বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগ বলেছে, এক বছরে সন্তোষজনক টাকা ফেরত না এলে এই সুযোগ আর নয়৷ ঘোষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের যে টাকা ফেরত আনতেই হবে তা নয়৷ বিদেশে থাকা স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তির উপর নির্ধারিত হারে কর দিলেও তা বৈধ বলে গণ্য হবে৷ আর এটা করলে তারা ফৌজদারী মামলা থেকেও রেহাই পাবেন৷
অর্থমন্ত্রী আহম মোস্তাফা কামাল বাজেটবক্তৃতায় পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না বলে জানিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, বিদেশে স্থাবর সম্পত্তি ফেরত না আনলে শতকরা ১৫ ভাগ কর দিতে হবে৷ অস্থাবর সম্পত্তি ফেরত না আনলে ১০ ভাগ কর দিতে হবে৷ আর রেমিটেন্স আকারে ফেরত আনলে সাত শতাংশ কর দিতে হবে৷
এই সুযোগ চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুনপর্যন্ত বহাল থাকবে৷ সিপিডি, টিআইবি, এফবিসিসিআই, আওয়ামী লীগ ছাড়া বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা এই সুযোগের সমালোটনা করেছেন৷ তারা বলেছেন, এটা ন্যায়-নীতি বিরোধীই শুধু নয়, এর ফলে ঘুস-দুর্নীতি উৎসাহিত হবে, টাকা পাচার আরো বাড়বে এবং সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন৷
দুর্নীতি রুখতে কি দুদক ব্যর্থ?
46:20
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকার যেভাবে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে চাইছে তা অনৈতিক, বেআইনি, দুর্নীতি সহায়ক এবং বৈষম্যমূলক৷''
‘‘সরকার যেভাবে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে চাইছে তা অনৈতিক’’
This browser does not support the audio element.
তার কথায়:
১. এটা বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অনৈতিক৷ কারণ ২০১২ সালে অর্থ পাচার বিরোধী যে আইন করা হয় তাতে বলা হয়েছে পাচার করা অর্থ বাজেয়াপ্ত করতে হবে, পাচার করা অর্থের দ্বিগুণ পরিমান জরিমানা হবে এবং চার বছর থেকে ১২ বছরের কারাদণ্ড হবে৷
২. এটা বৈষম্যমূলক, কারণ যারা বৈধ প্রক্রিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, আয় করেন তাদের সর্বোচ্চ শতকরা ৩০ ভাগ পর্যন্ত কর দিতে হয়৷ অবৈধভাবে আয় করে পাচার করে ফেরত আনলে কর শতকরা সাত ভাগ৷ এটা শুধু বৈষম্যমূলক নয়, যারা অসৎ তাদের পুস্কৃত করা হচ্ছে৷এতে পাচার বাড়বে এবং সৎ লোকরা নিরুৎসাহিত হবেন৷
৩. যারা অর্থ পাচার করেছেন তারা সাত শতাংশ কর দিয়ে টাকা ফেরত আনবেন এটা সরকারের অলীক চিন্তা৷ এর কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নাই৷ যারা বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন তারা সেটা সেখানে রাখা এবং ভোগ করার জন্যই করেছেন৷
৪. এটা যদি তাদের বৈধ আয় হতো তাহলে তাদের সাত শতাংশ কর দেয়ার প্রশ্ন আসত না৷ কারণ বাংলাদেশি যারা বিদেশে বৈধভাবে আয় করেন তারা বিনা ট্যাক্সেই টাকা দেশে পাঠাতে পারেন৷ সুতরাং যে টাকার কথা বলা হচ্ছে সেটা অবৈধ আয়৷
তাই তিনি মনে করেন, সরকার চাইলেই এই টাকা ফেরত আনতে পারবে না৷ এরজন্য আন্তর্জাতিক আইন আছে, দেশে আইন আছে৷ সেই আইনে অর্থ পাচার গুরুতর অপরাধ৷ সেই আইন মেনেই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিয়ে পাচারের অর্থ ফেরত আনতে হবে৷ বাংলাদেশেও এর উদাহরণ আছে৷ সিঙ্গাপুর থেকে আইন মেনেই পাচারের অর্থ ফেরত আনার নজির আছে৷
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম মনে করেন, সরকার যে পদ্ধতিতে পাচার করা অর্থ দেশে আনতে চায় তাতে দেশে ঘুস-দুর্নীতি উৎসাহিত হবে৷ কারণ পাচার করা অর্থ অবৈধভাবে আয় করা হয়েছে৷ দুর্নীতি ও ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে তা দেশে বাইরে পাচার করা হয়েছে৷
দুর্নীতির সাথে পাচারও উৎসাহিত হবে: ড. মইনুল ইসলাম
This browser does not support the audio element.
তিনি বলেন, ‘‘এটা অনৈতিক৷এতে পাচার না কমে বরং বাড়বে৷ দুর্নীতির সাথে পাচারও উৎসাহিত হবে৷ আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্নীতি উৎসাহিত হবে৷ বৈধভাবে আয় করলে কর হবে উচ্চ হারে৷ অবৈধভাবে আয় করলে কর হবে কম৷ এটা তো দুর্নীতির পক্ষে যায়৷ এটা কালো টাকা সাদা করার আরো বড় সুযোগ৷
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার ব্যক্তিগত ধারণা টাকা ফেরত আনা কঠিন হবে৷ টাকাতো হাতছাড়া হয়ে গেছে, দেশের টাকা বিদেশে চলে গেছে, সরকার ট্যাক্স পায়নি৷ সরকার তো নিরুপায়৷ অসহায় বলব না, মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে৷ তাই একটি সুযোগ দিয়ে দেখা যদি কিছু ফেরত আসে৷ বড়শি যখন আমরা পানিতে ফেলি তখন আশা করি মাছ ধরবে৷ তা না হলে আমরা বড়শি ফেলব কেন?''
টাকা তো হাতছাড়া হয়ে গেছে: পরিকল্পনামন্ত্রী
This browser does not support the audio element.
তার কথায়, ‘‘অনেকে বলেন ঝুঁকি আছে৷ ঝুঁকি তো আছেই৷ কেউ বলছেন, ভালো মানুষরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন৷ ব্যবসা বণিজ্যে ভালো মানুষ, মন্দ মানুষ বলে কোনো কথা নেই৷ ব্যবসা করে লাভের আশায়৷ আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা আশাবাদী নই৷ তবে চেষ্টা করতে আপত্তি কী? যদি কিছু পাওয়া যায় এই আশায় সরকার এই কাজটি করছে৷ টাকা তো বেরিয়ে গিয়েছে৷ আমরা কি মোড়ল দেশগুলোর সাথে পারবো?''
পশ্চিমবঙ্গে পি কে হালদার ও সুকুমার মৃধার ‘অবৈধ’ সম্পত্তি
শনিবার পশ্চিমঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছেন বাংলাদেশের অর্থপাচার মামলার আসামি পি কে হালদার৷ এর আগে তার ও তার সহযোগীদের সম্পত্তির খোঁজে অভিযান শুরু করে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)৷ ছবিঘরে বিস্তারিত...
ছবি: Satyajit Shaw
সুকুমার মৃধার বাড়ির সন্ধানে
শুক্রবার ভোরে বাংলাদেশে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার মামলার আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারের বা পি কে হালদারের সহযোগী সুকুমার মৃধার সম্পত্তির সন্ধানে পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি শুরু করে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)৷ শুরুতে উত্তর ২৪ পরগণার অশোকনগরের এই বাড়িতে হানা দেয় তারা৷
ছবি: Satyajit Shaw
সিলগালা
তল্লাশির পর তিনতলা বাড়িটি সিলগালা করে দেয় ইডি৷ ফটকে লাগিয়ে দেয়া হয় নোটিশ৷ তাতে বলা হয়েছে, অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন ২০০২ এর আলোকে বাড়িটি জব্দ করা হয়েছে৷ তাই সেখান থেকে কোনো সম্পত্তি যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ বা অনুমতি ছাড়া সরাতে বা পরিবর্তন করতে পারবে না কেউ৷
ছবি: Satyajit Shaw
দ্বিতীয় বাড়ির খোঁজ
অশোকনগরে সুকুমার মৃধার আরো একটি বাড়ির খোঁজ মেলে৷ সেখানেও তল্লাশি চালায় ইডি৷ তিনি বাংলাদেশের পলাতক আসামি পি কে হালদারের আয়কর আইনজীবী ছিলেন৷ পি কে হালদারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের করা অর্থ পাচারের মামলায় গত বছর সুকুমার ও তার মেয়ে গ্রপ্তার হন৷ তখন থেকেই তারা বাংলাদেশের কারাগারে আছেন৷
ছবি: Satyajit Shaw
তল্লাশি স্বজনদের বাড়িতেও
সুকুমার মৃধার কয়েকটি বাড়ি পরই তার আত্মীয় প্রণব হালদারের বাড়ি৷ সেখানেও তল্লাশি চালিয়েছে ইডি৷ তবে প্রণব হালদার ও তার পরিবার ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেছেন সুকুমার মৃধার ব্যবসার সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা তাদের নেই৷ তল্লাশির মাধ্যমে তারা হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন৷
বাংলাদেশের পেশায় আয়কর আইনজীবী হলেও পশ্চিমবঙ্গে তিনি মাছ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত৷ বিভিন্ন স্থানের তার মাছের ভেড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে৷ অশোকনগরে তার বাড়ির ভিতরেই রয়েছে একটি৷
ছবি: Satyajit Shaw
‘লোক ডেকে খাওয়াতো’
বাংলাদেশের নাগরিক সুকুমার মৃধা প্রায়ই পশ্চিমবঙ্গে থাকতেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা৷ পিন্টু দাস নামের এই ব্যক্তি জানান, ‘‘সুকুমার মৃধা খুব ধনী লোক বাংলাদেশও ওর সম্পত্তি আছে শুনেছি, বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে ক্লাব থেকে ১০০ লোক ডেকে খাওয়াতো৷ প্রত্যেক বছর পাড়ার পুজোর সভাপতি হতো এবং ভালো টাকা ডোনেশন দিত৷’’
ছবি: Satyajit Shaw
‘ধনী ব্যক্তি হিসেবে চিনি’
স্থানীয় বাসিন্দা বিষ্ণু প্রসাদ চক্রবর্তী জানান, ‘‘আমরা ওনাকে ধনী ব্যক্তি হিসেবে চিনি৷ আমাদের কোনোরকম সন্দেহ হয়নি কারণ আমরা জানি বাংলাদেশে ওনার ঘর-বাড়ি আছে ও কাজ করে ওখান থেকে টাকা পয়সা নিয়ে আসে৷ তারপর শুনি এই ঘটনা ইডির লোকজন এসে বাড়ি সিল করে দিয়ে যায়৷’’
ছবি: Satyajit Shaw
ইডি যা বলছে
শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশের নাগরিক প্রশান্ত কুমার হালদার, প্রিতীশ কুমার হালদার, প্রনেশ কুমার হালদার ও তাদের সহযোগীদের খোঁজে পশ্চিমবঙ্গের ১০ টি জায়গায় অভিযান পরিচালনা করছে৷ এই ব্যক্তিরা বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে বলেও উল্লেখ করেছে ইডি৷
ছবি: Subrata Goswami/DW
পি কে হালদারের খোঁজ
এই অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে বাংলাদেশে পলাতক আসামী পি কে হালদারেরও খোঁজ পায় ইডি৷ তিনি অবৈধভাবে কাগজপত্র সংগ্রহ করে সেখানে শিবশঙ্কর হালদার নামে বসবাস করছিলেন৷ ইডি বলছে, তিনি ও তার সহযোগীরা কলকাতার মেট্রোপোলিসসহ বিলাসবহুল সব এলকায় অবৈধভাবে বহু সম্পত্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকানা অর্জন করেছেন৷ তাকে তিনদিনের রিমান্ডে নেয় ইডি৷
ছবি: Subrata Goswami/DW
বাংলাদেশ যা বলছে
এদিকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রোববার বলেছেন, “পি কে হালদার ওয়ান্টেড ব্যক্তি, ইন্টারপোলের মাধ্যমে অনেক দিন ধরে তাকে চাচ্ছি৷ ...সে গ্রেপ্তার হয়েছে, তবে আমাদের কাছে এখনও (ভারত থেকে) অফিসিয়ালি কিছু আসেনি৷’’ এর আগে শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছিলেন, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে জানালে যত দ্রুত সম্ভব বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে৷
ছবি: bdnews24.com
11 ছবি1 | 11
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী এর আগে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয় এই কথাই স্বীকার করতেন না৷ এবার বাজেটের মাসখানেক আগে থেকে তিনি তা স্বীকার করা শুরু করেন৷ আর বাজেটে অর্থ পাচারকারীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরদিন তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিরোধিতা না করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘‘টাকা যদি পাচার হয়ে থাকে, সরকার তা ফেরত আনার চেষ্টা করছে৷ যেটা পাচার হয়ে গেছে সেটা এদেশের মানুষের হক৷ যদি বাধা দেই তবে আসবে না৷ যদি না আসে আমাদের লাভটা কী? অন্য দেশ যা করে, আমরা তাই করতে যাচ্ছি৷ ১৭টা দেশ অ্যামনেস্টি দিয়ে টাকা ফেরত এনেছে৷''
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ থেকে কত টাকা এখন পর্যন্ত পাচার হয়েছে তার হিসাব সরকারের কাছে নেই৷ তবে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে শুধু বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার বা সোয়া চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে৷ আর সুইস ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, সেখানে বাংলাদেশিদের টাকা জমা আছে প্রায় পাঁচ হাজার ২০৩ কোটি টাকা৷
সম্প্রতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া থেকে এখন অবধি মোট আট লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে৷
জাদুঘরে বাংলাদেশের টাকা-পয়সার ইতিহাস
বাংলাদেশের টাকা-পয়সার ইতিহাস জানতে হলে ঢাকার এই টাকা জাদুঘরে ঢুঁ মারতেই হবে৷ আবহমানকাল থেকে মুদ্রার ক্রমবিকাশের ধারাকে সংরক্ষণ করা হয়েছে এখানে৷ ছবিঘরে দেখে নিন বিস্তারিত..
ছবি: Rajib Paul
টাকার গাছ!
জাদুঘরটির মূল দরজা দিয়ে ঢুকে একটু উপরে তাকালে চোখে পড়ে ভবনের দেয়ালে সাজানো টাকার গাছ! প্রাচীন বাংলা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রচলিত মুদ্রা ও টাকার রেপ্লিকা দিয়ে স্টিলের কাঠামোতে গাছের মতো রূপ দেওয়া হয়েছে শিল্পকর্মটিকে৷ প্রবেশপথের ডানপাশের দেয়ালে টেরাকোটায় (পোড়ামাটির ফলকচিত্র) ফুটে উঠেছে প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত লেনদেনের ধারাবাহিক বিবর্তনের চিত্র৷
ছবি: Rajib Paul
টাকা-পয়সার শো-কেস
টাকা জাদুঘর হলো মুদ্রা সম্পর্কিত একটি বিশেষ জাদুঘর৷ ২০১৩ সালের ২৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক শিলান্যাসের মাধ্যমে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়৷ সেই বছরের ৫ অক্টোবর সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী এটি উদ্বোধন করেন৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ২০০৯ সালে স্থাপিত কারেন্সি মিউজিয়ামের সম্প্রসারিত এবং আধুনিক রূপ বলা যায় এটিকে৷
ছবি: Rajib Paul
বাংলাদেশের প্রথম কাগজের নোট
১৯৭২ সালের ৪ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কাগজের নোট চালু হয়৷ ১ টাকার নোটটি ছাপা হয়েছিল ইন্ডিয়ান সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে৷ দ্বিতীয় সিরিজে ১ টাকার নোট ইস্যু করা হয় ১৯৭৩ সালের ২ মার্চ৷ ১৯৭২ সালের ২ জুন ১০ টাকার নোট এবং ১ সেপ্টেম্বর ইস্যু করা হয় ১০০ টাকার নোট৷ একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ৫ টাকা চালু হয়েছিল৷ ১০ টাকার নোটের মধ্য দিয়ে বাংলা সিরিয়ালযুক্ত নোট প্রথম চালু হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি৷
ছবি: Rajib Paul
বিশ্বের সুন্দরতম নোট
এক পিঠে গাছের ডালে থাকা জাতীয় পাখি দোয়েল, অন্য পিঠে ভাষা আন্দোলনের স্মারক শহিদ মিনার–বাংলাদেশের ২ টাকার নোটের কথা বললেই ভেসে ওঠে এই ছবি৷ ১৯৮৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর এটি প্রথম মুদ্রিত হয়৷ রাশিয়ার অনলাইন এন্টারটেইনমেন্ট আউটলেট পরিচালিত একটি সমীক্ষায় বিশ্বের সুন্দরতম নোটের স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশের ২ টাকার নোট৷
ছবি: Rajib Paul
বাংলাদেশের টাকা-পয়সার জন্ম
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে ৫, ১০, ২৫ এবং ৫০ পয়সা মূল্যের ধাতব মুদ্রা চালু হয়েছিল৷ ১৯৭৪ সালে ১ পয়সা এবং ১৯৭৫ সালে ১ টাকা মূল্যের ধাতব মুদ্রা চালু হয়৷ ১৯৯৪ সালে ৫ টাকা এবং ২০০৪ সালে আসে ২ টাকা মূল্যের ধাতব মুদ্রা৷ ১৯৭৬ সালের ১ মার্চ ৫০ টাকার নোট এবং ১৫ ডিসেম্বর ৫০০ টাকার নোট চালু হয়৷ ২০ টাকার নোট বাজারে এসেছিল ১৯৭৯ সালের ২০ আগস্ট৷ ২০২০ সালে মুজিব-বর্ষ উপলক্ষে চালু হয় ২০০ টাকার বিনিময়যোগ্য নোট৷
ছবি: Rajib Paul
বাংলাদেশের টাকা ছাপানোর প্রেস
গাজীপুর সদরের শিমুলতলিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস কর্পোরেশনে ১৯৮৮ সালে ১ টাকা মূল্যমানের কারেন্সি নোট এবং ১০ টাকা মূল্যমানের ব্যাংক নোট উৎপাদন শুরুর মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম কাগজের টাকা উৎপাদন হয়৷ ১৯৮৯ সালে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর কালক্রমে অন্যান্য মেশিনপত্র স্থাপন এবং সফলভাবে অন্যান্য মূল্যমানের নোট ছাপা শুরু হয় দেশের টাঁকশালে৷
ছবি: Rajib Paul
অর্থসচিব এবং গভর্নরের স্বাক্ষর
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মুদ্রা হিসেবে ‘টাকা’ প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এক টাকা ও দুই টাকার নোট এবং ধাতব মুদ্রা বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে চালু হয়৷ এজন্য এগুলোতে অর্থসচিবের স্বাক্ষর থাকে৷ পাঁচ, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচলন করে বলে এগুলোতে গভর্নরের স্বাক্ষর দেখা যায়৷
ছবি: Rajib Paul
টাকার নকশা
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন মূল্যমানের নোট, যেমন—এক টাকা, পাঁচ টাকা ও ১০ টাকার দুটি করে এবং ১০০ টাকার একটি নোটের নকশা করেছেন শিল্পী কে. জি. মুস্তাফা৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মজয়ন্তী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার ৯০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মুদ্রিত তিনটি রুপোর স্মারক মুদ্রা এবং বাংলাদেশের বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মুদ্রিত একটি স্মারক নোটের নকশাও তার৷
ছবি: Rajib Paul
স্মারক মুদ্রা ও নোটের সম্ভার
টাকা জাদুঘরে বেশকিছু স্মারক নোট রয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর, বাংলাদেশের বিজয়ের ৪০ বছর, জাতীয় জাদুঘরের ১০০ বছর পূর্তি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসের ২৫ বছর পূর্তি৷ বিভিন্ন মূল্যমানের এসব স্মারক নোটের অনুমোদিত নকশাও আছে৷ এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন মাইলফলক ও দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত স্বর্ণ, নিকেল ও রৌপ্য মুদ্রা প্রদর্শিত হয় এখানে৷
ছবি: Rajib Paul
টাকা-পয়সা বহনের বাক্স-সিন্দুক
টাঁকশাল থেকে মুদ্রা বাঁধাই ও বহন করে আনার বাক্স রাখা আছে শো-কেসে৷ একসময়ের মহাজনদের মুদ্রা ও টাকা রাখার নানান রঙের সুদৃশ্য থলেও রয়েছে৷ এছাড়া আছে টাকা-পয়সা সংরক্ষণের বিশেষ উপকরণ, বাটি, পিতলের ছোট কলস, মুদ্রা জমা রাখার লোহার সিন্দুক এবং এসব কাজে ব্যবহৃত হাতুড়ি, সুতা ও অন্যান্য সরঞ্জাম৷
ছবি: Rajib Paul
মুদ্রা তৈরির ডাইস
জাপান, জার্মানি ও ক্রেমনিকা (স্লোভাকিয়া) টাঁকশালের দেওয়া মুদ্রা তৈরির ডাইস টাকা জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ৷ ২০১১ সালে বাংলাদেশে আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজন উপলক্ষে জারিকৃত ১০ টাকা মূল্যমানের স্মারক রৌপ্য মুদ্রা তৈরির জার্মান টাঁকশালের মাস্টার ডাইস দেখা যায় এই জাদুঘরে৷ আরো কয়েকটি মুদ্রার ডাইস রয়েছে ঢাকার টাকা জাদুঘরে৷
ছবি: Rajib Paul
লেনদেনের একাল-সেকাল
এক নম্বর গ্যালারি দিয়ে ঢুকে সোজা হেঁটে শেষ পর্যন্ত গেলে দেখা যায় তিনটি ডিওরামা৷ শিল্পীর নিপুণ হাতে এগুলোতে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে বাংলার হাজার বছরের লেনদেন প্রথা৷ একসময় মানুষ ধানের বিনিময়ে গরু এবং চালের বিনিময়ে মুরগি নিতো৷ আরেকটিতে দেখা যায় নদীর পাশে হাটে বেচাকেনা হচ্ছে সোনালি পাট৷ অন্যটিতে ফুটে উঠেছে পুরোনো দিনে মানুষের মুদ্রা রাখার ছবি৷
ছবি: Rajib Paul
ডিজিটাল প্রযুক্তি সংযোজন
টাকা জাদুঘরের শো-কেসে প্রদর্শনের জন্য রাখা মুদ্রার ভিডিওচিত্র ও তথ্য জানানো হয় ডিজিটাল সাইনেজে৷ ডিজিটাল কিয়স্কের মাধ্যমে দর্শনার্থীরা আঙুলের স্পর্শে মুহূর্তে পেয়ে যাবেন যে-কোনো নোট বা মুদ্রার তথ্য৷ থ্রিডি পর্দায় দেখা যায় মুদ্রার ত্রিমাত্রিক রূপ৷ এলইডি টিভিতে দেখানো হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড৷ অডিও গাইড প্রযুক্তির মাধ্যমে দর্শনার্থীরা শুনতে পারেন, জানতে পারেন বিভিন্ন মুদ্রার ইতিহাস৷
ছবি: Rajib Paul
টাকায় দর্শনার্থীদের ছবি
টাকা জাদুঘরের দুই নম্বর গ্যালারিতে রয়েছে ফটো কিয়স্কের (ছোট ঘর) প্রতিলিপি৷ আরেকটি গ্যালারিতে মূল ফটো কিয়স্কে দর্শনার্থীরা ৫০ টাকার বিনিময়ে নিজেদের আবক্ষ ছবি সম্বলিত স্যুভেনির নোট ছাপিয়ে নিতে পারেন৷ নীচতলায় জাদুঘরের স্যুভেনির শপ থেকে বিভিন্ন সময়ে মুদ্রিত স্মারক মুদ্রা ও নোট, বিভিন্ন ধরনের স্যুভেনির দ্রব্য এবং টাকা জাদুঘরের বিভিন্ন প্রকাশনা কেনার সুযোগও রয়েছে৷
ছবি: Rajib Paul
ঘুরে আসুন টাকা জাদুঘর
ঢাকার মিরপুর-২ নম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিংঅ্যাকাডেমি ভবনে অবস্থিত টাকা জাদুঘর৷ শনি থেকে বুধবার সকাল ১১টা থেকে বিকাল পাঁচটা, শুক্রবার বিকাল চারটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে টাকা জাদুঘর৷ বৃহস্পতিবার এবং সরকারি ছুটিতে জাদুঘরটি বন্ধ থাকে৷ সর্বসাধারণের জন্য এটি উন্মুক্ত, তাই কোনো প্রবেশমূল্য নেই৷ শুধু প্রবেশের সময় দর্শনার্থীদের নাম ও মোবাইল নম্বর লিখে রাখা হয়৷