শীঘ্রই হিন্দুরা তাদের বিবাহ কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ সরকারিভাবে নথিভুক্ত করতে পারবেন৷ কিন্তু এই বিল আনতে এত সময় লাগল কেন আর এর তাৎপর্যই বা কী?
বিজ্ঞাপন
পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পর সাত দশক কেটে গেছে, কিন্তু এ'যাবৎ বিবাহিত হিন্দু দম্পতিদের সরকারিভাবে প্রমাণ করার কোনো উপায় ছিল না যে, তারা সত্যিই বিবাহিত৷ ফলে সরকারি ভাতা পেতে অসুবিধা হত; বিধবারা স্বামীর সম্পত্তি দাবি করতে পারতেন না; বিবাহিত হিন্দু মহিলাদের ধরে নিয়ে গিয়ে জোর করে বিয়ে দিলেও বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া হত না৷
দৃশ্যত হিন্দু বিবাহ আইন এবার জোর পেয়েছে এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রাদেশিক বিধানসভায় আলোচিত হচ্ছে৷ গত ৮ই ফেব্রুয়ারি সিন্ধ প্রদেশে বিলটি পাস হয় - এক্ষেত্রে সিন্ধই পথিকৃৎ৷ পাকিস্তানের ১৭ কোটির বেশি জনগণের মধ্যে হিন্দুরা মাত্র আড়াই শতাংশ; এই আড়াই শতাংশের নব্বই ভাগ বাস করেন আবার সিন্ধ প্রদেশে৷
এতদিন লাগল কেন?
পাকিস্তানের ‘দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন' পত্রিকার মতে, ত্রিশ লাখ নাগরিকের জন্য বিবাহ আইন প্রণয়ন করতে এত সময় লাগল কেন, তা একটা রহস্য৷ কোনো কোনো পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞ এজন্য ‘‘আলস্য ও অবহেলা''-কে দায়ী করেছেন৷ স্বাধীনতা যাবৎ ভারত ও পাকিস্তানে বিবাহ আইন ধর্ম অনুযায়ী ভাগ করা ছিল৷ ১৯৪৭ সালের পর ভারত হিন্দুদের বিবাহ আইনের সংস্কার করে, পাকিস্তান মুসলিমদের বিবাহ আইনের প্রতি নজর দেয়৷ খ্রিষ্টানদের বিবাহ আইনের ব্যাপারে ব্রিটিশদের সঙ্গে আগে থেকেই চুক্তি করা ছিল৷ পাকিস্তানের হ্রাস পাওয়া হিন্দু সংখ্যালঘুদের নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামানো হয়নি৷ ভারত যেমন মুসলিম বিবাহ আইনের কোনো রদবদল করেনি, তেমন পাকিস্তানের হিন্দুরাও তাদের নিজস্ব বিবাহ আইনের জন্য বিশেষ সোচ্চার হননি - হয়ত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে৷
দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্য বিবাহের হিড়িক
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি মেয়েদের বিয়ের বয়স কমিয়ে ১৬ না করার আবেদন জানিয়েছে৷ দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্য বিবাহের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি, এবং সেই তালিকার শীর্ষে বাংলাদেশ৷
ছবি: Getty Images/AFP
বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স
গত ৯ই জুন প্রকাশিত একটি রিপোর্টে এইচআরডাব্লিউ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি বাল্য বিবাহের এই নতুন ‘মহামারীর’ মোকাবিলা করার আহ্বান জানিয়েছে৷ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনটি বাংলাদেশে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করার বিরোধী৷
ছবি: Getty Images/AFP/Str
পনেরো বছর হবার আগেই
বাংলাদেশের ৩০ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়, বলছে ‘বাড়ি বন্যার জলে ভেসে যাওয়ার আগেই বিয়ে করে ফেলো’, এই শীর্ষকের একটি রিপোর্ট৷ এইচআরডাব্লিউ সংগঠনের রিপোর্টটি বাংলাদেশে শত শত বালিকা বধূর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে৷ বাংলাদেশে বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধ, কিন্তু কর্মকর্তাদের ঘুস দিয়ে সহজেই ভুয়ো বার্থ সার্টিফিকেট বার করে নেওয়া যায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/Str
একটি কারণ: দারিদ্র্য
ঘন ঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাংলাদেশের বহু মানুষকে চরম দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দিয়েছে৷ ফলে বাল্য বিবাহের সংখ্যা বেড়েছে, কেননা দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ পরিবারে কন্যাসন্তান একটি দায় বা বোঝা৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতবছর প্রতিশ্রুতি দেন যে, ১৫ বছরের নীচে মেয়েদের বিয়ে নিষিদ্ধ করা হবে৷ কিন্তু সরকার সে প্রতিশ্রুতি পালনের জন্য বিশেষ কিছু করেননি, বলে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলির অভিযোগ৷
ছবি: Getty Images/AFP/Str
দাম্পত্য জীবনে মারধোর ও ধর্ষণ
বিভিন্ন জরিপ থেকে দেখা গেছে, মেয়েদের পড়াশুনা করতে না দিলে তারা দারিদ্র্যের শৃঙ্খলেই আবদ্ধ থাকে, পরনির্ভর হয়ে থাকে, এমনকি তাদের স্বাস্থ্যেরও হানি ঘটতে পারে৷ বালিকা বধূদের জন্য আরো রয়েছে পতির হাতে মারধোর, এমনকি ধর্ষণ৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/M. Asad
গোটা দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যা
সমস্যাটা যে শুধু বাংলাদেশের, এমন নয়৷ জোর করে কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রথা দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে পাওয়া যাবে – খানিকটা সেখানকার বিভিন্ন দেশের ধর্ম ও সংস্কৃতির কারণে৷ জাতিসংঘের উদ্বাস্তু ত্রাণ সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী আগামী দশ বছরে ১৪ কোটির বেশি মেয়ের ১৮ বছর হবার আগেই বিয়ে হয়ে যাবে৷ তাদের অর্ধেকই হবে দক্ষিণ এশিয়ার মেয়ে৷
ছবি: DW/P.M.Tewari
সংস্কার বনাম সরকার
ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল কিংবা শ্রীলঙ্কায় বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধ, কিন্তু তা সত্ত্বেও সামাজিক প্রথাটি ভালোভাবেই বেঁচে রয়েছে৷ জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের পরিসংখ্যানে দেখা যায়: ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রায় আড়াই কোটি মহিলা, যাদের বয়স ২০ থেকে ২৪-এর মধ্যে, তাদের সকলেরই কিন্তু বিয়ে হয়েছিল ১৮বছর বয়স হবার আগে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/P. Hatvalne
মনোভাব বদলাতে হবে
ইউনিসেফ-এর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক আঞ্চলিক উপ-পরিচালক স্টিফেন অ্যাডকিনসন ডয়চে ভেলেকে বলেন যে, বাল্য বিবাহ, আঁতুড়ে মায়ের মৃত্যু, মেয়ে হলে গর্ভপাত ইত্যাদি বিষয়ে মানুষজনের মনোভাব বদলানোর জন্য সর্বাগ্রে সংলাপ চালু করতে হবে, পৌঁছাতে হবে এই ‘মাইন্ডসেট’ বা কুসংস্কারের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা রাজনৈতিক মূলে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
7 ছবি1 | 7
সুবিধা-অসুবিধা
তবে বিবাহ আইন তো শুধু লোক-দেখানোর জন্য নয় - তার থাকা, না থাকার নানা সুবিধা-অসুবিধা আছে৷ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা শক্ত হয়ে পড়ে; বিদেশে যাবার জন্য ভিসা পেতে অসুবিধা হয়৷ এবার যখন হিন্দু বিবাহ আইন প্রণয়নের তাগাদা এলো, তখন পাকিস্তান সরকারও গণতন্ত্রীকরণের দিকে এগোচ্ছেন ও বহির্বিশ্বে পাকিস্তানের ভাবমূর্তির উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করছেন৷
মজার কথা, হিন্দু বিবাহ আইন প্রণীত হলেই যে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের মধ্যে হিন্দু বিদ্বেষ কমে যাবে, এমন নয়৷ বলতে কি, পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের মাথার উপর যে খাঁড়াটি ঝুলছে, সেটি হল ঈশ্বরনিন্দা আইন৷ এমনকি শরিয়া আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে নতুন হিন্দু বিবাহ আইনেও একটি সূত্র রাখা হয়েছে যে, স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে কেউ পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে, তাদের আদত হিন্দু বিবাহ নাকচ হয়ে যাবে৷ পাকিস্তান হিন্দু পরিষদ সূত্রটির অপসারণ দাবি করেছে৷