আকাশে পাখির ঝাঁক দেখতে কার না ভালো লাগে? স্পেনের এক ফটোগ্রাফার শুধু সেই মুহূর্ত নয়, পাখির ঝাঁকের এক অভিনব সার্বিক চিত্র সৃষ্টি করছেন৷ হাইস্পিড ফটোগ্রাফির কৌশল এমন অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম সম্ভব করে তুলছে৷
আকাশে পাখিদের চক্রাকারে ওড়ার দৃশ্য ধরে রাখতে চাবি-কে সেকেন্ডে কয়েক ডজন ছবি তুলতে হয়৷ চাভি বো তাঁর উদ্যোগের ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘‘একটি শকুনির আরও ছবি তোলা আমার উদ্দেশ্য নয়৷ এমন অনেক ছবি রয়েছে৷ বরং প্রকৃতির নতুন ধরনের সৌন্দর্য দেখাতে চাই৷ পাখিদের ওড়ার ছন্দ সেই সৌন্দর্য সৃষ্টি করে৷''
তাঁর কাজ অনেকটা ক্যালিগ্রাফি-ভিত্তিক শিল্পকর্মের মতো৷ পাখিরাই আকাশে সেই রেখা সৃষ্টি করে৷ যেমন পানকৌড়িদের সুন্দর প্যাটার্ন বা নক্সা, হেরিং গাল পাখিদের যাত্রাপথ অথবা আইসল্যান্ডের আকাশে ফালমার ও পাফিন পাখির চলাচল৷
চাভি বো বার্সেলোনা শহরে থাকেন৷ ৮ বছর ধরে তিনি ‘অর্নিটোগ্রাফিস' নামের ছবির প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন৷ গ্রিক ভাষায় পাখি ও লেখার সমন্বয়ে শব্দটি গঠন করা হয়েছে৷ এককালের ফ্যাশন ফটোগ্রাফার এখন গোটা বিশ্বে নিজের তোলা পাখিদের পরাবাস্তব ছবি বিক্রি করেন৷ চাভি বলেন, ‘‘এমন প্যাটার্ন চিরকাল আমাদের কাছে অদৃশ্য ছিল৷ কারণ আমরা কোনো একটি মুহূর্তে তা দেখতে পাই৷ আর এখানে একটি ছবির মধ্যে বেশ কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা স্থান পেয়েছে৷ এ যেন কয়েক সেকেন্ডকে একটি মুহূর্ত হিসেবে দেখার মতো অভিজ্ঞতা৷ সেটা অসম্ভব হলেও আমরা তা করতে পারি৷''
একটি ছবি সৃষ্টি করতে চাভি বো কয়েক'শ ছবি নিখুঁতভাবে পর পর সাজান৷ সামান্য ব্যবধানে তোলা ফটোগুলি ‘ক্রোনোফোটাগ্রাফি' প্রক্রিয়ায় একত্র করা হয়৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই কৌশল সৃষ্টি হয়েছিল৷ ১৮৭৮ সালে এডওয়ের্ড মাইব্রিজ এই প্রক্রিয়ার সাহায্যে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন, যে ঘোড়া দৌড়ানোর সময়ে কয়েক মিলিসেকেন্ডের জন্য শূন্যে ভাসে৷
চাভি বো-র ছবিগুলিতে অবশ্য এককভাবে কোনো পাখি চেনা যায় না বলা চলে৷ তিনি বলেন, ‘‘পাখিদের নড়াচড়ার প্যাটার্নই আসল বিষয়৷ অনেকে তার মধ্যে ডিএনএ শৃঙ্খল, তার অথবা কম্পিউটার গ্রাফিক দেখতে পান৷ সেটাই আমার আগ্রহের কারণ৷ প্রথমবার দেখলে ঠিক কী চোখে পড়ে?''
ছোটবেলায় চাভি বো তাঁর পিতামহের সঙ্গে অসংখ্য পাখি পর্যবেক্ষণ করতেন৷ তখন থেকেই পাখি তাঁর বিস্ময়ের কারণ৷ মোটিফ খুঁজতে তাঁকে বেশিদূর যেতে হয় না৷ কারণ তাঁর মতে, সব জায়গায় পাখি মানুষের চারিপাশেই রয়েছে৷ যেমন বার্সেলোনা শহরের পার্ক দে লা সিইউতাদেলা-য়৷ চাভি বলেন, ‘‘এই মুহূর্তে আমাদের চারপাশে কত পাখি, নানা রকম শব্দ ও ধ্বনি রয়েছে৷ কিন্তু আমরা সবসময়ে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকি বলে সে সব টের পাই না৷ আমরা মানুষের মনে কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে চাই৷ তারা উপরে তাকিয়ে যেন এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে৷''
হাইস্পিড ফটোগ্রাফির সাহায্যে ব্যস্ত জীবনের মাঝে একটু বিরতি৷ চাভি বো সময়কে সন্নিবিষ্ট করে অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করে তুলছেন৷
সুন্দর কিছু পাখি
বাংলাদেশে দেখতে পাওয়া যায় অসংখ্য প্রজাতির পাখি৷ সৌখিন আলোকচিত্রী তৌহিদ পারভেজ বিপ্লবের ক্যামেরায় তোলা সুন্দর সুন্দর কিছু পাখির ছবি নিয়েই এই ছবিঘর৷
ছবি: Touhid Parves Biplob
সিঁদুরে মৌটুসি
বাংলাদেশ, ভারত এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায় ছোট্ট এ পাখিটি৷ ইংরেজি নাম ‘ক্রিমসান সানবার্ড’৷ পুরুষ সিঁদুরে মৌটুসি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পাখিগুলোর একটি৷ পুরুষ পাখি লম্বায় প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার এবং ওজনে প্রায় আট গ্রাম৷ বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই পাখিটি দেখা যায়৷ বিপ্লব এ ছবিটি তুলেছেন সুন্দরবন থেকে৷
ছবি: Touhid Parves Biplob
দেশি গাঙচষা
ইংরেজিতে ‘ইন্ডিয়ান স্কিমার’ নামের পাখিটির বাংলা নাম দেশি গাঙচষা৷ ছবিটি বিপ্লব তুলেছেন উত্তরাঞ্চলের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে৷ এছাড়া বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার দমার চরে এ পাখিটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়৷ বাংলাদেশে এ পাখিটির সংখ্যা গত কয়েক বছরে আশঙ্কাজনকভাবে কেমেছে৷ আইইউসিএন এই প্রজাতিটিকে সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনেও এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত৷
ছবি: Touhid Parves Biplob
সোনাকপালি হরবোলা
সবুজ রঙের ছোট এই পাখিটির ইংরেজি নাম ‘গোল্ডেন ফ্রন্টেড লিফবার্ড’৷ বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকার বিভিন্ন জঙ্গলে এ পাখিটি বেশি দেখা যায়৷ পাখিটি লম্বায় মাত্র ১৯ সেমি. এবং ওজনে ৩০ গ্রাম হয়ে থাকে৷ সোনাকপালি হরবোলা সাধারণত পোকামাকর, ফুলের রস ও পাকা ফল খায়৷ ছবিটি তোলা হয়েছে হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে৷
ছবি: Touhid Parves Biplob
পাহাড়ি ময়না
পাহাড়ি ময়না দলের এই ছবিটিও তোলা হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে৷ ইংরেজি নাম ‘হিল ময়না’৷ এছাড়া ময়না, পাতি ময়না, সোনাকানি ময়না নামেও এটি পরিচিত৷ মানুষের কণ্ঠ হুবহু অনুকরণ করতে পারে পাহাড়ি ময়না৷ আর এ কারণে মানুষ এ পাখির ছানা বন থেকে ধরে খাঁচায় বন্দি করে পোষার কারণে দিনে দিনে এ প্রজাতিটি দুর্লভ হয়ে পড়ছে৷
ছবি: Touhid Parves Biplob
চখাচখি
চখাচখির ইংরেজি নাম ‘রুডি শেলডাক’৷ চখাচখি বলতে মূলত এক জোড়া হাঁসকে বোঝায়৷ জোড়ার পুরুষ হাঁসটিকে চখা আর স্ত্রী হাঁসটিকে চখি নামে ডাকা হয়৷ চখাচখি সবসময় জোড়ায় জোড়ায় থাকে৷ এ কারণেই এরকম নাম পেয়েছে তারা৷ শীতে এ পাখিটি পরিযায়ী হয়ে বাংলাদেশে আসে৷ বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত৷ ছবিটি তোলা হয়েছে রাজশাহীর চরাঞ্চল থেকে৷
ছবি: Touhid Parves Biplob
পাহাড়ি নীলকান্ত
দুর্লভ এ পাখির ছবিটিও আলোকচিত্রী রাজশাহী থেকে তুলেছেন৷ পাখিটির ইংরেজি নাম ‘ইন্ডিয়ান রোলার’৷ পাখিটির শরীরজুড়ে কালচে নীল রং আর লাল চওড়া ঠোঁট খুবই দৃষ্টিনন্দন৷ ডানা মেলে ধরলে ডানার মধ্যে সাদা একটি অংশ দু’দিকে ভেসে ওঠে৷ পাহাড়ি নীলকান্তকে কেউ কেউ পাহাড়ি নীলকণ্ঠও বলেন৷
ছবি: Touhid Parves Biplob
আমুর শাহিন
আমুর বাজ নামেও পরিচিত পাখিটির ইংরেজি নাম ‘আমুর ফ্যালকন’৷ শিকারি এ বাজ পাখিটি পরিযায়ী হয়ে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে আসে৷ শিকারি পাখি হলেও স্বভাবে এরা হিংস্র নয়৷ এরা সাধারণত একাকী, জোড়ায় কিংবা ছোট দলে বিচরণ করে৷ এ পাখিটি সাধারণত ছোট পাখি, পোকা, চামচিকা, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি ইত্যাদি প্রাণী খেঁয়ে বেঁচে থাকে৷ আইইউসিএন এই প্রজাতিটিকে সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করেছে৷
ছবি: Touhid Parves Biplob
শ্বেত আঁখি
ইংরেজি ‘ওরিয়েন্টাল হোয়াইট আই’ নামের ছোট্ট পাখিটির বাংলা নাম হরেক৷ শ্বেত আঁখি, শ্বেতাক্ষি, উদয় ধলা চোখ, বাবুনাই, চশমা টুনি, চশমা পাখি নানা নামে পরিচিত পাখিটি৷ ছবিটি তোলা হয়েছে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে৷ ‘শ্বেত আঁখি’ বাংলাদেশের সুলভ পাখি৷ দেশের সর্বত্রই কম-বেশি দেখা যায়৷ পাখিটি বিশ্বে ও বাংলাদেশে বিপদমুক্ত প্রজাতি বলে বিবেচিত এবং বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত৷
ছবি: Touhid Parves Biplob
উদয়ী পাকড়া ধনেশ
ইংরেজিতে ‘ওরিয়েন্টাল পাইড হর্নবিল’ কাও ধনেশ বা পাকড়া ধনেশ নামে পরিচিত৷বাংলাদেশের মূলত পাহাড়ি মিশ্র চিরসবুজ বনে এ পাখি এখনো দেখা যায়৷ বন ধ্বংস এবং বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের খাবার হিসেবে শিকার এবং হাতুড়ে চিকিৎসায় বহুল ব্যবহারের কারণে এ প্রজাতাটি হুমকির মুখে পড়েছে৷ ছবিটি তোলা হয়েছে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে৷
ছবি: Touhid Parves Biplob
সিপাহি বুলবুলি
ইংরেজিতে ‘রেড ভিস্কার্ড বুলবুল’ আমাদের দেশে সিপাই বুলবুলি নামেও পরিচিত৷ এছাড়া বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকায় পাখিটি ঝুঁটি বুলবুল, ঝুঁটকুলি, পাহাড়ি বুলবুল বা চায়না বুলবুল নামেও পরিচিত৷ এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আবাসিক পাখি৷ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, হংকং ও চীন এই প্রজাতিটির মূল আবাসস্থল৷
ছবি: Touhid Parves Biplob
বাসন্তী লটকনটিয়া
ভোরা, লেজকাটা টিয়া কিংবা লটকন নামেও পরিচিত এটি৷ ইংরেজি নাম ‘ভার্নাল হ্যাঙ্গিং প্যারট’৷ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে এদের মূল আবাস৷ পাখিটি আর্দ্র পাতাঝরা চিরসবুজ বনে বেশি দেখা যায়৷ সচরাচর এরা পারিবারিক দলে সর্বাধিক ৫০টি পাখির ঝাঁকে দেখা যায়৷ বনের ফলদ গাছে এরা ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁজে বেড়ায়৷
ছবি: Touhid Parves Biplob
মদনা টিয়া
সুন্দর রঙের এ পাখিটির ইংরেজি নাম ‘রোজ ব্রেস্টেড প্যারাকিট’৷ মদনা টিয়া পাহাড়ি জঙ্গলের পাশের হালকা জঙ্গল, জুমচাষের এলাকা ও চা-বাগানের গাছে গর্ত করে বাসা বাঁধে৷ ফল, পুরু ফুল, ফুলরস, ফুলকুঁড়ি এদের স্বাভাবিক খাদ্য৷ তবে ফসল তোলার মৌসুমে কৃষিখেতে দলবেধে হামলা চালায়৷
ছবি: Touhid Parves Biplob
মাছমুরাল
পাখিটির ইংরেজি নাম ‘অসপ্রে’৷ অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ, মরু ও মেরু অঞ্চল ছাড়া সমগ্র পৃথিবী জুড়ে পাখিটির বসবাস আছে৷ ১৯৯৪ সালে মাছমুরালকে ক্যানাডার নোভাস্কশিয়া প্রদেশের প্রাদেশিক পাখি ঘোষণা করা হয়েছে৷ বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত৷ আলোকচিত্রী ছবিটি তুলেছেন ফেনির মুহুরি সেচ প্রকল্প এলাকা থেকে৷
ছবি: Touhid Parves Biplob
বেগুনি বক
পাখিটির ইংরেজি নাম ‘পার্পল হেরন’৷ বক প্রজাতির এ পাখিটি শীতকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়৷ টাঙ্গুয়ার হাওর, বাইক্কা বিলসহ আরো অনেক এলাকার বিলে মাছ খেতে দেখা যায় পাখিটিকে৷ ছবিটি তোলা হয়েছে ফেনির মুহুরি সেচ প্রকল্প এলাকা থেকে৷