের উপস্থাপিকা মারভিয়া এর আগে সানসিল্ক ফ্যাশন উইকে র্যাম্পে হেঁটেছিলেন৷ তিনি নিজের মাইলফলককেই অতিক্রম করে গেলেন৷’’
মারভিয়া এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন যার মাধ্যমে তৃতীয় লিঙ্গের অনেক মানুষের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে৷ তবে মারভিয়া সাংবাদিকদের বলেছেন, এখনও অনেক পথ যেতে হবে তাঁকে৷
এপিবি/এসিবি (রয়টার্স, থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন)
পত্র-পত্রিকার প্রচ্ছদে লিঙ্গান্তরী মডেল
ম্যাগাজিন কভারে ট্রান্সজেন্ডার মডেলরা আজ আর বিতর্ক বা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেন না৷ তার কারণ, ছবিঘরের এই ক্রীড়াবিদ ও অভিনেত্রীরা ইতিমধ্যেই পথিকৃৎ হিসেবে যাবতীয় বাধাবন্ধন ভেঙে দিয়েছেন৷
জুলিয়ানা ফারফাল্লা, জার্মান ‘প্লেবয়’ পত্রিকা
মার্কিন প্লেবয় পত্রিকার জার্মান সংস্করণের প্রচ্ছদে এই প্রথম এমন একজন লিঙ্গান্তরী মডেলের ছবি ছাপা হল৷ ‘আই অ্যাম আ সেলিব্রিটি, গেট মি আউট অফ হিয়ার’ শো’তে আবির্ভাবের এক সপ্তাহ আগে রিয়্যালিটি টিভি তারকা ও মডেল জুলিয়ানা ফারফাল্লা প্লেবয়-এর প্রচ্ছদ ভূষিত করলেন৷ ২১ বছর বয়সি জুলিয়ানা ‘জার্মানিজ নেক্স্ট টপ মডেল’ শো-তেও অংশগ্রহণ করেছেন এই আশায় যে, তা ‘‘অপরাপর লিঙ্গান্তরী পুরুষদের প্রেরণা দেবে৷’’
ছবি: Playboy/Christopher von Steinbach
ক্যারোলিন ‘টুলা’ কসি, প্লেবয়
ক্যারোলিন ‘টুলা’ কসি হলেন প্রথম লিঙ্গান্তরী মডেল, যার ছবি প্লেবয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয় (সেটা ছিল ১৯৮১ সাল; ছবিতে তাঁকে নব্বই-এর দশকের একটি প্রচ্ছদে দেখা যাচ্ছে)৷ অন্যান্যদের মতো কসি-ও লিঙ্গান্তরীদের স্বীকৃতির জন্য সংগ্রাম করছিলেন৷ হিউ হেফনারের পুত্র কুপার এখন প্লেবয় এন্টারপ্রাইজেজ সংস্থার সৃজনীমূলক পরিচালক৷ লিঙ্গান্তরী মডেলদের ছবি ছাপানো ‘সঠিক পন্থা,’ বলে কুপার মনে করেন৷
ল্যাভার্ন কক্স, টাইম ম্যাগাজিন
ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটিতে কক্স-কে পথিকৃৎ বলা চলে৷ প্রথম প্রকাশ্যে লিঙ্গান্তরী ব্যক্তি হিসেবে তিনি ২০১৪ সালে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে স্থান পান৷ তবে তাঁকে অধিকাংশ মানুষ চেনেন নেটফ্লিক্স-এর জনপ্রিয় ‘অরেঞ্জ ইজ দ্য নিউ ব্ল্যাক’ সিরিজে লিঙ্গান্তরী মহিলা বন্দি ও হেয়ারড্রেসার সোফিয়া বার্সেট-এর ভূমিকায় তাঁর অভিনয়ের জন্য৷
ন্যাশনাল জিওগ্র্যাফিক পত্রিকার লিঙ্গ সংক্রান্ত বিশেষ সংস্করণ
পত্রিকাটির ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের প্রচ্ছদে এক ৯ বছর বয়সের লিঙ্গান্তরীকে দেখানো হয়৷ ইস্যুটির উদ্দেশ্য ছিল, যে সব কচি-কাঁচারা ‘লিঙ্গ সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত পোষণে সক্ষম’, তারা কিভাবে লিঙ্গ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের দ্বারা প্রভাবিত হয়, তা দেখানো – যেমন মেয়েদের যেভাবে তাদের চেহারার জন্য লজ্জা ও নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়, অথবা ‘সমাজ কিভাবে একজন পুরুষকে গড়ে তোলে৷’
কেইটলিন জেনার, ভ্যানিটি ফেয়ার
সাবেক অলিম্পিক স্বর্ণপদক বিজয়ী ব্রুস জেনার ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ভ্যানিটি ফেয়ার পত্রিকার কভার স্টোরিতে খোলাখুলিভাবে ঘোষণা করেন যে, তিনি তাঁর নাম বদলে কেইটলিন রাখছেন এবং ভবিষ্যতে তিনি একজন লিঙ্গান্তরী মহিলা হিসেবে পরিচিত হবেন৷ ‘আই অ্যাম কেইট’ নামের যে ডকুমেন্টারি সিরিজে তাঁর লিঙ্গান্তর ও মহিলা হিসেবে পরবর্তী জীবন তুলে ধরা হয়েছে, সেখানেও কেইট তাঁর নিজের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন৷
অ্যামেলিয়া গেপিন, উওমেন’স রানিং
২০১৬ সালের জুলাই মাসে উওমেন’স রানিং পত্রিকার প্রচ্ছদে ম্যারাথন দৌড়বীর অ্যামেলিয়া গেপিন-কে দেখানো হয়৷ ‘‘মহিলাদের জন্য সৃষ্ট একটি ম্যাগাজিনের কভারে (আমার) ছবি ছাপার অর্থ, আমার মতো ব্যক্তিদের শুধু দেখাই হচ্ছে না, আমরা যা, সেভাবেই দেখা হচ্ছে,’’ অ্যামেলিয়া পত্রিকাটিকে তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন: ‘‘গৃহীত, অন্তর্ভুক্ত ও স্বাগত হওয়ার একটা অনুভূতি৷’’
হরি নেফ, ‘এল’ পত্রিকা, ইউকে
যুক্তরাজ্যের ‘এল’ পত্রিকার ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ইস্যুর প্রচ্ছদে মার্কিন অভিনেতা ও মডেল হরি নেফ-কে দেখা যায়৷ হরি শুধু লিঙ্গের মাধ্যমে পরিচিত হতে চান না৷ ‘‘একটি আদর্শ জগতে আমাকে শরীর বদলাতে হতো না, এ সব করতে হতো না; আমাকে সুন্দর বা ‘নারীসুলভ’ হতে হতো না, আর মানুষজন সেটা মেনে নিতো,’’ পত্রিকাটিকে বলেন নেফ৷
ভ্যালেন্তিনা সাম্পাইও, ‘ভোগ’ পত্রিকা, প্যারিস
প্যারিসের ‘ভোগ’ পত্রিকা প্রথমবারের মতো তাদের প্রচ্ছদে একজন লিঙ্গান্তরীর ছবি ছাপে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে৷ ট্রান্সজেন্ডার মডেলটি ছিলেন ব্রাজিলের ভ্যালেন্তিনা সাম্পাইও৷ ‘‘যেদিন ম্যাগাজিনের কভারে কোনো লিঙ্গান্তরীর ছবি ছাপা হলে, তা নিয়ে কোনো সম্পাদকীয় লিখতে হবে না, সেদিন বুঝব, আমাদের সংগ্রাম সফল হয়েছে,’’ বলেন ফ্যাশন পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদিকা এমানুয়েল আল্ট৷
বেন মেলৎসার, মেন’স হেল্থ, জার্মানি
পেশীবহুল দেহ, সিক্সপ্যাক ও দাড়ি সম্বলিত বেন মেলৎসার হলেন প্রথম পুরুষ লিঙ্গান্তরী মডেল, যিনি মেন’স হেল্থ পত্রিকার প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছেন৷ ২৩ বছর বয়সে তিনি মহিলা থেকে পুরুষে পরিণত হন৷ ‘‘আমি চিরকাল যা হতে চেয়েছিলাম,’’ আজ তিনি তাই – বলেন মেলৎসার৷ যারা ‘‘ভুল শরীর নিয়ে জন্মেছেন’’, তাদের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ হতে চান মেলৎসার৷