একঝাঁক স্টার পাখি, দেখলে মনে হবে কেউ যেন জাদুকাঠি দিয়ে তাদের সুন্দর এক নক্সা অনুযায়ী সাজিয়ে তুলছে৷ হাজার হাজার পাখি আকাশে যেন নাচছে৷ পানিতেও এমন নক্সা দেখা যায়৷ প্রাণীরা দলবদ্ধভাবে নিখুঁত কারুকার্য সৃষ্টি করে, যা মানুষের ক্ষমতার বাইরে৷
কিন্তু প্রাণীরা কীভাবে এবং কেন এমনটা করে? জার্মানির কনস্টানৎস শহরে মাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের জীববিজ্ঞানী অ্যালেক্স জর্ডান সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন৷ তিনি মাছের ঝাঁক নিয়ে গবেষণা করছেন৷ তাদের মাঝে সাঁতার কাটার জাদুময় অভিজ্ঞতা সত্যি ভোলার নয়৷ অ্যালেক্স স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘‘তারা ছন্দময় এক প্যাটার্নে আমার চারিপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল৷ সাঁতার কাটতে কাটতে আমি তার শব্দ শুনতে পেলাম৷ চোখের সামনে শুধু মাছেদের প্রাচীর দেখতে পেলাম৷ নাটকীয় ও অসাধারণ সেই অভিজ্ঞতা৷''
এ যেন নৃত্যপরিচালক ছাড়াই কোরিওগ্রাফি! কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব হয়? অতীতে মানুষ সহজ নিয়মের আশ্রয় নিয়ে প্রাণীদের ঝাঁকের আচরণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতো৷ যেমন, সবাই নাকি সর্দারকে অনুসরণ করে! অথবা শত্রুকে এড়িয়ে যেতে প্রাণীরা নাকি ঝাঁকে ঘোরাফেরা করে৷ আজ সেই মনোভাব বদলে গেছে৷ অ্যালেক্স জর্ডান বলেন, ‘‘আমরা জানি, এমন প্রণালীতে প্রত্যেক প্রাণীর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷ তারা যেভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করে বা প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা মোটেই এক নয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের আচরণে স্বয়ংক্রিয় কোনো প্রক্রিয়া নেই৷ আজ আমরা তাদের পর্যবেক্ষণ করার সময়ে প্রত্যেকটি প্রাণীর উপর লক্ষ্য রেখে আলাদা করে তাদের গতিবিধি বিশ্লেষণ করতে পারি৷ তার ভিত্তিতে প্রশ্ন করতে পারি৷''
যেন একরাশ কালো মেঘ৷ স্টারলিং পাখিগুলো এমনভাবে দলবেঁধে আকাশে উড়ে উড়ে জ্যামিতিক আকৃতি তৈরি করে যে , তা সব অ্যারোবেটিক্স দলকেই হার মানাবে৷ ক্যামেরার চোখে দেখুন ইসরায়েলের আকাশে ধরা পড়া এমন চমৎকার দৃশ্য৷
ছবি: Reuters/A. Cohenকখনো ঝরা পাতার মতোন, কখনো ওড়ার চেষ্টা করা ঘুঘু, কিংবা কখনো সাঁতরে বেড়ানো বিশাল তিমি মাছের আকৃতি তৈরি করে পাখির ঝাঁক৷ এই স্টারলিংগুলো ইউরোপীয় পরিযায়ী পাখি৷ ইসরায়েলে আসে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ থেকে৷
ছবি: Reuters/A. Cohenএই ছবিগুলো দক্ষিণ ইসরায়েলের বেইট কামা গ্রাম থেকে তোলা৷ রাতে ঘুমোতে যাবার আগে পাখিগুলো নানান আকৃতি তৈরি করে৷ শুধু যে এরা আকৃতি তৈরি করে তা-ই নয়, কিচিরমিচির শব্দে মাতিয়ে রাখে পুরো এলাকা৷
ছবি: Reuters/R. Zvulunবিজ্ঞানিরা ঠিক জানেন না, কিভাবে তারা এসব আকৃতি তৈরি করে৷ কিন্তু কেউ কেউ বলেন যে, এরা ইচ্ছে করে এমন করে না৷ বরং ঝাঁকের একটি পাখি তার নিকটবর্তী আরেকটির কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব তৈরি করে ওড়ে৷ তাতেই এমন আকৃতি তৈরি হয়৷ তা বলে এতটা নিখুঁত?
ছবি: Reuters/A. Cohenযুক্তরাষ্ট্রের পাখি বিশেষজ্ঞ জাকারি স্ল্যাভিন বলেন, ‘‘ঠিক যেন মাছের মতো৷ এই ঝাঁকের কোনো নেতা নেই৷ কিন্তু তারা এমনভাবে থাকে যেন একসঙ্গে একটি গন্তব্যে পৌঁছায়৷ এদের একজন গতিপথ বদলালে এরা দ্রুত সেই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে৷’’
ছবি: Reuters/A. Cohenসাধারণত শীত ও বর্ষায় স্টারলিংয়ের এমন ঝাঁক দেখা যায়৷ গ্রীষ্মের শেষ দিকে এই পাখিগুলোর প্রজনন প্রক্রিয়া শেষ হয়৷ এরপর বড় বড় ঝাঁকে এরা অভিযাত্রা শুরু করে৷ পরে শীতের শেষে অথবা বসন্তের শুরুতে এরা তাদের প্রজননস্থলে ফিরে আসে৷
ছবি: Reuters/A. Cohenকিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন এরা এমন ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়ায়? বিশ্লেষকদের মন্তব্য যে, পাখিগুলো দলবেঁধে ঘুরে বেড়ালে এদের হাজারো চোখে একসঙ্গে খাবার খোঁজা সহজ হয়৷ এতে একই খাবারের খোঁজে থাকা প্রাণিদের এ লড়াইয়ে পরাজিত করা সহজ হয়৷
ছবি: Reuters/A. Cohenআরো একটি কারণ, নিরাপত্তা৷ চিল, বাজপাখিদের হাত থেকে বাঁচতে এমন উপায় বেছে নিয়েছে তারা৷ বিশ্লেষকরা বলেন, তারা এমনভাবে ঘুরে যেন, বাজপাখিদের চোখে একেকটি পাখি আলাদা করে ধরা পড়া কঠিন হয়ে যায়৷
ছবি: Reuters/A. Cohenএরা যে শুধু ইউরোপেই ঘোরাঘুরি করে তা নয়৷ এই পরিযায়ী পাখিগুলোর ওড়ার সীমানা উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে দক্ষিণ ইউরোপ, এমনকি পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত৷
ছবি: Reuters/A. Cohen ব্যক্তি নিয়ে কীভাবে সমষ্টি সৃষ্টি হয়? সেটা জানলে সেই জ্ঞান মানুষের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে৷ তখন নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো সমষ্টিতে মানুষের আচরণ বোঝা যাবে৷
আফ্রিকার মধ্যভাগে টাঙ্গানাইকা হ্রদে সিচিল্ডস গোত্রের মাছের ঝাঁকের আচরণ অ্যালেক্স জর্ডানের কাছে বিশেষ আগ্রহের কারণ হয়ে উঠেছে৷ কখনো তারা ঝাঁক বেঁধে এগিয়ে যায়, কখনো আলাদা থাকে৷ তাই তারা পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত৷
কনস্টানৎস শহরের ল্যাবেও সেটা সম্ভব৷ সেখানে গবেষকরা আফ্রিকার হ্রদের একটা অংশ গড়ে তুলেছেন৷ তাতে নানা প্রজাতির সিচিল্ডস মাছ মিলেমিশে রয়েছে৷ তাদের মধ্যে কিছু মাছ অত্যন্ত সামাজিক আচরণে অভ্যস্ত, বাকিরা একেবারেই নয়৷ অ্যালেক্স জর্ডান বলেন, ‘‘এই প্রজাতির মাছ আমার মতো অনধিকার প্রবেশকারীকে বরদাস্ত করবে, এমন সম্ভাবনা অনেক কম৷ তারা আমাকে ধারেকাছে আসতেই দেবে না৷''
এই মুহূর্তে এই মাছগুলি কেন ঝাঁকে ঘোরাফেরা করছে না? এমন আচরণের ব্যাখ্যা দিয়ে অ্যালেক্স বলেন, ‘‘পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর৷ সেখানে একা ও আত্মকেন্দ্রিক হলে কঠিন পরিস্থিতেতে পড়তে হতে পারে৷ সেই নিরাপদ পরিবেশে হয়তো নিয়ম মানার ও সংঘদ্ধ হয়ে কিছু করার চাপ অনেক শিথিল হয়ে পড়ে৷ তখন সবাইকে নিজের মতো আচরণ করতে দেখা যায়৷''
গোল্ড ফিশ মেমোরি বলে একটা কথা আছে৷ কারো ক্ষণস্থায়ী স্মৃতির তুলনা দিতে ব্যবহার হয় এই মাছের স্মৃতিকে৷ কিন্তু মাছের যে নানা রকমের অনুভূতিও আছে, সেটা কি জানেন? না জানলে জেনে নিন৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkelএকসময় মাছকে মনে করা হতো অনুভূতিহীন প্রাণী৷ কিন্তু ধীরে ধীরে বিজ্ঞানীরা জানতে পারছেন যে, মাছেরও আছে নিজেদের সামাজিক জীবন৷ তারা শোক প্রকাশ করে, একসাথে শিকারে যায় এমনকি বিভিন্ন অদ্ভুত রকমের যৌন সম্পর্কেও জড়ায়৷ মাছের এই অজানা জীবন দেখতে হলে যেতে হবে সাগরের গভীরে৷
ছবি: Fotografie Dos Winkel, www.dos-bertie-winkel.com & www.seafirst.nl মাছেরাও একে অপরকে রক্ষা করে৷ব়্যাবিট ফিশ বা খরগোশ মাছরা দুপুরে একসাথে খেতেও যায়৷ একজন যখন গভীর জলে প্রবালপ্রাচীরে জন্মানো শেওলা খেতে ব্যস্ত, অন্যজনের চোখ তখন শিকারিদের সন্ধানে৷ এভাবে ভাগাভাগি করেই খাবার খায় খরগোশ মাছ৷ এতদিন শুধু উচ্চবুদ্ধির প্রাণীদের মধ্যেই এমন সামাজিকতা দেখা যেতো৷
ছবি: gemeinfreiঅনেকদিন ধরে মনে করা হতো মাছেরা ভয় পায় না৷ কারণ, ভয় পাওয়ার জন্য মস্তিষ্কের যে অংশ দায়ী, তা মাছের নেই৷ কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, মাছেরাও ভয় পায়৷ শুধু তাই না, ব্যথা এবং চাপ অনুভব করার ক্ষমতাও আছে মাছের৷ এ নিয়ে অবশ্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে বেশ বিতর্কও চলছে৷ মৎসকল্যাণ কর্মীরা মাছ শিকার বিষয়ে নতুন করে ভাবার কথাও বলছেন৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/H. Goethelআড্ডা তো আমাদের খুবই পছন্দ৷ ছুটির দিনে বন্ধুদের বাসায় নিয়ে এসে গল্প করতে কার না ভালো লাগে৷ ক্লাউন ফিশ বা সং মাছ অবশ্য আড্ডা দেয় কিনা জানা যায়নি৷ তবে তাদের বাসায় কিন্তু বন্ধুবান্ধবের অভাব হয় না৷ বিষাক্ত এক ধরনের জলজ ফুলগাছে বাসা বানায় এই মাছ, যা শিকারিদের দূরে রাখে৷ প্রায়ই এক মাছের বাসায় কয়েকদিন বেড়াতে আসে অন্য কোনো এক মাছ৷
ছবি: Fotografie Dos Winkel, www.dos-bertie-winkel.com & www.seafirst.nl গ্রাউপার মাছ দেখতেই কেমন বদখত৷ তার মধ্যে আবার মোরে ঈলের সাথে জুটি বেঁধে শিকারে গেলে অন্যদের তো ভয়েই পালানোর কথা৷ গবেষকরা বলছেন, গ্রাউপার মাছ শিকারে যাওয়ার সময় মাথা ঝাঁকায়৷ ঈল সে ইশারা বুঝতে পেরে অন্য মাছের বাসায় ঢুকে পড়ে৷ দুর্ভাগা মাছ হয় বাসার ভেতরেই ঈলের খাবারে পরিণত হয়, নাহলে পালাতে গিয়ে ঢুকে পরে বাইরে হাঁ করে থাকা গ্রাউপারের মুখে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/H. Schmidbauer এই গবেষণার অন্যতম ফল হিসেবে জানা গেছে, যে প্রাণীরা টিকে থাকতেই ঝাঁকের মধ্যে ঘোরে৷ অ্যালেক্স জর্ডান ভিডিও ক্যামেরায় মাছেদের গতিবিধির ছবি তোলেন৷ এক সফটঅয়্যার সেই ছবিতে প্রত্যেকটি মাছকে আলাদা করে শনাক্ত করতে পারে৷ অ্যালেক্স বলেন, ‘‘এমনই একটি দৃশ্য দেখে কম্পিউটার অ্যালগোরিদম একটি মাছের আচরণ তুলে ধরতে পারে৷ তার পরিচয়, তার অবস্থান, ঝাঁকে একটি মাছের আচরণের ফলে পরিবর্তন সম্পর্কে বাকিদের প্রতিক্রিয়া কী হয়, সে সব জানিয়ে দিতে পারে৷''
মাছেরা কখন ঝাঁকের মধ্যে বাকিদের অনুসরণ করবে, কখনই বা আলাদা হয়ে যাবে – কীভাবে তারা সেই সিদ্ধান্ত নেয়? এই প্রশ্নের জবাব এখনো পাওয়া যায়নি৷ তবে সিচিল্ডস মাছ যে দলবদ্ধ হয়ে বেশ মজা পায়, তা বেশ স্পষ্ট৷ ঝাঁকের মধ্যে তারা যে শক্তিশালী, সেই বোধ হয়তো তাদের আছে৷