কাদা পানিতে ভাসছে একটি শিশুর মরদেহ৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকের দাবি, নাফ নদী পার হতে গিয়ে পানিতে ডুবে মরা এক শিশুর ছবি এটি৷ সত্যিই কি তাই?
বিজ্ঞাপন
শিশুটির দু'টো ছবি সোমবার থেকে ফেসবুকে শেয়ার হচ্ছে৷ একটি ছবিতে তার মরদেহ কাদা পানিতে ভাসছে৷ অপর ছবিটি মরদেহ উদ্ধারের পর তোলা৷ ছবি দু'টো আয়লান কুর্দির কথা মনে করিয়ে দেয়৷ ২০১৫ সালে তুরস্কের সমুদ্রতটে পাওয়া গিয়েছিল ছোট্ট আয়লানের মৃতদেহ৷ যুদ্ধ থেকে বাঁচতে সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসা শিশুটি সমুদ্রের পানিতে ডুবে মরেছিল৷ তার সেই ছবি গোটা বিশ্বের আলোড়ন সৃষ্টি করে৷ ইউরোপও সিরীয় শরণার্থীদের প্রতি সদয় হয়৷
ভুলে যাওয়া শরণার্থীরা: বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে রোহিঙ্গারা
গত অক্টোবরে মিয়ানমারে দমনপীড়ন শুরুর পর ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছেন৷ মুসলিমপ্রধান দেশটিতে বর্তমানে পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করছেন৷ কুতুপালংয়ের মতো জনাকীর্ণ ক্যাম্পগুলোতে তাদের অনেকের বাস৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
মিয়ানমার থেকে পালানো
মিয়ানমারে গত অক্টোবরে নয় পুলিশ হত্যার অভিযোগ ওঠে এক রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে৷ তারপর থেকে সেদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর আবারো দমনপীড়ন শুরু হয়৷ ফলে সত্তর হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে৷ তারা যেসব ক্যাম্পে বসবাস করেন সেগুলোর একটি এই কুতুপালং৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
স্বনির্ভরতা দরকার
কুতুপালং ক্যাম্পের শরণার্থীরা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে নিরাপদ আছে বটে, তবে জীবন সেখানে মোটেই সহজ নয়৷ সেখানে সত্যিকারের কোনো অবকাঠামো নেই, সবই শরণার্থীদের গড়া অস্থায়ী আবাস৷ তারা নিজেদের দেশ ছেড়ে এসেছেন, কেননা, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং অসংখ্য মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ করেছে৷ মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে এই তথ্য৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
শিশুদের খেলা নয়
আশ্রয়শিবিরটির অধিকাংশ এলাকায় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই৷ কয়েক হাজার শরণার্থী শিশুর খেলোধুলারও কোন ব্যবস্থা নেই৷ ক্যাম্পের লেক থেকে মাটি সংগ্রহ করছে এই শিশুটি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
কুঁড়েঘরে বসবাস
কাদা মাটি এবং সহজলভ্য অন্যান্য উপাদান দিয়ে ঘর তৈরি করে বাস করেন শরণার্থীরা, যাতে মাথার উপরে অন্তত ছাদ থাকে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস
সেই ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই সেদেশে রোহিঙ্গারা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷ তাদেরকে নাগরিকত্ব এবং ভোট দেয়ার অধিকার দিচ্ছে না সরকার৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
বাংলাদেশেও বৈষম্যের শিকার?
বাংলাদেশেও বৈষম্যে শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা৷ ক্যাম্পে আর জায়গা নেই- বলে বাংলাদেশে জলপথে আশ্রয় নিতে আসা অসংখ্য রোহিঙ্গাকে তাদের নৌকাসহ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে সীমান্তরক্ষীরা৷ পাশাপাশি কক্সবাজার ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের একটি দুর্গম দ্বীপে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার৷ স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, দ্বীপটি বর্ষাকালে অধিকাংশ সময় পানির নীচে তলিয়ে যায়৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
নির্জন দ্বীপে সরিয়ে নেয়া
ঠ্যাঙ্গার চর বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মেঘনা নদীর মোহনায় কয়েকবছর আগে জেগে ওঠা এক দ্বীপ৷ শুধুমাত্র নৌকায় করে সেখানে যাওয়া যায় এবং চরটিতে অতীতে একাধিকবার জলদস্যু হানা দিয়েছে৷ এক উন্নয়নকর্মী সম্প্রতি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন যে দ্বীপটিতে কর্মসংস্থানেরও তেমন কোনো সুযোগ নেই৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নেই
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী স্বীকার করেছেন যে, ঠ্যাঙ্গার চরকে বসবাসের উপযোগী করতে আরো অনেক কাজ করতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘দ্বীপটিতে উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করার পর রোহিঙ্গাদের সেখানে সরিয়ে নেয়া হবে৷’’ তবে সরকার অতীতে এরকম প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি৷ কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের তেমন কোন উন্নয়ন সাধন করা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
ইতিহাস থেকে মোছার চেষ্টা
নিরাপদ আবাসভূমি না থাকায় রোহিঙ্গাদে ভবিষ্যত ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে৷ অন্যদিকে, মিয়ানমার তাদের অতীত মুছে ফেলতে কাজ করছে৷ দেশটির সংস্কৃতি এবং ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতিহাস বিষয়ক পাঠ্যবই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছে যেখানে রোহিঙ্গাদের কথা একেবারেই উল্লেখ থাকবে না৷ গত ডিসেম্বরে মন্ত্রণালয়টি দাবি করেছে, মিয়ানমারের ইতিহাসে কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে কখনো রোহিঙ্গা নামে আখ্যায়িত করা হয়নি৷
কথিত রোহিঙ্গা শিশুটির ছবি অনেকের মনেই দাগ কেটেছে৷ তবে ছবিটির সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে৷ অতীতে দেখা গেছে, অন্য কোনো ঘটনার, নির্যাতনের ছবি রোহিঙ্গাদের বলে দাবি করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ এবারও কি তাই ঘটছে?
ইন্টারনেটে কোনো ছবির আসল উৎস জানার এক সহজ উপায় হচ্ছে গুগলের রিভার্স ইমেজ সার্চ এবং টিনআই৷ ফেসবুকে পাওয়া ছবিটি সেখানে সার্চ করে দেখা যাচ্ছে যে, সোমবার অল্প সময়ের ব্যবধানে ‘এনসোনহাবের' নামের একটি তুর্কি নিউজ সাইটে এবং ‘জাফনা মুসলিম' নামের একটি তামিল ব্লগসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে৷ ব্লগসাইটটিতে ছবিটির সঙ্গে যে লেখা রয়েছে তাতে মিয়ানমারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে৷ আর লেখকের নাম রয়েছে আস-শেখ টিএম মুফারিস রাশাদী৷ তিনি তাঁর ফেসবুক পাতাতে গতকাল ছবি দু'টি প্রকাশ করেন, যা শুধুমাত্র তাঁর প্রোফাইল থেকেই শেয়ার হয়েছে পাঁচ শতাধিকবার৷ তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি৷ ফেসবুক ম্যাসেজেরও কোনো উত্তর তিনি এই ব্লগ লেখা পর্যন্ত দেননি৷ ফটোফরেনসিক নামক আরেকটি ওয়েবসাইট রয়েছে, যেখানে একটি ছবি কতটা পুরনো সে সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়৷ তুর্কি নিউজওয়েবসাইটে প্রকাশিত ছবিটি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, ছবিটি পুরাতন নয়৷ আর ইন্টারনেটেও গতকালের আগে ছবিটি কখনো প্রকাশ করা হয়নি বলে জানাচ্ছে গুগল৷ ডয়চে ভেলের একজন পাঠক অবশ্য জানিয়েছেন যে, রবিবার টুইটারে এক ব্যক্তি আরো কয়েকটি ছবির সঙ্গে নিহত শিশুর ছবিটিও শেয়ার করেছিলেন৷
তাছাড়া, ছবিতে কাদামাখা যে পানি দেখা যাচ্ছে, তা পাহাড় ঘেঁষে বয়ে চলা নদীর পানি হতে পারে৷ তবে প্রশ্ন থেকে যায় ছবির উৎস নিয়ে৷ ‘জাফনা মুসলিম' শ্রীলঙ্কাভিত্তিক একটি ব্লগ৷ তাদের কাছে এই ছবি কিভাবে পৌঁছালো তা জানা যায়নি৷ এজন্য ব্লগটির সঙ্গে ইমেল ও স্কাইপে যোগাযোগ করা হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি৷ আর তুর্কি নিউজসাইটটিতে ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি৷ ফলে ছবিটি সত্যিই রোহিঙ্গা কোনো শিশুর কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না৷
আপনি কি ছবিটির সম্পর্কে অন্য কোনো তথ্য জানেন? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷