পানির নীচের জগত সম্পর্কে আমরা কতটা জানি? এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়া সম্ভব নয়৷ তবে বিজ্ঞানীরা এখন তৈরি করছেন এমন এক ডিভাইস যেটি পানির অনেক গভীরে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা আগাম জানাতে সক্ষম হবে৷
বিজ্ঞাপন
নরওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে বিজ্ঞানীরা এমন এক স্বয়ংক্রিয় ডিভাইস পরীক্ষা করছে যেটি পানির নীচে কী ঘটছে তা শনাক্ত করতে এবং বুঝতে সক্ষম৷ তারহীন যোগাযোগ ব্যবস্থা গবেষক কাইল জাং এই বিষয়ে বলেন, ‘‘যন্ত্রটির কেসিংয়ের মধ্যে পরিস্থিতি বোঝার এবং প্রাপ্ত তথ্য প্রক্রিয়াকরণের উপযুক্ত ইলেকট্রনিক উপকরণ রয়েছে৷ যার অর্থ হচ্ছে আমরা যদি একটি জাহাজ বা তেলের পাইপে ছিদ্র পরীক্ষা করতে চাই, সেটার জন্য পরিস্থিতি অনুযায়ী ডিভাইসটিকে তৈরি করে নিতে পারবো৷ আমরা সবকিছু এখানে করবো আর যন্ত্রটি কন্ট্রোল সেন্টারে সিগন্যাল পাঠাবে৷’’
পানির নীচে এসব কাজও করা যায়!
ডাইভিং বা সাঁতার অথবা স্নোরকেলিং কি আর আপনার মনে কোনো রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে না? তাহলে পানির নীচে যেতে পারেন৷ রেস্তোরাঁ এবং জাদুঘরগুলো আপনার অপেক্ষায় আছে৷ দেখে নিন ছবিঘরে৷
ছবি: Jason deCaires Taylor - creator & photographer
বিভিন্ন ড্রামারের ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ
ড্যানিশ ব্যান্ড ‘বিটুইন মিউজিক’ এমন সব বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার করেছে, যেগুলো আপনি পানির নীচে বাজাতে পারেন৷ এগুলোর মধ্যে আছে হাইড্রাউলোফোন, পানির নীচে বাজে এমন অর্গান, ক্রিস্টালোফোন, গ্লাস হারমোনিকা এবং বিশেষ ড্রাম৷ তাঁদের অ্যালবাম ‘অ্যাকোয়াসনিক’ রেকর্ড করা হয়েছে উষ্ণ পানির বিভিন্ন পুলে, যেখানে তাপমাত্রা ছিল ৩৫ ডিগ্রি৷ তাঁ@রা অবশ্য গান গাওয়ার জন্য বিশেষ কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে থাকেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/J, Nackstrand
কোনো সাধারণ বাগান নয়
আপনার অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ কি প্রায়ই সেখানকার উদ্ভিদ খেয়ে ফেলে? তাহলে আপনি ‘অ্যাকোয়াস্কেপিং’ চেষ্টা করে দেখতে পারেন৷ এর মাধ্যমে আপনি পানির নীচে দারুণ সব দৃশ্য সৃষ্টি করতে পারেন৷ কেবল উদ্ভিদ ব্যবহার করেই নয়, পাথর, গাছের শেকড়, কাঠও ব্যবহার করতে পারেন আপনি৷
ছবি: DW
পানির তলদেশে খাওয়া
বেলজিয়ামের রেস্তোরাঁ ‘দ্য পার্ল’ ব্রাসেলসে অবস্থিত, যেটি বিশ্বের অন্যতম গভীর পুলে নির্মাণ করা হয়েছে৷ এর ভেতরে যেতে হলে অতিথিদের সাঁতারের পোশাক পরতে হবে এবং একটা ক্যাপসুলের ভেতর দিয়ে ৫ মিটার সাঁতরে যেতে হবে৷ আর মেন্যুতে কী থাকছে? অবশ্যই সামুদ্রিক খাবার! প্রতিটি খাবার ওয়াটারপ্রুফ কাঁচ দিয়ে প্যাক করা৷ প্রতি জনের খাবারের মূল্য মাত্র ১০০ ইউরো!
ছবি: DW
পানির তলদেশে শিল্পকর্ম
২০১৬ সালে ব্রিটিশ ভাস্কর জেসন ডি কেয়ার্স টেইলর তাঁর নতুন প্রকল্প চালু করেন ক্যানারিসের ল্যানসারোট উপকূলে৷ তাঁর ‘মুসিও আটলান্টিকো’ শিল্পকর্মটি পানির ১৪ মিটার গর্ভীরে তৈরি করেছেন তিনি, যেখানে ২০০টিরও বেশি ভাস্কর্য রয়েছে৷ পরিবেশবান্ধব পদার্থ ব্যবহার করেই ভাস্কর্যগুলো নির্মাণ করা হয়েছে৷ এর ফলে সমুদ্র তলদেশে প্রাণী বা উদ্ভিদের কোনো ক্ষতি হবে না৷
ছবি: Jason deCaires Taylor - creator & photographer
বুদবুদের মাধ্যমে বার্তা
বিয়ের বর-কনের অবশ্যই অতিথিদের একটা মজার তালিকা হতেই পারে: রঙিন মাছ, শৈবাল, স্টিং রে, এমনকি হাঙর পর্যন্ত৷ আপনি যদি ইউরোপে থাকেন, তাহলে কিন্তু এটা সম্ভব৷ এই মহাদেশজুড়ে এমন অনেক অ্যাকোয়ারিয়াম রয়েছে, যেখানে গিয়ে আপনি বিয়ের কাজটি সেরে ফেলতে পারেন৷ আর বিয়ের অঙ্গীকার, অর্থাৎ ‘আই ডু’ বলার সময় একটি বুদবুদের মাধ্যমে সেই বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন অন্য সবার কাছে৷
ছবি: MICHAEL KAPPELER/AFP/Getty Images
5 ছবি1 | 5
পানির নীচের পাইপলাইনে ছিদ্র বোঝার এক সঙ্কেত হতে পারে বুদবুদ৷ একটি সেন্সর বুদবুদের শব্দ শনাক্ত করবে এবং সম্ভাব্য ছিদ্র সম্পর্কে ইঞ্জিনিয়ারদের সতর্ক করবে৷ কিন্তু এটা কি বড় পরিসরে, সমুদ্রের গভীরে কাজ করতে সক্ষম? একটি ইউরোপীয় গবেষণা প্রকল্প ধ্বনিতাত্ত্বিক নজরদারির জন্য একটি কার্যকরী নেটওয়ার্ক তৈরিতে কাজ করছে৷ প্রকল্পের সমন্বয়ক পাউল হাভিংখা বলেন, ‘‘আমরা পানির নীচে সেন্সর ডিভাইসগুলো পাঠিয়ে দেই, সেগুলো পানির গভীরে চলে যায় এবং সেখানকার পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করবে, এবং সেগুলো যদি অস্বাভাবিক কিছু দেখে তাহলে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করবে এবং প্রয়োজনে উপকূলে সংকেত পাঠাবে৷’’
সমুদ্রের তলায়, মানে পানির কয়েকশ’ মিটার গভীরে নির্দিষ্ট দূরত্বে কয়েকটি বিশেষভাবে তৈরি সেন্সর বসানো হয়েছে৷ এদের প্রতিটি স্বয়ংক্রিয় এবং বিল্ট-ইন ব্যাটারিযুক্ত, ফলে তাদের আলাদা কোনো পাওয়ার কেবলের দরকার নেই, যা ডিভাইসটি তৈরির খরচ কমিয়েছে৷ টোয়েন্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পাউল হাভিংখা এই বিষয়ে বলেন, ‘‘এটা একটা বড় ডিভাইস, গভীর জলের জন্য তৈরি, কয়েক কিলোমিটার গভীরে যেতে পারে৷ এটির প্যাকেজিং, কেসিং এবং ইলেকট্রনিক্স দেখলেই আপনি সেটা বুঝতে পারবেন৷ এগুলো আরো নির্ভরযোগ্য এবং দূরপাল্লায় কাজ করার উপযোগে করেই তৈরি৷’’
পানির নীচের একটি সেন্সর যখন কোনো ছিদ্র শনাক্ত করে, তখন সেটি শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে তথ্যটি অন্য যন্ত্রে পাঠায়৷ অন্য যন্ত্রগুলো সেটা গ্রহণ করে এবং পরস্পরের সহযোগিতায় উপকূলে পাঠানোর চেষ্টা করে৷ যন্ত্রগুলো পাঠানো সংকেত গ্রহণ করতে পানির উপরে কিছু ভাসমান বয়া রয়েছে, যেগুলো ধ্বনিতাত্বিক বার্তাকে রেডিও সিগন্যালে পরিণত করে৷ এমন ধ্বনিতাত্ত্বিক নেটওয়ার্ক ভবিষ্যতে ন্যাভিগেশন, জলজপ্রাণী পর্যবেক্ষণ এবং পানির পাইপ লাইন রক্ষা এবং ড্রিলিং প্লাটফর্মকে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষায় সহায়তা করবে৷
২০১৬ সালের অক্টোবরের ছবিঘরটি দেখুন...
বিশ্বের প্রথম ভাসমান টানেল তৈরির পরিকল্পনা নরওয়ের
ফিয়র্ডের দেশ নরওয়ে৷ এগারোশ’রও বেশি টানেল আছে সেখানে৷ এর মধ্যে ৩৫টি পানির নীচে অবস্থিত৷ তবে এবার এমন টানেল তৈরি করতে চাইছে তারা, যেটি পানিতে ভাসবে৷
ছবি: NPRA/Vianova
উন্নয়নের পক্ষে বাধা
নরওয়েতে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ সেখানকার ফিয়র্ডগুলো৷ তবে ফিয়র্ডের কারণেই সে দেশের বিভিন্ন স্থানে সেতু, তথা অবকাঠামো নির্মাণের কাজটি কঠিন হয়ে যায়৷ সেই সমস্যার সমাধানে এবার ভাসমান টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা করছে নরওয়ে৷
ছবি: NPRA
সময় বাঁচানো
নরওয়ের ক্রিস্টিয়ানসান্ড ও ট্রডেনহাইম শহরের মধ্যে দূরত্ব ৮০০ কিলোমিটার৷ কিন্তু এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে সময় লাগে ২১ ঘণ্টা৷ কারণ সাতটি ফেরি পার হতে হয়৷ ভাসমান টানেল হলে সময় লাগবে ১০-১১ ঘণ্টা৷
ছবি: NPRA/Vianova
বিশাল বয়া
টিউবের মতো দেখতে টানেলটি পানির প্রায় ৩০ মিটার নীচে থাকবে৷ টানেলকে ভাসিয়ে রাখতে পানির উপরে থাকবে বয়া বা প্লবক৷ প্রয়োজন হলে সাগর তলদেশেও ঠেস দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে৷
ছবি: NPRA/vegvesen.no
বাজেট
২০৩৫ সালের মধ্যে টানেল তৈরির কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে৷ বাজেট ধরা হয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলার৷
ছবি: NPRA/Vianova
জাহাজের জন্য রাস্তা
পানির স্রোত আর ঠান্ডা তাপমাত্রা সামলানোর ক্ষমতা থাকতে হবে টানেলের৷ তাছাড়া বয়াগুলো এমন দূরত্বে বসাতে হবে যেন বড় বড় জাহাজগুলো টানেলের কোনো ক্ষতি না করেই পেরিয়ে যেতে পারে৷
ছবি: NPRA
সাইকেল ও হাঁটার পথ
টানেলের মধ্যে সাইকেল ও পায়ে হাঁটার রাস্তাও রাখা হতে পারে৷ টানেলের ভেতরের পরিবেশ আরামদায়ক করতে গাছ লাগানোসহ বিশেষ লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করা হতে পারে৷
ছবি: NPRA/vegvesen.no
একমাত্র সমাধান
নরওয়েতে এগারোশ’রও বেশি আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল আছে৷ এর মধ্যে ৩৫টি পানির নীচে৷ তবে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের ফিয়র্ডে পানির গভীরতা ও প্রতিকূল পরিবেশের কারণে ভাসমান টানেল স্থাপনই একমাত্র সমাধান৷