পাকিস্তান মহারণে ভারতের রোমাঞ্চকর জয়
৯ জুন ২০২৪![টি ২০ ম্যাচে পাকিস্তানকে হারানোর পর ভারতীয় ক্রিকেটারদের উচ্ছ্বাস](https://static.dw.com/image/69317548_800.webp)
১৪ রানে ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা যশপ্রীত বুমরাহ।
বিশ্বকাপের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ম্যাচ। উত্তেজনার বারুদে ঠাসা সেই ম্যাচের আগে পাকিস্তান রীতিমতো কোণঠাসা বাঘ। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হারের পর সমালোচনায় জর্জরিত এক দল। তবে পাকিস্তানকে ভালোভাবে চেনায় ভারতীয় কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কার নিজের কলামে লিখেছিলেন, ‘‘নিউ ইয়র্কের পিচের চেয়েও বেশি আনপ্রেডিক্টেবল পাকিস্তান''।
সেই আনপ্রেডিক্টেবল পাকিস্তান নিজের মতো করেই ধরাশায়ী হল ভারতের কাছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ডালাস বিপর্যয় কাটিয়ে নিউইয়র্কে আলো ঝলমলে পারফরম্যান্স করেছিলেন বোলাররা। পাকিস্তানের চার পেসারের গতি, সুইং আর স্লোয়ারে দিশেহারা রোহিত শর্মার দল অলআউট হয়েছিল ১১৯ রানে।
১২০ রানের লক্ষ্যে পাকিস্তানের তাড়াহুড়োর দলকার ছিল না। তাই বলে কচ্ছপগতিতে রান করলেও চলত না। অতি সাবধানী ব্যাটিং ও নিউ ইয়র্কের ধীরগতির পিচেই ডুবেছে বাবর আজমের দল। আশা জাগিয়েও ৭ উইকেটে ১১৩ রান পর্যন্তই পৌঁছাতে পারে তারা। তাই বিশ্বকাপে ৮ বারের দেখায় ভারতের দাপট বেড়ে দাঁড়াল ৭-১। আর পাকিস্তান চলে গেল সুপার এইট থেকে বাদ পড়ার কিনারায়।
ভারতের ব্যাটিংয়ের গল্পটা অন্যরকমও হতে পারতো। প্রথম ১০ ওভারে ৩ উইকেটে ৮১ করে বড় স্কোরের ভিত পেয়ে গিয়েছিল ভারত। টিকে থাকতে মরিয়া পাকিস্তান আহত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তখনই। ৯ ওভারে মাত্র ৩৮ রানে শেষ ৭ উইকেট নেয় তারা। ৪ উইকেটে ৯৫ থেকে এক রানের ব্যবধানে ৯৬ রানে ৭ উইকেটে পরিণত হয় তারা! মহাধসে শেষ ৬ উইকেট হারিয়ে বসে ২৪ রানে। নাসিম শাহ ও হারিস রউফ নেন ৩টি করে উইকেট। মোহাম্মদ আমির দুই ও শাহিন শাহ আফ্রিদির শিকার এক উইকেট।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এবারই প্রথম ভারতকে অল-আউট করল পাকিস্তান। আর বিশ্বকাপে এটা ভারতের চতুর্থ সর্বনিম্ন স্কোর। ২০১৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৭৯ রানে গুটিয়ে যাওয়াটা তাদের সর্বনিম্ন। এজন্য সম্প্রচারকারী চ্যানেল স্টার স্পোর্টসে ভারতীয় ব্যাটারদের একহাত নিলেন সুনীল গাভাস্কার, ‘‘ভারতীয় ব্যাটিংকে অহংকারী ও বেপরোয়া মনে হয়েছে আমার। ওরা প্রতিটা বলে হিট করতে চাইছিল। মনে করছিল এটা আয়ারল্যান্ডের বোলিং। আইরিশদের আমি অসম্মান করছি না তবে পাকিস্তানের বোলিং ভীষণ, ভীষণ অভিজ্ঞ।''
বৃষ্টিতে টস আর ম্যাচ শুরু হতে দেরি হয়েছে অনেকটা। এই বিরতিতে মাঠে তৈরি হয়েছিল মোহনীয় পরিবেশ। ক্রিস গেইল তিন রঙের স্যুট পড়ে নামেন মাঠে, সেখানে অটোগ্রাফ নেন ভারতীয় সব ক্রিকেটারের। বিশ্বকাপের আরও দুই শুভেচ্ছাদূত শহিদ আফ্রিদি ও যুবরাজ সিং আসেন এক সঙ্গে। আফ্রিদি তার জামাই শাহিনের সঙ্গে সময় কাটিয়ে টিপসও দেন কিছু। কিংবদন্তি শচীন তেণ্ডুলকরের সঙ্গে ভাল সময় কাটিয়েছেন যুবরাজও।
প্রথম ওভারটা করেছিলেন শাহিন শাহ আফ্রিদি। তৃতীয় বলেই ফ্লিক করে নিজের ট্রেডমার্ক শটে রোহিত ছক্কা মারেন ডিপ স্কয়ার লেগের উপর দিয়ে। ষষ্ঠ বলে ফ্লিক করতে গিয়েছিলেন আবারও, কিন্তু বল লাগে প্যাডে। পাকিস্তান এলবির জোড়ালো আবেদন করলেও বল লেগ সাইডে পিচ করায় রিভিউ নেয়নি।
এরপরই নামে বেরসিক বৃষ্টি। প্রথম ওভারে ৮ রান হওয়ার পরই মাঠ ছাড়েন দুই দলের ক্রিকেটাররা। খেলার বিরতিতে বেজে উঠে লাহোরভিত্তিক জুনুন ব্যান্ডের ‘সাইয়োনি' গান। বিভেদ ভুলে দুই দলের সমর্থকরা সমস্বরে গেয়ে উঠলেন ‘সাইয়োনিইইইই, সাইয়োনিইইইই'! গান এভাবেই বুঝি ভুলিয়ে দেয় দূরত্ব!
এরই মাঝে ছোট্ট একটা বিমান ব্যানার নিয়ে উড়ে যায় মাঠের উপর দিয়ে। সেখানে লেখা ছিলো, ‘রিলিজ ইমরান খান'। সঙ্গীত, রাজনীতি সবকিছু মিলেমিশে গিয়েছে এই ম্যাচে।
বৃষ্টির পর খেলা শুরু হলে টানা দুই ওভারে বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মাকে হারায় ভারত। অফস্টাম্পের বেশ বাইরে পরা নাসিম শাহর বলটা নির্বিষই ছিল। কিন্তু চার রান করা কোহলি কভার পয়েন্টের ওপর দিয়ে তুলে মারতে গিয়ে ক্যাচ দেন উসমান খানকে। টানা দুই ম্যাচেই ওপেনার হিসেবে নেমে ব্যর্থ হলেন কোহলি।
আফ্রিদির করা পরের ওভারে ফ্লিকে ছক্কা মারতে গিয়ে স্কয়ার লেগে হারিস রউফকে ক্যাচ দেন রোহিত শর্মা (১৩ রান)। বাঁহাতি পেসারদের বিপক্ষে নিজের দুর্বলতা আরও একবার দেখালেন তিনি। এ নিয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১১ টি-টোয়েন্টি ইনিংসে ১৪.১১ গড় ও ১১৭.৫৯ স্ট্রাইক রেটে ১২৭ রান করলেন রোহিত।
দুই সেরা ব্যাটার হারালেও অক্ষর প্যাটেল ও ঋষভ পন্থ সচল রাখেন রানের চাকা। পাওয়ার প্লে-তে দুই উইকেটে ৫০ করে ভারত, ওভার প্রতি রান রেট ৮.৩৩। পাকিস্তানি ফিল্ডাররা অবশ্য নিতে পারেননি দুটি কঠিন ক্যাচ।
অষ্টম ওভারে নাসিম শাহর বলে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে খেলতে গিয়ে বোল্ড হন অক্ষর প্যাটেল। ১৮ বলে দুইটি বাউন্ডারি একটি ছক্কায় ২০ রান করেছিলেন এই অলরাউন্ডার।
ম্যাচের আগে পাকিস্তানি সাবেক তারকা কামরান আকমল সূর্যকুমার যাদবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছিলেন, ‘‘তুমি এক নম্বর ব্যাটার হলে পাকিস্তানের সঙ্গে রান করে দেখাও।'' সেই চ্যালেঞ্জ জিততে না পেরে সূর্যকুমার আউট হন আউট হন সাত রানে।
এরপর থেকে ভারত উইকেট হারাতে থাকে নিয়মিত বিরতিতে। শেষ ৭ ব্যাটারের কেউই দুই অঙ্কের রানই পাননি! পাকিস্তানি পেসারদের দুর্দান্ত বোলিংয়ের পাশাপাশি তাতে দায় আছে ভারতীয় ব্যাটারদের বাজে শটেরও। শিবম দুবে তিন রান, হার্দিক পাণ্ডিয়া সাত রান, রবীন্দ্র জাদেজা শূন্য রান, অর্ষদীপ সিং ৯ রান (রান আউট), যশপ্রীত বুমরাহ আউট হন শূন্য রানে।
জীবনযুদ্ধে জয়ী ঋষভ পন্থ শুধু ব্যাট করেছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে গাড়ি দুর্ঘটনায় জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যাওয়া পন্ত দশম ওভারে হারিস রউফের টানা তিন বলে মারেন তিন বাউন্ডারি। এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার ৩১ বলে ছয়টি বাউন্ডারিতে আউট হন ৪২ রানে। মিডঅফ এগিয়ে এনে ফাঁদ পাতা হয়েছিল পন্থের জন্য। আমিরের বলে সেই ফাঁদে পা দিয়ে তুলে মারতে গিয়ে আউট পন্থ।
নিউ ইয়র্কের নাসাউ স্টেডিয়ামের পিচের অসমান বাউন্সে রান পাচ্ছেন না ব্যাটাররা। ১৪ হাজার মাইল দূর থেকে উড়িয়ে আনা ড্রপ ইন পিচের বাউন্স অসমান। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে রোহিত শর্মা, ঋষভ পন্থদের শরীরে লেগেছিলো একাধিক বল।
এরপর আইসিসি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল,‘‘ আইসিসি বুঝতে পেরেছে, যেমন প্রত্যাশা ছিল নাসাউ স্টেডিয়ামের উইকেট সেরকম আচরণ করেনি। বিশ্বমানের মাঠকর্মীরা কঠোর পরিশ্রম করে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে।'' সেই চেষ্টার ফল- নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ১০৪ রান তাড়া করতে নেমে ১২ রানে ৪ উইকেট হারিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা!
সেই পিচে ভারতও অল-আউট ১১৯ রানে। এতে অবশ্য পিচের চেয়ে তাদের ব্যাটারদের দায়ই বেশি। তবে পিচের পাশাপাশি বৃষ্টিভেজা আউটফিল্ড মন্থর না হলে রান আরও বাড়তে পারত ভারতের।
জবাবে শুরুটা ভালো হয়নি পাকিস্তানের বাবর আজম ১০ বলে ফিরেন ১৩ রান করে। যশপ্রীত বুমরাহর বল স্লিপে সূর্যকুমারের হাতে তুলে দেন পাকিস্তানি অধিনায়ক। পাওয়ার প্লেতে ১ উইকেটে ২৫ করে পাকিস্তান। লক্ষ্যটা অল্প হওয়ায় অহেতুক ঝুঁকি নেয়নি তারা। মোহাম্মদ রিজওয়ান ও উসমান খান। দ্বিতীয় উইকেটে গড়েন ৩১ রানের জুটি। ১৫ বলে ১৩ করা উসমান খানকে এলবি করে জুটিটা ভাঙেন অক্ষর প্যাটেল।
ফখর জামানও হার্দিক পাণ্ডিয়ার বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন ঠিক ১৩ রানেই। টপ অর্ডারের তিন ব্যাটারই আউট সমান ১৩ রানে! মোহাম্মদ রিজওয়ান আগলে ছিলেন একটা প্রান্ত। ৪৪ বলে ১ বাউন্ডারি ১ ছক্কায় ৩১ করা রিজওয়ানকে বোল্ড করেন বুমরা। ম্যাচে প্রাণ ফিরে তখন।
শেষ ৫ ওভারে পাকিস্তানের দরকার ছিল ৩৭ রান, হাতে ৬ উইকেট। ১৭তম ওভারে শাদাব খানকে (৪) উইকেটের পেছনে পন্থের ক্যাচ বানিয়ে ভারতের জয়ের আশা জাগান হার্দিক পান্ডিয়া। শেষ ৩ ওভারে পাকিস্তানের দরকার ছিল ৩০ রান। নিউইয়র্কের নাসাউ স্টেডিয়ামের পিচে যা সহজ ছিল না মোটেও।
সেই কাজটা আরও কঠিন হয়ে যায় বুমরার আগুনে বোলিংয়ে। ১৯তম ওভারে মাত্র ৩ রান দিয়ে ইফতিখার আহমেদের উইকেটটি নেন তিনি। শেষ ওভারে দরকার ছিল ১৮ রান। অর্শদীপ সিংয়ের বলে সেটা আর নিতে পারেনি পাকিস্তান। নাসিম শাহ ৪ বলে ১০ করলেও হৃদয় ভাঙে বাবর আজমদের।
এমনিতে বিশ্বকাপ নিয়ে বাড়তি উন্মাদনা নেই যুক্তরাষ্ট্রে। সেই গোলার্ধে ভারত-পাকিস্তান মহারণে স্টেডিয়ামের কাছাকাছি সেডার ক্রিকেট পার্কে জায়ান্ট স্ক্রিন বসিয়ে আয়োজন করা হয়েছে খেলা দেখার। নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে গাড়ি চলা বন্ধ ছিল ম্যাচে শেষ না হওয়া পর্যন্ত। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ যে এখনও ক্রিকেটের সেরা বিজ্ঞাপন, এতে সন্দেহ নেই।
এ জন্যই রিসেলের ওয়েবসাইটে ‘সিট নাম্বার থার্টি'র টিকিটের দাম উঠেছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় দেড় কোটি টাকার বেশি! গ্যালারিও ছিল ভরা। এমন পরিবেশে লো স্কোরিং থ্রিলার কি ক্রিকেটের প্রসারে কাজে আসবে যুক্তরাষ্ট্রে? উত্তরটা সময়ের হাতেই তোলা রইল।