পানির অপচয়ের দৃষ্টান্তের অভাব নেই৷ ভারত-বাংলাদেশে এই সংকট এখনো মারাত্মক আকার ধারণ করেনি বটে, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে পানি অপচয় গভীর সমস্যা আনতে পারে৷ এ সমস্যা মোকাবিলায় জার্মানির সহায়তায় লেবাননে শুরু হয়েছে একটি উদ্যোগ৷
বিজ্ঞাপন
পানি পরিশোধনের সহজ পদ্ধতি
04:40
হেলালিয়ে-তে যখন পানির মিটার থেকে রিডিং নেওয়া হয়, তখন তা নিয়ে শিগগীরই তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যায়৷ লেবাননের সিডন শহরের এই এলাকাটিতে একটি পাইলট প্রকল্প চলেছে৷ সাধারণত লেবাননে পরিবার পিছু পানির খরচ ধরা হয় মোট হিসেবে: বছরে ১০০ ইউরো৷
জলের মিটার ও রিডিং চালু হওয়া যাবৎ কিছু কিছু মানুষের বিল বেড়েছে বৈকি৷ যে বেশি পানি খরচ করে,তাকে দামও বেশি দিতে হয়৷ বাগানের মালিক সাঈদ ইসা যেমন বলেন, ‘‘খরচ তো বাড়ছেই৷ পানির দাম আরো বাড়লে, স্নান বা ধোয়া-মোছার খরচ৷ অথবা আমি যখন বাগানে কোনো সব্জি লাগিয়েছি যাতে পানি দেওয়া প্রয়োজন৷ কিন্তু আমি সেটা মেনে নিতে পারি৷''
পানির অপচয় রোধের দশ উপায়
পানির আরেক নাম জীবন৷ অথচ এই পানি, বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানি ক্রমশ কমে যাচ্ছে৷ যা জীবনের জন্য এক হুমকি৷ এই হুমকি মোকাবিলায় সচেতন হতে হবে আপনাকেও৷ চলুন জেনে নেই পানির অপচয় রোধের দশ উপায়৷
ছবি: Fotolia/Valua Vitaly
এক কাপ কফি তৈরিতে ১৪০ লিটার পানি!
আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য বা পানীয় তালিকার কিছু পণ্য তৈরিতে অনেক পানি প্রয়োজন হয়৷ যেমন এক কাপ কফি বাগান থেকে আপনার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছাতে খরচ হচ্ছে ১৪০ লিটার পানি৷ আর এক লিটার দুধের পেছনে ব্যয় ১,০০০ লিটার পানি৷ তাই এ সব পানীয়র অপচয় কমানোর মাধ্যমে পানির অপচয় রোধ করা সম্ভব৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Fotolia/dmitrimaruta
মাংস খাওয়া কমাতে পারেন
ওয়াটারফুটপ্রিন্ট ডটঅর্গ-এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এক কেজি মাংস উৎপাদনে সবমিলিয়ে খরচ হয় ১৫ হাজার লিটারের মতো পানি৷ এই হিসাবের মধ্যে পশুর জন্ম এবং বেড়ে ওঠার সময় প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণও বিবেচনা করা হয়েছে৷ এবার ভেবে দেখুন, এক বেলা মাংস না খেয়ে কতটা পানি বাঁচানো সম্ভব?
ছবি: picture-alliance/dpa
পানির ট্যাপের দিকের নজর রাখুন
মুখ ধোয়া বা দাঁত ব্রাশ করার সময় পানির ট্যাপ বন্ধ রাখুন৷ একান্ত যদি গরম পানি পেতে ট্যাপ একটু খুলে রাখতে চান, তাহলে সেই পানি ব্যবহার করতে পারেন ব্রাশ ধোয়ার কাজে৷
ছবি: imago/CHROMORANGE
কাপড় বা থালাবাসন পরিষ্কারে সতর্ক হন
কাপড় ধোয়া বা থালাবাসন পরিষ্কারের মেশিন এখন ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে৷ পুরোপুরি ভর্তি না হওয়া অবধি এ সব মেশিন ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন৷
ছবি: Fotolia/lightpoet
অপ্রয়োজনে ফ্লাশ নয়
অনেকেই যখন-তখন টয়লেট ফ্লাশ করে থাকেন৷ এতে প্রচুর পানি অপচয় হয়৷ তাই একান্ত প্রয়োজন না হলে ফ্লাশ করা থেকে বিরত থাকুন৷
ছবি: by-studio - Fotolia.com
পুকুরে ময়লা ফেলা নয়
বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানুষ সুযোগ পেলেই পুকুর বা খালে ময়লা ফেলে৷ এতে করে পানি দূষিত হয়৷ আর দূষিত পানি পুনরায় পান উপযোগী করে তুলতে খরচ হয় প্রচুর অর্থ এবং বিদ্যুৎ৷ তাই পুকুরে বা খালে ময়লা না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে বা মাটিতে গর্ত করে ময়লা ফেলুন৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
পানির পাইপের দিকে নজর দিন
অনেক সময় পানির পাইপে থাকা বিভিন্ন জোড়া হালকা হয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি বাইরে পরে যায়৷ একটু সতর্ক হলেই এভাবে পানির অপচয় রোধ করা যায়৷ এছাড়া ছাদের ট্যাংকি ভর্তি হয়ে যাতে পানি বাইরে পরে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখুন৷ সময়মতো পানির পাম্প বন্ধ করে দিন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গোসলের সময় অপচয় নয়
বাথরুমে থাকা গতানুগতিক বা পুরনো পানির ঝরনাগুলো সরিয়ে ফেলুন৷ বর্তমানে বাজারে পানি সাশ্রয়কারী ঝরনা পাওয়া যায়৷ সেগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে ২০ থেকে ৬০ শতাংশ পানির অপচয় রোধ সম্ভব৷ আর গোসলের সময় প্রস্রাব করার অভ্যেস তৈরির মাধ্যমে দিনে অন্তত একবার ফ্লাশ করার পানি বাঁচানো সম্ভব৷
ছবি: Fotolia/Valua Vitaly
পানি কখনো ফেলে দেবেন না
পানি পান করার পর যদি গ্লাসের তলায় খানিকটা পানি থেকে যায়, তাহলে তা ফেলে দেবেন না৷ সেটুকু আপনার গাছের গোড়ায় ঢালতে পারেন কিংবা চায়ের কেটলিতে জমাতে পারেন৷
ছবি: mdxphoto - Fotolia.com
সম্ভব হলে বৃষ্টির পানি জমা করুন
বৃষ্টির পানি জমা করে তা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার এমনকি পান করাও সম্ভব৷ বর্তমানে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের বিভিন্ন সরঞ্জামও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে৷ মনে রাখবেন, আপনার সামান্য উদ্যোগ পানির অপচয় রোধে বড় ভূমিকা রাখতে পারে৷ তাই চেষ্টা করে দেখুন না!
ছবি: DW/Karin Jäger
10 ছবি1 | 10
১৫ বছরে ৮০ কোটি ডলার সাশ্রয়
সিডন শহরের বাসিন্দা দেড় লাখের বেশি৷ সেখানে জার্মানির সাহায্যে সারা শহরে ঘরে ঘরে জলের মিটার বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে৷ এছাড়া জল সাশ্রয়েরও প্রেরণা দেওয়া হচ্ছে৷ এই প্রথম সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে: সিডনের প্রতিটি বাসিন্দা দিনে গড়ে ১৩৫ লিটার পানি ব্যবহার করেন – অর্থাৎ জার্মানির থেকে কিছু বেশি৷ এবং সেই পানিরও বিশ শতাংশ বাঁচানো যেতে পারে৷
জার্মানির সরকারি উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা জিআইজেড-এর মানফ্রেড শয় বলেন, ‘‘যখন দেখা যায় যে, আগামী ১৫ বছরে শুধু পানি সরবরাহের ক্ষেত্রেই মোট ৪০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে – তার ২০ শতাংশ বাঁচানো, মানে প্রায় ৮০ কোটি ডলার অবান্তর বিনিয়োগের সাশ্রয়৷''
ভাঙাচোরা পাইপ, নয়তো চুরি
সাশ্রয়কৃত অর্থের অন্য প্রয়োজন আছে: সিডনের পানির ট্যাংকের আধুনিকীকরণের জন্য, সারা দেশে পানির পাইপ বসানো ও মেরামতির জন্য৷ লেবাননের বহু এলাকায় দিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টা ধরে কলে জল আসে যেখানে কলের পানি আছে, সেখানেও তার একটা বড় অংশ ভাঙাচোরা পাইপ থেকে চুঁইয়ে মরুভূমির বালিতে হারিয়ে যায়৷ নয়তো সিডনের পানির ট্যাংকে দিনে ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি তৈরি হয়৷
জিআইজেড-এর ইউনেস হাসিব বলেন, ‘‘এই পরিমাণ পানির মাত্র অর্ধেক বাস্তবিক গ্রাহকদের কাজে লাগে৷ পানির একটা বড় অংশ জলের পাইপ খারাপ হওয়ায় অপচয় হয়, এছাড়া বেশ কিছু পানি বেআইনিভাবে পাইপ থেকে চুরি করা হয় বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে৷''
পাইপে জলের চাপ কমিয়ে অপচয় কমানো
নতুন পাইপ বসানো যেমন ব্যয়বহুল তেমনই সময়সাপেক্ষ৷ কাজেই সিডনের মতো শহরগুলির জন্য জার্মান বিশেষজ্ঞদের একটি সহজ ও কার্যকরি পরিকল্পনা আছে৷ সেটি হলো এমন একটি যন্ত্র, যা প্রয়োজনে রাত্রে পাইপে জলের চাপ কমাতে পারে, যার ফলে পাইপের ফুটোফাটা দিয়ে আরো কম পানির অপচয় হয়৷ যন্ত্রটি বসানোর খরচ মাত্র ৩৫ হাজার ইউরো৷ হাসিবের ভাষ্যে: ‘‘এভাবে পানি বাঁচে দিনে প্রায় এক হাজার ঘনমিটার, যা কিনা প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার বাথটাব ভরার মতো পানি৷ অর্থাৎ কিনা অনেকটা পানি বাঁচানো সম্ভব হয়৷''
প্লাস্টিকের পানির বোতলের জীবন
সারা বিশ্বে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ বোতল পানি বিক্রি হয়৷ কিন্তু পানি পান করার পর প্লাস্টিকের ঐ বোতলগুলোর কী হয় তা কি জানেন? ছবিঘরে থাকছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত৷
ছবি: Fotolia/zhekos
প্লাস্টিকের দামই বেশি
এক বোতল পানি কেনার জন্য আপনি যে দাম দেন তার বেশিরভাগই কিন্তু চলে যায় প্লাস্টিকের জন্য৷ এছাড়া রয়েছে বোতলের গায়ে লেবেল লাগানো, পরিবহণ, সংরক্ষণ ও বোতল নষ্ট করে ফেলার খরচ৷
ছবি: Fotolia/fottoo
তেলের ব্যবহার
অশোধিত তেল দিয়ে তৈরি হয় পলিইথিলিন টেরেফথালেট (পিইটি) প্লাস্টিক৷ এরপর সেটা দিয়েই তৈরি হয় প্লাস্টিকের বোতল৷ এই তেল উৎপাদনের সময় গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়৷ এছাড়া প্লাস্টিক তৈরির সময় বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদান পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে৷ ছবিতে জার্মানির সবচেয়ে বড় তেলশোধন প্ল্যান্ট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বড়ি থেকে বোতল
পরিশোধিত তেল থেকে প্রথমে প্লাস্টিকের এমন ছোট ছোট বড়ি তৈরি করা হয়৷ এরপর সেগুলোকে গলিয়ে বোতল তৈরি করা হয়৷
ছবি: Fotolia/digitalstock
চারে এক
আর্থ পলিসি ইনস্টিটিউটের হিসেবে সারা বিশ্বে উৎপাদিত চারটি পানির বোতলের অন্তত একটি ক্রেতার খোঁজে কমপক্ষে একটি আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে৷ অর্থাৎ, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়৷ এভাবে পানি পরিবহণের জন্য ব্যবহৃত যানবাহন থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পানি সংকট
প্যাসিফিক ইনস্টিটিউটের হিসেবে এক বোতল পানির জন্য তিনগুণ বেশি পানি খরচ হয়৷ ফলে যে অঞ্চলে পানির ফ্যাক্টরি অবস্থিত সেখানকার ভূগর্ভে পানির স্বল্পতা দেখা দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মাত্র অর্ধেক
এক হিসেবে জানা গেছে, ইউরোপে গত বছর প্রায় ৬০ মিলিয়ন প্লাস্টিক বোতল রিসাইকেল করা হয়৷ পরিমাণটা, যত বোতল ব্যবহৃত হয়েছে তার অর্ধেকের কিছু বেশি৷ বাকি বোতলগুলো বিভিন্ন জায়গায় জমে গিয়ে বিশেষ করে জলাধার ও সাগরে পড়ে গিয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে৷
ছবি: JOSEPH EID/AFP/Getty Images
রিসাইক্লিং
ব্যবহার হওয়ার পর পানির বোতলগুলো রিসাইকেল করে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা হয়৷ যেমন এক ধরণের পশম, যেটা শীতবস্ত্র জাতীয় পোশাক তৈরিতে কাজে লাগে৷
এই নবনির্মিত গ্রাহককেন্দ্রে গ্রাহকরা এই প্রথম অভিযোগ কিংবা মেরামতির জন্য একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ পাচ্ছেন৷ ‘দক্ষিণ লেবানন জল কর্তৃপক্ষ' অফিসের লক্ষ্য হলো: গ্রাহকদের মধ্যে পানির মূল্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা৷
জল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আহমদ নিজাম বলেন, ‘‘বহু মানুষ মনে করেন যে, পানি সরবরাহ একটা সরকারি ব্যাপার৷ সে জন্য আমাকে পয়সা দিতে হয় কিনা, সেটা নগণ্য৷ আমরা ইচ্ছেমতো পানি নিই, দাম দিই না, চুরি করি৷ আমাদের দেখতে হবে যাতে এই মানুষরাও বোঝেন, পানীয় জল ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান৷''
বাগানের মালিক সাঈদ ইসা এককালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাসে জল দিতেন৷ আজকাল তিনি সাশ্রয়ী হয়ে গেছেন: সকালে আর বিকেলে ঘাসে পানি দেন৷ কেননা তাঁর পানির খরচ পানির মিটারেই দেখা যায়, আর সেই পানির বিল ইসা-কেই মেটাতে হয়৷
প্রথমে সিডন, পরে গোটা দেশ
জিআইজিড-এর মানফ্রেড শয় লক্ষ্য করেছেন: ‘‘লোকজন বেশ ভালোভাবেই এই পানির মিটারকে মেনে নিয়েছে, বিদ্রোহ করেনি৷ এবং সেটা সারা দেশের পক্ষে একটা পথনির্দেশ বলে আমার ধারণা৷ আমরা অন্যান্য এলাকাতেও এটা করার চেষ্টা করবো – ধীরে ধীরে গোটা দেশটাতেই পানির মিটার বসাব৷''
চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, সমগ্র লেবাননের জন্য একটি আধুনিক পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, দিনে ২৪ ঘণ্টা পানি৷ সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে আর হয়ত বছর দশেক সময় লাগবে৷