পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননা আইনের অন্ধকার বাস্তবতা
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪৩২ বছর বয়সি ডাক্তার শাহ নওয়াজের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে অপমান ও ধর্মবিরোধী কন্টেন্ট সোশাল মিডিয়ায় প্রচার করার৷ গত সপ্তাহে পাকিস্তানের সিন্ধ অঞ্চলে তাকে গ্রেপ্তার করার সময় বিরোধিতা করলে পুলিশ তাকে গুলি করে৷
কিন্তু নওয়াজের পরিবারের মতে, এই অভিযোগ মিথ্যা৷ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল সে এবং হেফাজতে থাকাকালীন তাকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে তাদের অভিযোগ৷ কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছিল যে, নওয়াজ আত্মপক্ষের কথা বলার সুযোগ পাবেন, জানায় তার পরিবার৷
এই নিয়ে একই সপ্তাহে এমন দুটি মৃত্যু হয়েছে৷ ১২ সেপ্টেম্বর বালুচিস্তান অঞ্চলে একই অভিযোগে থানায় আটক থাকা ৫২ বছর বয়সি এক পুরুষকে হত্যা করা হয়৷
এই হত্যার নিন্দা জানিয়েছে পাকিস্তানের মানবাধিকার সংগঠন এইচআরসিপি৷ একটি বিবৃতিতে তারা জানায় যে, ‘‘ধর্ম অবমাননার অভিযোগ থাকা দুজনের বিচারবহির্ভূত হত্যা বিষয়ে তারা চিন্তিত৷ ধর্ম অবমাননার ঘটনাগুলিতে যে সহিংসতার ধারা দেখা যাচ্ছে, যেখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মীরা অভিযুক্ত, সেটি খুবই উদ্বেগের বিষয়৷''
পাকিস্তানের দীর্ঘ দিনের সমস্যা
পাকিস্তানে ইসলাম ধর্মের সমালোচনা বা নিন্দা করার জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে৷
যদিও আইনের এই ধারায় এখন পর্যন্ত কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি, কিন্তু বেশ কয়েকটি ঘটনায় উত্তেজিত জনতা বিচারের কাজ শুরু হবার আগেই অভিযুক্তকে মেরে ফেলে৷ গত কয়েক বছরে এমন ঘটনার হারও বেড়েছে৷
অনেক ক্ষেত্রে, স্পষ্ট প্রমাণ ছাড়াই শুধু অভিযোগ ওঠার কারণেই প্রাণ হারান অনেকে৷
গত বছর পাঞ্জাব রাজ্যে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ থেকে উত্তেজিত জনতা একটি খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকায় হামলা করে কয়েকটি গির্জা পুড়িয়ে দেয়৷ শয়ে শয়ে মানুষ বাসা ছাড়তে বাধ্য হন৷ স্থানীয় খ্রিষ্টান বাসিন্দাদের মতে, এই ঘটনায় অভিযুক্তদের এখনও বিচার হয়নি৷
২০১১ সালে পাকিস্তানে এই আইনের সংশোধনের পক্ষে থাকা পাঞ্জাবের সাবেক গভর্নর সলমান তাসীরকে তার নিজের দেহরক্ষীই খুন করে৷
ওয়াশিংটন ডিসির গবেষণা সংস্থা উডরো উইলসন সেন্টার ফর স্কলার্সের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই ধরনের ঘটনাগুলি আসলে রাষ্ট্রের সমস্যা সমাধানে অনিচ্ছা বা অপারগতা, সমাজে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও ধর্মীয় শক্তির গভীর প্রভাবের মিশ্র ফল৷''
কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ম অবমাননার অভিযোগকে ব্যক্তিগত ঝগড়া বা ক্ষোভ মেটাতেও অনেকে ব্যবহার করেন বলে জানা গেছে৷ পাকিস্তানে সংখ্যালঘু অধিকারকর্মী রুথ স্টিফেনের মতে পাকিস্তানের সরকার ধর্মীয় মৌলবাদীদের সংগঠিত করে ও উৎসাহ দেয়, যাতে করে এই সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়৷
তার মতে, দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের সূত্রপাত হবে, ‘‘১৯৮০ সাল থেকে সামরিক স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনেতা জিয়ার আমলে যেভাবে আইন ও আইনি প্রক্রিয়াকে বেআইনি ও অসাংবিধানিকভাবে কাটাছেঁড়া করা হয়, তার পর্যালোচনা ও সংস্কার থেকে৷''
মানবাধিকার আইনজীবী তাহিরা আবদুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আদালতে যাবারই দরকার নেই, শুধু গণপরিসরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ করলেই হলো৷ সেটাই উত্তেজিত জনতাকে আরো উসকানি দেবে যাতে তারা আদালতে মামলার অপেক্ষা না করেই অভিযুক্তকে মেরে ফেলে৷''
সরকারের হস্তক্ষেপ কতটা বাস্তবিক?
মানবাধিকার কমিশন এইচআরসিপি দাবি জানিয়েছে এই ঘটনাগুলির নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করুক সরকার৷ কিন্তু কুগেলমানের মতে, ইসলামিস্ট মৌলবাদীরা পাকিস্তানের রাজনীতিতে বহু ক্ষমতার অধিকারী৷
তার মতে, ‘‘নাগরিক ও সামরিক নেতৃত্ব কোনোদিনই তাদেরকে রাগাতে চায়নি৷ পাকিস্তানের ইতিহাসজুড়ে আমরা দেখেছি যে, যারা ধর্ম অবমাননা আইনের ফায়দা লোটে বা যারা এই আইন ভঙ্গকারীদের প্রতি সহিংসতা সমর্থন করে, তাদের বিষয়ে রাষ্ট্র সব সময়েই খুব সাবধানী থেকে এসেছে৷''
রুথ স্টিফেন বলেন, নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলের উচিত পাকিস্তানকে এবিষয়ে চাপে রাখা৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়স ফ্রিডমের মতে পাকিস্তান ধর্ম অবমাননা বিষয়ক আইনের প্রয়োগ বিশ্বে আরো অনেকের চেয়ে বেশি কঠোরভাবে করছে৷
কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল নিষেধাজ্ঞার পথ বেছে নেবে না বলে মত কুগেলমানের৷
তিনি বলেন, ‘‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সরকারগুলি বারবার এই সমস্যাকে চিহ্নিত করে আসছে৷ কিন্তু শুধু চিহ্নিত করলেই সমস্যার সমাধান হবে না, কিন্তু এতে করে অন্তত সমস্যাটি আলোচনায় থাকে, তাও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷''
এবিষয়ে আরো যোগ করে তিনি বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক চাপ সমাজে বাড়ন্ত মব লিঞ্চিং থামাতে পারবে না, কিন্তু এই ইস্যুকে হারিয়ে যেতেও দেবে না৷ আর পাকিস্তানি সরকারকে আরেকটি বিষয় চাপে রাখবে৷ সেটা হলো, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সরকারগুলি, অন্তত পশ্চিমের দেশগুলি, এই বিষয়ে চিন্তিত যে ইসলামাবাদ এর সমাধান করতে চায় না বা করতে পারছে না৷''
এম রাজা, ইসলামাবাদ/এসএস