কাশ্মীর নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকা কাশ্মীর সফরে গিয়েছেন৷ দেশটির স্বাধীনতা দিবসে এই সফর পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী দেশ দুটোর মধ্যে উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দিতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ আগস্ট, ভারতের ১৫ আগস্ট৷ কাশ্মীর সংকটকে কেন্দ্র করে রাজনীতি চলছে ভারত-পাকিস্তান দুই দেশেই৷ ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে ফায়দা নিতে ঠিক সময়টিকেই বেছে নিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান৷ ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা বাতিল' ঘোষণার এক সপ্তাহ পর ঠিক স্বাধীনতা দিবসটিকেই বেছে নিলেন পাকিস্তান অংশ সফরের জন্য৷
পাকিস্তান এরই মধ্যে ইস্যুটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ করছে৷ রাষ্ট্রদূত বহিষ্কার, রেল ও বাস যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া, ভারতীয় সিনেমা প্রচার বন্ধ করা, চীনের সহায়তা কামনা, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানানো, এমন নানা পদক্ষেপ এসেছে পাকিস্তানের দিক থেকে৷
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বলছে, ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জনগণের সঙ্গে সংহতি জানাতেই ইমরান খান পাকিস্তান অংশে স্বাধীনতা দিবস পালন করছেন৷ সকালে দেয়া এক বিবৃতিতে ইমরান ৫ আগস্ট ভারতের নেয়া সিদ্ধান্তের আবারও কড়া সমালোচনা করেছেন৷ আইনসভায় এ নিয়ে তার একটি বক্তব্য দেয়ারও কথা রয়েছে৷
কাশ্মীরে বহুদিনের সংঘাত, বহুদিনের ক্ষত
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে যেন গলার ফাঁস হয়ে রয়েছে কাশ্মীর৷ তাই কাশ্মীর সংক্রান্ত ঘটনাবলী আজ নিজেরাই ইতিহাস৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Bhat
১৯৪৭
বলা হয় দেশবিভাগের পর পাকিস্তান থেকে আগত উপজাতিক যোদ্ধারা কাশ্মীর আক্রমণ করে৷ তখন কাশ্মীরের মহারাজা ভারতের সাথে সংযোজনের চুক্তি করেন, যা থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়৷
ছবি: dapd
১৯৪৮
ভারত জাতিসংঘে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে পর, ৪৭ ক্রমিক সংখ্যক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়৷ ঐ প্রস্তাব অনুযায়ী গোটা কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে৷
ছবি: Keystone/Getty Images
১৯৪৮
কিন্তু পাকিস্তান প্রস্তাব অনুযায়ী, কাশ্মীর থেকে সৈন্যাপসারণ করতে অস্বীকার করে৷ অতঃপর কাশ্মীরকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়৷
ছবি: Getty Images
১৯৫১
ভারতীয় কাশ্মীরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে সমর্থন করা হয়৷ অতঃপর ভারত বলে, আর গণভোট অনুষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন নেই৷ জাতিসংঘ ও পাকিস্তানের মতে, গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৫৩
কাশ্মীরের ‘প্রধানমন্ত্রী’ শেখ আব্দুল্লাহ গণভোটের সমর্থক ছিলেন ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেন৷ ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ জম্মু-কাশ্মীরের নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযোজনকে পাকা করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৬২-৬৩
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন আকসাই দখল করে৷ তার আগের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স কারাকোরাম ট্র্যাক্ট এলাকাটি চীনকে প্রদান করে৷
ছবি: Getty Images
১৯৬৫
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়৷ কিন্তু যুদ্ধশেষে উভয় দেশের সেনা তাদের পুরোনো অবস্থানে ফিরে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Singh
১৯৭১-৭২
আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ৷ যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালে৷ যুদ্ধবিরতি রেখাকে লাইন অফ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিণত করা হয় ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ সমাধান সম্পর্কে ঐকমত্য অর্জিত হয়৷
ছবি: AP
১৯৮৪
ভারত সিয়াচেন হিমবাহ নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার পর পাকিস্তান তা একাধিকবার দখল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হতে পারেনি৷
ছবি: AP
১৯৮৭
জম্মু-কাশ্মীরে বিতর্কিত নির্বাচনের পর রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়৷ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থাকে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ করে, কিন্তু পাকিস্তান সে দোষারোপ চিরকাল অস্বীকার করে এসেছে৷
ছবি: AP
১৯৯০
গওকাদল সেতুর কাছে ভারতীয় সিআরপি রক্ষীবাহিনী কাশ্মীরি বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালালে পর শতাধিক আন্দোলনকারী নিহত হন৷ প্রায় সমস্ত হিন্দু কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে চলে যান৷ জম্মু-কাশ্মীরে সেনাবাহিনীকে আফসা বা আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images/Tauseef Mustafa
১৯৯৯
কাশ্মীর ভ্যালিতে গোটা নব্বই-এর দশক ধরে অশান্তি চলে৷ ১৯৯৯ সালে আবার ভারত-পাকিস্তানের লড়াই হয়, এবার কারগিলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০০১-২০০৮
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলাপ-আলোচনার যাবতীয় প্রচেষ্টা প্রথমে নতুন দিল্লির সংসদ ভবন ও পরে মুম্বই হামলার ফলে ব্যর্থ হয়৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/F. Khan
২০১০
ভারতীয় সেনার গুলি লেগে এক বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর পর কাশ্মীর ভ্যালি উত্তেজনায় ফেটে পড়ে৷ বিক্ষোভ চলে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে, প্রাণ হারান অন্তত ১০০ জন৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/U. Asif
২০১৩
সংসদ ভবনের উপর হামলার মুখ্য অপরাধী আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়া হয়৷ এর পর যে বিক্ষোভ চলে, তা-তে দু’জন প্রাণ হারায়৷ এই বছরই ভারত আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় মিলিত হয়ে উত্তেজনা উপশমের কথা বলেন৷
ছবি: Reuters
২০১৪
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ উপস্থিত থাকেন৷ কিন্তু এর পর নতুন দিল্লিতে পাকিস্তানি হাই কমিশনার কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ায় ভারত আলাপ-আলোচনা স্থগিত রাখে৷
ছবি: Reuters
২০১৬
আজাদ কাশ্মীর ভিত্তিক হিজবুল মুজাহিদীন-এর অধিনায়ক বুরহান ওয়ানি-র মৃত্যুর পর কাশ্মীরে স্বাধীনতা সমর্থকরা আবার পথে নেমেছেন৷ এই আন্দোলনে এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে ও বিক্ষোভ অব্যাহত আছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R.S.Hussain
২০১৯
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামা সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ)-এর গাড়িবহরে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে৷ এতে ৪২ জওয়ান নিহত হন৷ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জৈশ-ই-মোহাম্মদ হামলার দায় স্বীকার করেছে৷ এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায় ভারতীয় বিমান বাহিনী৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/P. Kumar Verma
২০১৯
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মীরের কাছে কিছু বিশেষ অধিকার ছিল। ৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৩৭০ ধারাটি অবসানের দাবি তোলেন৷ বিল পাস হয়। একই দিনে তাতে সই করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷ ফলে, কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা' বাতিল হয়। তাছাড়া মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা হারায়। জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখ নামে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠিত হয়।
ছবি: Reuters
19 ছবি1 | 19
রাহুল-মালিক বাগযুদ্ধ
কাশ্মীর ইস্যুতে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ও ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের গভর্নর সত্য পাল মালিকের মধ্যে কয়েকদিন ধরেই বাগযুদ্ধ চলছে৷ কাশ্মীরে ‘সহিংস আন্দোলন চলছে', রাহুলের এমন মন্তব্যের পর মালিক তাকে কাশ্মীর সফরের আমন্ত্রণ জানান৷ এমনকি প্রয়োজনে বিমান পাঠানোর প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তিনি৷
জবাবে রাহুল এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বিরোধী নেতাদের একটি দল নিয়ে কাশ্মীর যাওয়ার ঘোষণা দেন৷ এক টুইটে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের বিমান লাগবে না৷ কিন্তু দয়া করে আমাদের চলাফেরা ও সাধারণ মানুষ, মূলধারার রাজনৈতিক নেতা ও সেখানে অবস্থানরত সেনাদের সঙ্গে কথা বলার স্বাধীনতা দেবেন৷''
কিন্তু এবার গভর্নর মালিকের অন্য সুর৷ বিরোধী নেতাদের দল নিয়ে হেফাজতে থাকা নেতাদের সঙ্গে দেখা করে রাহুল কার্যত ‘অস্থিরতা' সৃষ্টি করতে চাইছেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি৷
সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও ওমর আবদুল্লাহসহ অনেক কাশ্মীরি নেতাই এখন আটক রয়েছেন৷
গভর্নর এত ‘পূর্বশর্ত' দিয়ে তাকে আমন্ত্রণ জানাননি এবং রাহুলের অনুরোধ বিবেচনার জন্য ‘স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে' বলেও জানানো হয় বিবৃতিতে৷
তবে রাহুলও চুপ থাকেননি৷ মালিকের বিবৃতিকে ‘দুর্বল মন্তব্য' আখ্যা দিয়ে তিনি আবার টুইট করেন৷ এবার তিনি বলেন, ‘‘আপনার কাশ্মীর সফর ও জনগণের সঙ্গে কথা বলার আমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করলাম, কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই৷ আমি কবে আসতে পারি?''
তবে মালিকের তরফ থেকে রাহুলের সবশেষ টুইটের এখনও কোনো প্রতিউত্তর আসেনি৷
পরিস্থিতি পুরোপুরি ‘নিয়ন্ত্রণে' বলে জানিয়েছে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ৷ ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, নিরাপত্তাও শিথিল করা হবে বলে জানিয়েছে তারা৷ পরিস্থিতি বিবেচনা করে আটক রাজনৈতিক নেতাদেরও মুক্তি দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে৷