‘দাগি' বলতে বোঝায়, যে সব অভিবাসীদের ‘ক্রিমিনাল রেকর্ড' আছে৷ চলতি উদ্বাস্তু সংকটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) পাকিস্তানের মতো দেশ থেকে আগত রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের ফেরত পাঠাতে চায়৷ কিন্তু কাদের?
বিজ্ঞাপন
২০১০ সালের একটি চুক্তি অনুযায়ী, ইইউ দেশগুলি পাকিস্তানি নাগরিকদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে পারে৷ পাকিস্তান এই চুক্তি আপাতত স্থগিত রেখেছে এই বলে যে, চুক্তির ‘‘ব্যাপক অপব্যবহার'' করা হচ্ছে৷
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধরি নিসার আলী খান গত সপ্তাহে বলেন, ইউরোপীয় দেশগুলি প্রায়শই পাকিস্তানি নাগরিকদের ফেরত পাঠায় তাদের ‘সন্ত্রাসবাদী' বলে অভিহিত করে৷ তিনি বলেন, ‘‘পাকিস্তানিরা কোনো পশ্চিমি দেশে বেআইনিভাবে গেলে বিধিমতো পরীক্ষার পর তাদের ফেরত পাঠানো উচিত, অধিকাংশ দেশ যা করে না৷''
প্রতিবছর হাজার হাজার পাকিস্তানি স্থলপথে বা সাগর পার হয়ে, ইরান, তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্য দিয়ে ইউরোপে যাবার চেষ্টা করে৷ তাঁদের মধ্যে অনেকে যেমন সন্ত্রাসবাদ, সাম্প্রদায়িক সংঘাত বা ধর্মীয় অহিষ্ণুতার হাত থেকে পালাচ্ছেন, তেমনই অনেকের লক্ষ্য শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নতি৷
অভিবাসীর স্রোত
২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রায় ৩২ হাজার পাকিস্তানি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন, বলে জানিয়েছে ‘ইউরোস্ট্যাট', ইইউ-এর পরিসংখ্যান দপ্তর৷ এর মধ্যে হাঙ্গেরিতে জমা পড়েছে প্রায় ১৩ হাজার আবেদন, জার্মানিতে পাঁচ হাজার ও ইটালিতে চার হাজার৷ ঠিক তেমনই ছ'হাজারের বেশি পাকিস্তানি ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও গ্রিসে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন বলে জানা গেছে৷
সবচেয়ে কম শরণার্থী নেবে মাল্টা, সবচেয়ে বেশি জার্মানি
১ লাখ ২০ হাজার শরণার্থী নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল৷ তা কেটে গেছে৷ ভোটাভুটির মাধ্যমে ঠিক হয়েছে এই ১ লাখ ২০ হাজার শরণার্থীকে ভাগ করে নেবে ইইউ-র দেশগুলো৷ এ পর্যায়েও সবচেয়ে বেশি শরণার্থী নেবে জার্মানি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. Zak
জার্মানির স্বস্তি
অনেক শরণার্থী এসেছে জার্মানিতে৷ অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশির ভাগ দেশ শরণার্থী নিতে নারাজ৷ এ অবস্থায় ইইউ-র সব সদস্য দেশকে কোটা অনুযায়ী শরণার্থী নিতে হবে – এমন দাবি জানিয়েছিল জার্মানি৷ মঙ্গলবারের বৈঠকে দাবি পূরণ হয়েছে৷ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সিদ্ধান্ত হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার শরণার্থীকে ভাগ করে দেয়া হবে৷ জার্মানি নেবে ৩১ হাজার ৪৪৩ জন৷ বছর শেষে জার্মানিতে আগত মোট শরণার্থী ৮ লাখে হয়ে যেতে পারে৷
ছবি: Reuters/O. Orsal
জার্মানির পরই ফ্রান্স
কোটা অনুযায়ী শরণার্থী বণ্টনের দাবিতে ফ্রান্সও ছিল জার্মানির সঙ্গে৷ মঙ্গলবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শরণার্থীর চাপটা তাদের ওপরও খুব কম পড়বে না৷ এই দফায় ২৪ হাজার ৩১ জন শরণার্থী নেবে ফ্রান্স৷ছবিতে হাঙ্গেরি সীমান্তের এক শরণার্থী শিশু৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Nimani
চারটি দেশের ঘোর আপত্তি
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো শুরু থেকেই শরণার্থী নেয়ার বিপক্ষে৷ মঙ্গলবার হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভাকিয়া শরণার্থী নেয়ার বিপক্ষে ভোট দেয়৷ ভোটের পর চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী বহুস্লাভ সবটকা বলেন, ‘‘এটা খুবই খারাপ সিদ্ধান্ত৷’’ সরাসরি আপত্তি জানালেও এখন রোমানিয়া ৪ হাজার ৬৪৬ জন, চেক প্রজাতন্ত্র ২ হাজার ৯৭৮ জন এবং স্লোভাকিয়া ১ হাজার ৫০২ জন শরণার্থী নেবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Dospiva
দায়িত্ব মনে করে শরণার্থী নেবে লুক্সেমবুর্গ
৫ লক্ষ ৬২ হাজার জনসংখ্যার দেশ লুক্সেমবুর্গও শরণার্থী নেবে৷ ছোট দেশ তাই মাত্র ৪৪০ জন নেবে তারা৷ তবে দেশটির সরকার মনে করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্য ধরে রাখতে সব সদস্য দেশের শরণার্থী নেয়াটা এখন কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে৷ এমনিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ছোট দেশটির এখন বড় ভূমিকা পালন করাই স্বাভাবিক, কেননা, এ মুহূর্তে ইইউর সভাপতি দেশও লুক্সেমবুর্গ৷
ছবি: AP
সবচেয়ে কম শরণার্থী নেবে মাল্টা
ইইউ অঞ্চলের আরেক ছোট দেশ মাল্টা৷ আয়তন মাত্র ৩১৬ বর্গ কিলোমিটার আর জনসংখ্যা ৪৪ হাজারের একটু বেশি৷ এমন ছোট দেশটিও ১৩৩ জন শরণার্থী নেবে৷
ছবি: picture alliance /Robert Harding
আর যেসব দেশ শরণার্থী নেবে
ইইউ-র আরো কয়েকটি দেশও শরণার্থী নেবে৷ স্পেন নেবে ১৪ হাজার ৯৩১ জন, পোল্যান্ড ৯ হাজার ২৮৭ জন, নেদারল্যান্ডস ৭ হাজার ২১৪ জন, বেলজিয়াম ৪ হাজার ৫৬৪ জন, সুইডেন ৪ হাজার ৪৬৮ জন, অস্ট্রিয়া ৩ হাজার ৬৪০ জন, পর্তুগাল ৩ হাজার ৭৪ জন, ফিনল্যান্ড ২ হাজার ৩৮৮ জন, বুলগেরিয়া ১৬০০ জন, ক্রোয়েশিয়া ১ হাজার ৬৪ জন, লিথুয়ানিয়া ৭৮০ জন, স্লোভেনিয়া ৬৩১ জন, লাটভিয়া ৫২৬ জন, এস্তোনিয়া ৩৭৩ এবং সাইপ্রাস নেবে ২৭৪ জন শরণার্থী৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. Zak
6 ছবি1 | 6
পাকিস্তানি রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পুরুষ, যাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে৷ তবে ব্যাপারটা কিছু নতুন নয়৷ ‘ইউরোস্ট্যাট'-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৪ হাজার পাকিস্তানি বেআইনিভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে এসেছেন৷ সব মিলিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন জমা পড়েছে ৬৮ হাজারের বেশি, কিন্তু তাদের ৮২ শতাংশ খারিজ হয়েছে৷ আবেদন খারিজ হলে ব্যর্থ আবেদনকারীদের একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশে ফেরার কথা৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৪০ শতাংশ বস্তুত দেশে ফিরেছেন৷
মানুষ পাচার
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ পাকিস্তান থেকে ইউরোপ অভিমুখে মানুষ পাচারের বিরুদ্ধে যথাসাধ্য করার চেষ্টা করছেন, তবে আন্তর্জাতিক মানুষ পাচার চক্রগুলিকে বিরত করার জন্য তা পর্যাপ্ত কিনা, সে-বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ আছে৷ পাকিস্তানের ফেডারাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি-র পরিচালক ইনাম গনি ডিডাব্লিউ-কে বলেন যে, ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ১,১৮৫ জন মানুষ পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে – ২০১৫ সালে এ যাবৎ গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় ৮০০ জনকে৷ এমনকি সরকার এই কাজে বিভিন্ন নিরাপত্তা বিভাগ মিলিয়ে একটি বিশেষ ‘টাস্ক ফোর্স' সৃষ্টি করেছেন, বলে ঘানি জানান৷ কিন্তু তাঁর মত হলো যে, ইউরোপের তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়প্রদানের পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করা উচিত৷
‘‘অতীতে ইউরোপে শুধু রাজনৈতিক আশ্রয় নয়, আবাস ও আর্থিক সাহায্য পাওয়াও অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল৷ বেআইনি অভিবাসীদের কোনো ধরনের সুযোগসুবিধা বা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার সুযোগ না দিয়ে, তাদের অবিলম্বে বহিষ্কার করা উচিত, বলে আমি মনে করি'', বলেন ইনাম গনি৷
হাঙ্গেরি সার্বিয়ার সঙ্গে তার সীমান্ত বন্ধ করে দেবার পর তথাকথিত বলকান রুটে উদ্বাস্তুর স্রোত ক্রোয়েশিয়ার দিকে যেতে শুরু করেছে৷ অস্ট্রিয়াও এবার হাঙ্গেরি সীমান্তে বাছাই নিয়ন্ত্রণ চালু করেছে৷
দীর্ঘ পথ
তুরস্কের এডির্নে শহরের কাছে সিরীয় উদ্বাস্তুরা ছোটদের কোলে করে পায়ে হেঁটে চলেছেন গ্রিক সীমান্তের দিকে৷
ছবি: Reuters/O. Orsal
সব বাধা পার হয়ে
গ্রিস আর ম্যাসিডোনিয়ার সীমান্তে গেভগেলিয়া শহরে তারের বেড়ার ধারে এক অভিবাসী শিশু৷ শুধুমাত্র ১৪ই সেপ্টেম্বরের রাত্রেই সাড়ে সাত হাজারের বেশি উদ্বাস্তু ম্যাসিডোনিয়ায় ঢোকেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Atanasovski
প্রবেশ নিষেধ
১৫ই সেপ্টেম্বর থেকে সার্বিয়ার সঙ্গে হাঙ্গেরির সীমান্ত চার মিটার উঁচু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঢাকা৷ শত শত উদ্বাস্তু সীমান্ত কেন্দ্রে নাম লেখাতে পারেন বটে, আবার ক্ষেত্রবিশেষে বহিষ্কৃতও হতে পারেন৷ বেআইনিভাবে সীমান্ত পার হওয়ার সাজা তিন বছর অবধি কারাদণ্ড, কাঁটাতারের বেড়ার ক্ষতি করলে পাঁচ বছর৷
ছবি: DW/N. Rujević
সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ জোরদার হচ্ছে
অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরির মধ্যে সীমান্তে অস্ট্রিয়ান তরফে হাইলিগেনক্রয়েৎস শহর৷ মঙ্গলবার রাত্রি থেকেই বাছাইভাবে সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ চালু করার কথা ঘোষণা করে ভিয়েনা সরকার৷ স্লোভেনিয়া, ইটালি এবং স্লোভাকিয়ার সঙ্গে সীমান্তেও নাকি অনুরূপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হতে পারে, বলে জানিয়েছে অস্ট্রিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷
ছবি: dpa
রেলস্টেশনে ভিড়
অস্ট্রিয়ার সালৎসবুর্গ শহরের মুখ্য রেলওয়ে স্টেশনে উদ্বাস্তুরা অপেক্ষা করছেন জার্মানিগামী ট্রেনের৷ রবিবার জার্মানি সাময়িকভাবে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয় মিউনিখ রেলওয়ে স্টেশন – এবং শহরের উপর উদ্বাস্তু সমাগমের চাপ কমানোর আশায়৷ অবশ্য সোমবার সকালেই তা আবার তুলে নেওয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Gindl
মিউনিখে আরেক যাত্রার শুরু
মিউনিখ শহরের প্রধান রেলওয়ে স্টেশনে পথের খোঁজ দিচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তা৷ ট্রেনের জানলার কাচে যে শিশুমুখ, সে-ই তো ভবিষ্যৎ...
ছবি: DW/M. Gopalakrishnan
বলকান রুট
উদ্বাস্তুর স্রোত এবার ক্রোয়েশিয়া হয়ে উত্তরে যাবার চেষ্টা করবে৷ তাদের গন্তব্য: জার্মানি, নেদারল্যান্ডস কিংবা সুইডেনের মতো কোনো সমৃদ্ধ, স্বাগতিক দেশ৷
7 ছবি1 | 7
পাকিস্তানের জায়গায় বাংলাদেস হলে কী করতো? ফেরত নিত ‘দাগি' অভিবাসীদের? জানান নীচের ঘরে৷